বাম পকেটে কালীর ছবি রাখতেন শৈলেন মান্না, ফুটবলে যেভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন ‘মান্নাদা’
Football legendary Shailen Manna : ১৬ বছর বয়সে প্রবেশ করেছিলেন ক্লাব ফুটবলে। দু’বছর হাওড়া ইউনিয়নে খেলার পর যোগ দেন মোহনবাগানে। এরপর দীর্ঘ ১৯ বছর, মোহনবাগান ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন ‘মান্নাদা’।
প্রায় এগারো বছর পেরিয়ে গিয়েছে তিনি আর নেই, অথচ আজও কলকাতা ময়দানের ইতিউতি ঘাঁটলে ‘মান্নাদা’ নামে এক ডাকে সকলেই চেনে তাঁকে। আসল নাম শৈলেন্দ্রনাথ মান্না। গোষ্ট পাল-কে যদি ভারতীয় ফুটবলের সম্রাট ধরা হয়, তাহলে তার পরবর্তী স্থানে উঠে আসতেই পারে ভারতীয় ফুটবলের প্রবল পরাক্রমী ডিফেন্ডার শৈলেন মান্নার নাম। ২০১২ সালে আজকের দিনেই অর্থাৎ ২৭ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি।
খেলোয়াড় হোক বা প্রশিক্ষক অথবা ক্লাবের কর্মকর্তা, সবকটি ভূমিকাতেই ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে শৈলেন মান্নার অবদান অনস্বীকার্য। ১৯২৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর হাওড়া জেলার ব্যাঁটরায় জন্ম গ্রহণ করেন শৈলেন মান্না। ছোটো থেকেই ঝোঁক ছিল ফুটবল খেলায়। মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকে পায়ে বল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে থাকেন মাঠে-ময়দানে। পড়াশোনাতেও ছিলেন যথেষ্ট মেধাবী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করে যোগ দেন জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কাজে। মোটা অঙ্কের সরকারি বেতনের নিশ্চয়তা অবশ্য কোনোদিনই মন ভরাতে পারেনি শৈলেনের। মন পড়েছিল সেই মাঠেই। মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রবেশ করেছিলেন ক্লাব ফুটবলে। দু’বছর হাওড়া ইউনিয়নে খেলার পর যোগ দেন মোহনবাগানে। এরপর দীর্ঘ ১৯ বছর, মোহনবাগান ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন ‘মান্নাদা’।
আরও পড়ুন - “জয় অথবা মৃত্যু”! বিশ্বকাপ ফাইনালের আগে ফুটবলারদের টেলিগ্রাম করলেন মুসোলিনি
১৯৫০-১৯৫৫, টানা পাঁচ বছর মোহনবাগানের অধিনায়ক ছিলেন শৈলেন মান্না। তিনি অধিনায়ক থাকাকালীন মোহনবাগান ক্লাব স্বর্ণযুগের সাক্ষাৎ করে। এইসময় ছ’বার আই.এফ.এ শিল্ড জয় করা ছাড়াও পাঁচবার ডুরান্ড কাপ জেতে মোহনবাগান। এমনকি ১৯৫৫ সালে প্রথমবার রোভার্স কাপ জয়ও আসে তাঁর নেতৃত্বেই। জানা যায়, কখনওই এই ক্লাবে খেলার জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেননি মান্নাদা।
বাংলার দল ব্যাতিরেকে ভারতীয় ফুটবলেও শৈলেন মান্নার অবদান কিছু কম ছিল না। তাঁর পায়ের শটে এতোটাই জোর ছিল যে, বিপক্ষের গোলরক্ষক রীতিমতো শঙ্কিত থাকতেন। শোনা যায়, একবার তাঁর মারা বল ধরতে গিয়ে বিপক্ষ গোলরক্ষকের হাত পর্যন্ত ভেঙে গিয়েছিল। বাকিমহ্যাম প্যালেসে স্বয়ং রাজকুমারী মার্গারেট একবার শৈলেন মান্নাকে প্রশ্ন করেছিলেন, খালি পায়ে খেলে-ও তিনি কীভাবে এত অপ্রতিরোধ্য তিনি? জবাবে শৈলেন মান্না বলেছিলেন, খেলার আসল শক্তিটা থাকে মাথায়। মাথার সঙ্গে পায়ের যে অকৃত্রিম যোগাযোগ তিনি ময়দানে আজীবন স্থাপন করেছিলেন, তা আজও স্মরণ করে বাঙালি।
১৯৪৮ সালে লন্ডন অলিম্পিকে ভারতীয় ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। সেবার লন্ডন অলিম্লিকে ফ্রান্সের কাছে ২-১ গোলে হারলেও খালি পায়ে খেলা ভারতীয় দলের একাগ্রতা সারা পৃথিবীর নজর কেড়ে নিয়েছিল। ১৯৫০ সালে ফুটবল বিশ্বকাপে সুযোগ পায় ভারতীয় ফুটবল দল। সে সময় বিশ্বকাপ দলের সদস্য ছিলেন শৈলেন মান্না। কিন্তু মুম্বাই থেকেই ফিরিয়ে আনা হয় ফুটবল দলটিকে। বিশ্বকাপে না যেতে পারার সেই আক্ষেপের কথা জীবনভর ভুলতে পারেননি মান্নাদা। কথা প্রসঙ্গে তিনি চিরকালই সেই ঘটনার উল্লেখ করতেন। আরও একটি আক্ষেপের কথা বারবার বলতেন তিনি, তা হল লন্ডন অলিম্পিকে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রথম পেনাল্টি মিস।
ব্রাজিল বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও, ১৯৫১-তে তাঁর অধিনায়কত্বেই এশিয়ান গেমসে সোনা জয়ের শিরোপা জোটে ভারতীয় ফুটবল দলের। তার ঠিক পরের বছর হেলসিঙ্কি অলিম্পিকেও ভারতীয় ফুটবলের অধিনায়ক ছিলেন তিনিই। এমনকি ১৯৫৩ সালে ইংল্যান্ড ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ইয়ারবুকে বিশ্বের সেরা ১০ ফুটবল অধিনায়কের মধ্যে জায়গা করে নেন মান্নাদা। ১৯৫২ থেকে ৫৬ সাল, টানা চারবার কুয়ানড্রাগুলার টুর্নামেন্ট তাঁর নেতৃত্বে জেতে ভারতীয় ফুটবল দল। এই সময়টা আক্ষরিক অর্থেই রাজার মতো ময়দান কাঁপিয়েছেন তিনি। ১৯৬০ সালে খেলা ছাড়ার পরও ময়দানের মায়া কাটাতে পারেননি মান্নাদা। ১৯৬১ সাল থেকেই আবার কাঁধে তুলে নেন মোহনবাগান ক্লাবের প্রশিক্ষকের দায়িত্ব। সম্প্রতি হাওড়া জেলার ডুমুরজলা স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয় প্রয়াত কিংবদন্তি ফুটবলার শৈলেন মান্নার নামে।
আরও পড়ুন - মুরগির মাংস খেলেই ম্যাচে হার! ফুটবলের বিচিত্র কুসংস্কারের এই ইতিহাস অজানাই
শোনা যায়, কিছু তাবড়-তাবড় ফুটবলাররা যেমন কিছু কুসংস্কারে বিশ্বাস করতেন বা এখনও করে থাকেন, শৈলেন মান্নাও তার ব্যাতিক্রম ছিলেন না। খেলার সময় ম্যাচ চলাকালীন মাঠে নামার আগে বাম পকেটে সর্বদা মা কালীর ছবি রাখতেন তিনি। গোষ্ঠ পালের পর তিনিই বাংলার দ্বিতীয় ফুটবল তারকা, যিনি ১৯৭১ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে ভূষিত হন। এরপর ২০০০ সালে ‘অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশন’ তাঁকে সহস্রাব্দের সেরা ফুটবলার অর্থাৎ ‘ফুটবল অফ দ্য মিলেনিয়াম’ সম্মান দেয়। ২০০১ সালে ভূষিত হন ‘মোহনবাগান রত্ন’ সম্মানে।
দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ২০১২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ৮৭ বছর বয়সে মৃত্যু হয় ভারতের ‘ফুটবল অফ দ্য মিলেনিয়াম’ শৈলেন্দ্রনাথ মান্নার। তাঁর মৃত্যুতে ভারতীয় ফুটবল জগতের আকাশ থেকে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক চিরতরে হারিয়ে যায়।