পলাশের ডাল ভাঙা, মদের মোচ্ছব | শান্তিনিকেতনে দোলখেলার শ্মশানযাত্রা

Shantiniketan Dol Utsab: বসন্ত পঞ্চমীর প্রভাতে শান্তিনিকেতন আশ্রমে প্রথম এই ঋতু উৎসব বা বসন্ত উৎসবের সূচনা করেন রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

নানা ধরনের উৎসব শান্তিনিকেতনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশেষ বিশেষ চরিত্র অনুযায়ী। সেইসব অনুষ্ঠান বা উৎসবের মধ্যে বসন্ত উৎসব হলো অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব। প্রতি বছর এই অনুষ্ঠানে মানুষ আসত ভিড় করে, দেখার জন্য ও অবশ্যই শোনার জন্য। বিশ্বভারতীর এই উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গান ও ছাত্রছাত্রীদের নৃত্য পরিবেশন। এর মধ্যে কোনও ধর্মীয় প্রভাব কোনও কালে ছিল না। বসন্ত উৎসব প্রকৃত প্রস্তাবে সার্বিকভাবেই সাংস্কৃতিক, ঐক্য ও সুখের প্রতীক। একটি রঙিন ভাব অবকাশে এই উৎসব পালিত হয়। ফুল, হলুদ গুঁড়ো, চন্দনের পেস্ট প্রভৃতি ছিল এই উৎসবের প্রধান উপকরণ। বসন্ত পঞ্চমীর প্রভাতে শান্তিনিকেতন আশ্রমে প্রথম এই ঋতু উৎসব বা বসন্ত উৎসবের সূচনা করেন রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই উৎসব আসলে সম্প্রীতির, ভালোবাসার এবং ঐক্যের তথা বন্ধুত্বের দিক নির্দেশ করে। প্রকৃতির সৌন্দর্যকে আলিঙ্গন করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আজ তা ভিন্ন পথ নিয়েছে। দিনে দিনে শান্তিনিকেতন আশ্রমের মূল ভাবধারাটি ক্রমেই অপসৃয়মান হয়েছে অতি দ্রুত।

এর প্রধান কারণ দু'টি প্রাতিষ্ঠানিক দিক। একটি হলো স্বয়ং বিশ্বভারতী অন্যটি আঞ্চলিক প্রশাসন।

প্রশাসনের কথায় পরে আসছি। আগে জানাই বিশ্বভারতীর ভূমিকা। দীর্ঘদিন রবীন্দ্রনাথ রচিত 'খোল দ্বার খোল' গানটিকে যেভাবে থিম সং বা কেন্দ্রীয় সংগীত হিসেবে বিবেচিত হতে দেখেছি তা ক্রমে তার বিপরীতে ভিন্নতর মাত্রায় এখন দরজা-জানালা বন্ধ করার নির্দেশিকাতে পর্যবসিত হয়েছে। ২০১৯ সালে শেষবারের মতো উৎসব পালিত হলেও তারপর কোভিডের কারণে ও তৎকালীন উপাচার্যের খামখেয়ালি আচরণে বসন্ত উৎসব বন্ধ হয়ে যায়। এ বছর বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ নানা অছিলায় উৎসবের মূল ভাবধারাটি কেটেকুটে তাকে বসন্ত বন্দনা করেছে, যেখানে শুধুমাত্র বিশ্বভারতীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মানুষেরই সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন। তার সঙ্গে নির্ধারিত দিনটিও এগিয়ে নিয়ে আসা হয়। এর কারণ কী? তার কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন- রবিঠাকুরের পৌষমেলায় গ্রামীণ মানুষ, আদিবাসীরাই এখন সংখ্যালঘু

যে দিনটি ছিল উৎসবমুখর, নাচে গানে উদ্বেলিত, যার মূল সুরটি ছিল মানুষে মানুষে মিলনকে ত্বরান্বিত করা, অন্দর-বাহিরের ভেদাভেদ কাটিয়ে এক সম্মেলনের আয়োজন— তাকে সম্পূর্ণতই রবীন্দ্রভাব ও ভাবনার বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়ে পুরো উৎসবেরই জলাঞ্জলি দেওয়া হলো নির্দ্বিধায়। ঠিক যেভাবে বিশ্বভারতীর চতুর্দিকে পাঁচিল তুলে সাঁওতাল গ্রামগুলিকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। যেভাবে সাধারণের জন্য বিশ্বভারতীর দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেভাবেই বসন্ত উৎসবকে বসন্ত বন্দনায় রূপান্তরিত করা হলো। জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলো। ঐতিহ্যকে বিনষ্ট করা হলো। কেন হলো, কী কারণে হলো তার কোনও যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। বলে দেওয়া হলো, বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করেছে। অথচ এ তো ছিল বাংলার সংস্কৃতির অঙ্গ! তাকে কোনও মর্যাদাই দেওয়া হলো না!

বাঙালির চিন্তা-চৈতন্যে এখন ঢুকে পড়েছে অবাঙালির হোলি। দোলও ক্রমে গত হয়েছে। বসন্ত উৎসব-টুৎসব সব মাটি হয়েছে। অথচ দোল খেলার গন্তব্য হয়েছে শান্তিনিকেতন। তা সে বিশ্বভারতীর অকুস্থলে যাওয়া গেল কী গেল না সেটা বড় কথা নয়। যাহাদের শান্তিনিকেতন নাই তাহাদের সোনাঝুরি আছে! ফি বছর দোলের দিন (বা আগের দিন) হাজার হাজার গাড়ি আর লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়। স্থানীয়দের কাছে এ এক সামাজিক উৎপাত! সোনাঝুরির হাট ও তৎসন্নিহিত এলাকায় এই সময় সকাল থেকে বাজতে থাকে অগুনতি ডিজে। তার সঙ্গে এক ছটাক বাউল আর দেড় চামচ সাঁওতাল নাচও থাকে। রঙ খেলা চলে, মদ খাওয়া চলে। আমোদে-প্রমোদে হুজ্জুতির চূড়ান্ত এক মহামিলন ক্ষেত্র যেন। কোথাও কোন বাধানিষেধ নেই।

আরও পড়ুন- মদ, মাংস এবং … হোটেল-রিসর্টময় শান্তিনিকেতন এখন যেখানে দাঁড়িয়ে

এবার ঠিক দোলের কিছুদিন আগে বনদপ্তর থেকে নির্দেশিকা এল যে, দোলে সোনাঝুরিতে দোল খেলা যাবে না। ড্রোন দিয়ে ছবি তোলা যাবে না। মাইক বা ডিজে বাজানো যাবে না। সোনাঝুরিতে গাড়িও নিয়ে যাওয়া যাবে না। তবে হাট যথারীতি খোলা থাকবে। বোলপুরের সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও এতে স্বস্তি পেয়েছিল জেনে যে, এবার তাহলে কলকাতার থেকে হাজার হাজার মানুষের আসা বন্ধ হবে, উৎপাত কমবে। এদিকে বিরোধী রাজনৈতিক দল চিৎকার করতে শুরু করল! দোল খেলা আমাদের ধর্মীয় অধিকার। ব্যাস, তাতেই কাজ হলো। দোলের দুই-তিন দিন আগে বনদপ্তরের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী জানালেন, সোনাঝুরিতে দোল খেলা যাবে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করেও দোল খেলা যাবে। তার একমাত্র কারণ হলো, ভোট যে বড় বালাই। ফলে আবারও এই ঘৃণ্য রাজনীতির কাছে দশ গোল খেয়ে গেল পরিবেশ, প্রকৃতি ও সমাজ।

এবারও যেই-কে-সেই। সে এক ভয়াবহ অবস্থা! পলাশের ডাল ভেঙে, গাছগুলোকে অর্ধমৃত করে চলল দু'দিনের উল্লাস। তা শুধু ওই সোনাঝুরি অঞ্চলের মধ্যেই সীমিত থাকেনি। দোলের আনন্দ-ফুর্তিতে তো মদ থাকবেই। ফলে গ্রামে-গ্রামে ঘুরে হাঁড়িয়া খুঁজতে দলে দলে ছোকরার দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। মদের দোকানেও দীর্ঘ লাইন। এখানে-সেখানে মদ খেয়ে বচসা দেখা গেছে যত্রতত্র। এর সঙ্গেই বাজারে জিনিসপত্রের দাম স্বর্গমুখী হয়ে যায়। যে কোনও সময়েই পর্যটকদের আগমনেই এই একই চিত্র ঘুরেফিরে আসে বোলপুর, শান্তিনিকেতনে। এই ক'দিনে স্তুপীকৃত আবর্জনা ছড়িয়ে থাকে সমস্ত শহরের রাস্তাঘাটে। কারও কোনও দায় নেই। বিশ্বভারতী তো অনেক আগেই হাত মুছে ফেলেছে। প্রশাসনের কবে ঘুম ভাঙে জানা নেই। সামনেই বর্ষা!

আমরা বরং গলা ছেড়ে গাই, ওরে গৃহবাসী...

More Articles