২০ বার স্নাতক, বিশ্বের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি শ্রীকান্ত জিচকর ছিলেন দেশের সর্বকনিষ্ঠ বিধায়ক
Shrikant Jichkar: ভারতের, মতান্তরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিশ্ববিদ্যালয়-ডিগ্রিধারী হলেন শ্রীকান্ত। ৪২টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০টি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ বিধায়ক।
প্রতিটি মানুষই তাঁর জীবনে কোনও না কোনও কাজের মাধ্যমে জনমানসে অমর হয়ে থাকতে চান। যে জন্য অনেকেই তাঁদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে পড়াশোনার মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। অনেকে আবার নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে ফটোগ্রাফি, অভিনয়, সঙ্গীত, ভ্রমণ সংক্রান্ত বিষয় বা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী অন্যকিছুকে নিজের পেশা হিসেবে নির্ধারণ করেন। কেউ কেউ আবার সাহিত্যক্ষেত্রে দিকপাল হয়ে ওঠেন কিংবা অনেকেই রাজনীতির প্রতিও আকৃষ্ট হন। অন্তত এই বিষয়গুলিই আমরা প্রায়শই দেখতে পাই। কিন্তু, আজ এমন এক ব্যক্তির প্রসঙ্গ উঠবে যাঁর পরিচয় দিতে গেলে সব বিশেষণই কম পড়বে।
“বাবুমশাই জিন্দেগি লম্বি নেহি, বড়ি হোনি চাহিয়ে”, আজকের আলোচ্য মানুষটির ক্ষেত্রে এই কথাটি ১০০ শতাংশ প্রযোজ্য। মানুষ সাধারণত দ্বাদশ শ্রেণি পাস করার পর কলেজে ভর্তি হয়ে গ্রাজুয়েট হন। এরপর চাকরি-বাকরির চেষ্টা করেন এবং একটি স্থির সাংসারিক জীবনে উপনীত হন। অনেকে আবার পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেন। কেউ কেউ পোস্ট গ্রাজুয়েশনের পর পিএইচডিও করেন। মোদ্দাকথা, গড়পড়তা মানুষ হলে পড়াশোনার ক্ষেত্রে আপনি কখনও না কখনও ক্ষান্ত দেবেনই। তবে কিছু মানুষ ভবলীলা সাঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত থামেন না। তেমনই একজন হলেন শ্রীকান্ত জিচকর। প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের সংজ্ঞা কী, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সার্বজনীন কদরের ব্যাপারে কারও আপত্তি নেই। আর এদিক থেকেই অনন্য শ্রীকান্ত জিচকর।
মনের জোর আর একাগ্রতা এই দু’টি না থাকলে বোধহয় কোনও ক্ষেত্রেই সফল হওয়া সম্ভব নয়। তবে সেসব থাকলেও বোধহয় কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব হত না। এখানেই ব্যতিক্রম এই মানুষটি। ভারতের, মতান্তরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিশ্ববিদ্যালয়-ডিগ্রিধারী হলেন শ্রীকান্ত। ৪২টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০টি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর ৪৯ বছরের জীবনে তিনি ছিলেন একাধারে চিকিৎসক, আইনজীবী, পুলিশ কর্মকর্তা, কূটনীতিবিদ, সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহক-সহ অনেক কিছু; এবং সেই সঙ্গে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ বিধায়ক।
আরও পড়ুন-কনসার্ট থেকে বিয়েবাড়ি- নেই সেই আবাহন, হারিয়েই যাবে বিসমিল্লার ‘পাগলা’ সানাই?
শ্রীকান্ত ১৯৫৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর নাগপুরে একটি মারাঠি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বাদশ শ্রেণির পড়াশোনা শেষ করে তিনি নাগপুরের একটি মেডিক্যাল কলেজ থেকে প্রথমে এমবিবিএস এবং পরে এমডি করেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে সফলভাবে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর, শ্রীকান্ত আইন নিয়েও পড়াশোনা শুরু করেন। আইনে স্নাতক পাশ করার পর আন্তর্জাতিক আইনে স্নাতকোত্তর করেন। আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর শ্রীকান্তর মধ্যে আরও উচ্চশিক্ষিত হওয়ার ইচ্ছা চেপে বসে। সিদ্ধান্ত নেন, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে পড়াশোনা করবেন। বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে ডিগ্রি অর্জন করার পর শ্রীকান্ত সাংবাদিকতায় স্নাতক হন। সংস্কৃতে ডক্টরেট অফ লিটারেচার (ডি-লিট)-ও পান শ্রীকান্ত। এছাড়াও সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ববিদ্যাতেও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন শ্রীকান্ত।
মাথা ঝিমঝিম করছে তো! মাথার আর দোষ কী! তবে এখানেই শেষ না। এতসব পড়তে পড়তে যখন একঘেয়েমি আসে শ্রীকান্তের তখন তিনি ঠিক করলেন, একটু স্বাদ বদলানো যাক। ২৪ বছর বয়সী শ্রীকান্তের ইচ্ছে জাগলো যে পুলিশ হবেন তিনি। যেই ভাবা সেই কাজ। বসে গেলেন ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস (আইপিএস) পরীক্ষায়। ফলাফল? যথারীতি সেখানেও উতরে গেলেন। ১৯৭৮-৮০, দু’বছর চুটিয়ে পুলিশের চাকরি করার পর তাঁর আবার নতুনের নেশা চেপে বসল। ১৯৮০-তে বসলেন ভারতের সবথেকে গৌরবময় এবং কঠিন সরকারি চাকরির পরীক্ষা ‘ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’-এ। তখনও ইউপিএসসি চালু হয়নি। তখন আইএএস এবং আইপিএসের চাকরির জন্য আলাদা আলাদা পরীক্ষা হত। এবার চার মাস গড়াতে না গড়াতেই সে চাকরিও ছেড়ে দিলেন শ্রীকান্ত জিচকর। এবার স্বপ্ন আরও বড় কিছু হবার, এবার স্বপ্ন আসল ‘পাওয়ার’-এর স্বাদ চেখে দেখার, এবার স্বপ্ন রাজনীতিতে প্রবেশ করার।
এমন গুণীকে কে না দলে পেতে চাইবে। শ্রীকান্তের ওপর ভরসা রেখেছিলেন সেই সময়ে মহারাষ্ট্রে কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় নেতা ‘মারাঠা স্ট্রংম্যান’ শরদ পাওয়ার। মাথায় শরদ পাওয়ারের আশীর্বাদ থাকায় চাকরি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তাই কংগ্রেসের হয়ে মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে লড়বার টিকিট পান। বয়স তখন তাঁর মাত্র ২৫। নির্বাচনে জিতেও যান শ্রীকান্ত। শ্রীকান্ত হন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ বিধায়ক বা এমএলএ। শুধু কি বিধায়ক হয়েই থামলেন শ্রীকান্ত? ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে বিধায়ক থাকার পর ১৯৮৬-তে দ্বিতীয় মেয়াদে এসে তিনি হন মহারাষ্ট্রের কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য। প্রাথমিকভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকলেও, একই সময়ে তিনি সামলেছেন ১৪টা মন্ত্রকের গুরুদায়িত্ব। নিপুণ দক্ষতায় সেই দায়িত্বগুলিও সামলেছেন তিনি ১৯৯২ সাল অবধি। শংকর রাও চৌহান, শরদ পাওয়ার এবং বিলাস রাও দেশমুখের ক্যাবিনেটে তিনি ছিলেন অঘোষিত ‘নম্বর টু’। এরপর ১৯৯২ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন শ্রীকান্ত। রাজ্যসভার দায়িত্বও যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছেন তিনি। এইজন্যই নিজের ছয় বছরের সময়কালে তিনবার রাজ্যসভার শ্রেষ্ঠ সাংসদের খেতাব অর্জন করেন তিনি।
আরও পড়ুন-নায়ক-নায়িকা নয়, তাঁদের জুটির আকর্ষণে হল ভরাত দর্শক! কেন ভেঙেছিল সেলিম-জাভেদ জুটি?
অসম্ভব মেধাবী শ্রীকান্ত জিচকরকে ‘লিমকা বুক অব রেকর্ডস’-এর তরফে ভারতের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তির খেতাবও দেওয়া হয়। ১৯৮৩-তে বিশ্বের অসামান্য দশজন তরুণ হিসেবেও নির্বাচিত হন। বাচ্চাদের মধ্যে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিতে শ্রীকান্ত নাগপুরে একটি স্কুল খোলেন। এই স্কুলে ভারতের অন্যতম বড় লাইব্রেরি রয়েছে। বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৫২ হাজার। তিনি শুধু বই নিয়েই পড়ে ছিলেন না; একাধারে ফটোগ্রাফার, মঞ্চাভিনেতা এবং চিত্রশিল্পীও ছিলেন শ্রীকান্ত। এছাড়াও বেতার চালনা ও জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন তিনি। তিনি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ ও ইউনেস্কোতে ভারতের প্রতিনিধিত্বও করেছেন বহুবার। শ্রীকান্তের জীবন আক্ষরিক অর্থেই ছিল বর্ণময়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তা মোটেও লম্বা ছিল না। ২রা জুন, ২০০৪-এ মাত্র ৪৯ বছর বয়সে নাগপুরে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় এই জিনিয়াসের। রাজেশ খান্নার সেই অমোঘ ডায়লগ- “বাবুমশাই জিন্দেগি লম্বি নেহি, বড়ি হোনি চাহিয়ে”, যথার্থই প্রযোজ্য শ্রীকান্তের জন্য।