নিরাপদ নির্মাণ: শ্যাম বেনেগালের সিনেমা

Shyam Benegal: যখন নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জীবনীচিত্রের কথা ওঠে তখন তিনি বাঙালি চিত্তের মিশেল দিয়ে ফরগটেন হিরো তৈরি করেন কিন্তু তাতে তাঁর নিজের সংরক্তি কতটুকু?

শ্যাম বেনেগালের প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক ধরনের সাহিত্যধর্মের অবসান হলো। বেনেগাল ইমেজের মাধ্যমে গল্প বলতে পারতেন। এই কৃতিত্ব বাংলা ছবিতে যতটা সুলভ-সম্ভব হিন্দিতে ততটা নয়। তাঁর প্রয়াণে যে সমস্ত বিদায়স্ত্রোত্র রচিত হচ্ছে তার সমস্যা হচ্ছে, তাতে স্মৃতিচারণা আছে কিন্তু শ্যাম বেনেগালকে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে বিচার করা হবে তার কোনও নিশানা নেই। আমাদের সমালোচনাধর্ম সব যুগেই নিতান্ত দুর্বল, আজকে তা প্রায় জনসংযোগবার্তায় পর্যবসিত হয়েছে। ফলে আমি বলতে বাধ্য যে, তাঁর কিংবদন্তিপ্রতিম মাসতুতো ভাই ও অগ্রজ গুরু দত্ত যেমন প্রতিভার দীপ্ত শিখর, বেনেগাল কখনই তেমন নন। কিন্তু তিনিও, যাকে বলে 'ভদ্রলোকের সিনেমা', তার পক্ষে এক সুষম মানচিত্র।

কোনও সন্দেহ নেই যে পঞ্চাশ দশকে গুরু দত্তের ছবি যেভাবে মেলোড্রামার আবরণে ভারতীয় সমাজের তরঙ্গভঙ্গকে পরীক্ষা করে, শ্যাম বেনেগালের ছবি অত উচ্চাশাপরায়ণ নয়। তিনি গত শতাব্দীর সত্তর দশকে যখন রাজেশ খান্না অস্তায়মান ও অমিতাভ বচ্চন উদীয়মান, তখন রুচির একটি প্রকৌশলে মধ্যবিত্তকে আশ্বাসবাক্য দিতে পেরেছিলেন। অঙ্কুর (১৯৭৩) মূলত অনন্ত নাগ, সাধু মেহের ও শাবানা আজমির সৌজন্যে এই প্রতিশ্রুতি। আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করি, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সত্যজিৎ রায় তাঁর বিখ্যাত 'সওয়া চার' (ফোর অ্যান্ড আ কোয়ার্টার) প্রবন্ধে এ এস সাত্থু ও বেনেগালকে দ্বিতীয় পর্যায়ের নবতরঙ্গের প্রধান চরিত্র মনে করছেন ও প্রায় নস্যাৎ করে দিতে চাইছেন মণি কৌল ও কুমার সাহানির ছবি দু'টিকে। এ কথা সত্যি যে, ঋত্বিক ঘটকের অভিভাবকত্বে কুমার, মণি ও অন্যান্যরা যেভাবে আখ্যানকে তছনছ করে দিতে চাইছিলেন নৈশ আততায়ীর মতো, বেনেগাল কখনই তা করেননি। শ্যামের ছবি একটি অনুমিত বৃত্তে ভারতীয় সামন্ততন্ত্রকে প্রশ্ন করেছে ও স্তব্ধতায় বিলীন হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন- এদেশের বিকল্প ইতিহাসকে সিনেমার ফ্রেমে ধরতে চেয়েছিলেন শ্যাম বেনেগাল

সত্তর দশকে তাঁর যে তিনটি ছবি— 'অঙ্কুর', 'নিশান্ত' ও 'ভূমিকা', তা দেখলেই দেখা যাবে, যদিও শ্যাম বেনেগাল সামাজিক মলাটটিকে উপেক্ষা করছেন না এবং এক ধরনের নমনীয় বামপন্থায় বিশ্বাস করে চলেছেন যখন রাজনীতিতেও সে যুগের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি সামন্তবাদকে আঘাত হানছেন ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রীয়করণ বা রাজন্যভাতা বিলোপ ইত্যাদি কর্মসূচির মধ্য দিয়ে, তবুও শ্যামের মূল লক্ষ্য মানবীয় সম্পর্কের নুড়িপাথরগুলিকে সুবিন্যস্ত করা। তিনি আদি, মধ্য ও অন্তযুক্ত একটি গল্প বলতে জানতেন। তাতে শিক্ষিত নাগরিক শ্রেণি মুগ্ধ হতে পারে এমন নানা উপকরণ ছড়িয়েছিল। যেমন নবীন অভিনেতাদের তিনি ব্যবহার করতেন। নাসিরুদ্দিন শাহ, শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল প্রমুখ তারকা জগতের বাইরের নক্ষত্রেরা তাঁর চিত্রনাট্যে সুবিচার পেয়েছিল। সেদিক থেকে দেখলে আমার মনে হয়, শ্যাম বেনেগাল ততটা আর্ট হাউস সিনেমার পক্ষপাতী নন, যতটা লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মেলবন্ধনের। সত্যজিৎ রায় যেটাকে উদার সমর্থন জানিয়েছিলেন তা এই জন্যই যে তিনি কোনও নব্য আঙ্গিক অথবা দূরপ্রসারী বক্তব্যের প্রচলন ঘটাননি। সামাজিক প্রত্যাশার ইচ্ছাপূরণ ঘটিয়েছিলেন। সমস্ত ভারতবর্ষ যখন ভূমি সংস্কারের জন্য অধীর হয়ে উঠেছে তখন অঙ্কুর ছবিটি সেই বিষয়ে ইঙ্গিত দেয় কিন্তু না নির্মাণে, না কথকতায় শ্যাম বেনেগাল ধ্বংসাত্মক ছিলেন। ফলে তাঁকে আয়ত্ত করা সুবিধার হয় দর্শকের পক্ষে। 'নিশান্ত' ছবিটিও এভাবে জমিদারের নির্যাতন ও যৌন নিপীড়ন পরীক্ষা করেছে। তবে তার অন্তস্থলে কিন্তু বেনেগাল বুনে দিয়েছেন একটি পেলব ও নমনীয় প্রণয় ছন্দ। আর 'ভূমিকা' ছবিটির দিকে তাকালেও, মারাঠি নাটমঞ্চের যে অভিনেত্রীকে নিয়ে তিনি চিন্তিত তা কোনওক্রমেই মাদাম ব্যোভ্যারির জীবন জিজ্ঞাসার সমান্তরাল কোনও রেখা নয়, আমরা সেখানে বারেবারেই মুগ্ধতার মায়ঞ্জনে অভিভূত হয়ে পড়ি।

আসলে বেনেগাল এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের মতোই বিজ্ঞাপনের জগত থেকে। ফলে তিনি জনগ্রাহ্য প্রতিরূপায়নের রহস্য জানতেন এবং সেই অনুযায়ীই তিনি ছবি বানিয়েছেন। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষের প্রশ্ন ওঠেনি। প্রতিষ্ঠান কখনও তাঁকে পরিত্যাগ করেনি। যখন নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জীবনীচিত্রের কথা ওঠে তখন তিনি বাঙালি চিত্তের মিশেল দিয়ে ফরগটেন হিরো তৈরি করেন কিন্তু তাতে তাঁর নিজের সংরক্তি কতটুকু? বা যখন তিনি প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উপর সিনেমাটি বানান বাংলাদেশের পক্ষ থেকে (হয়তো এই ছবি আর মুক্তি পাবে না) তখনও তিনি মূলত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একটি ছবি করেন যেখানে একটি পরিচ্ছন্ন নির্মাণ কৌশল নিশ্চয়ই আছে, যা নেই তা হলো শিল্পীর অশ্রুপুঞ্জ ও স্বীকারোক্তি। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে তিনি পশ্চিমবঙ্গের ভূমি সংস্কার নিয়ে যে ছবিটি করলেন সেই 'আরোহণ' (১৯৮২) কুমারী মৃত্তিকাকে যে ধরতে পেরেছে তা বলব না। এ ছবিও তথ্যপুঞ্জের দিকে তাকিয়েছে। বেনেগালের আরেকটি অবদান নিশ্চয়ই, মুসলমান নারীর হেঁসেলে উঁকি দেওয়া। মাম্মো বা জুবেইদা ইত্যাদি ছবিতে তিনি যাঁরা পর্দার আড়ালে, তাঁদের প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে চেয়েছেন কিন্তু সেখানেও বাসনা অত্যন্ত সাবধানী, আবেগ অত্যন্ত মার্জিত এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা অত্যন্ত স্পষ্ট।

আরও পড়ুন- সিনেমার কৌমার্যব্রত: কুমার সাহানি

আমি যা বলতে চাইছি তা সংক্ষেপে এই যে, শ্রীযুক্ত শ্যাম বেনেগাল নিশ্চয়ই একজন গুণী চিত্রনির্মাতা কিন্তু তিনি কখনও স্রষ্টা হওয়ার ঝুঁকি নেননি যা তাঁর গুরু সত্যজিৎ রায় নিতে পেরেছিলেন বা তাঁর অগ্রজ গুরু দত্ত যেখানে আরবসাগরকুলে আছড়ে পড়েছিলেন। শ্যাম বেনেগালের বিদায় নিশ্চয়ই স্পেক্ট্যাকলের রাজত্বে আমাদের একটি বিষণ্ণ মুহূর্ত। আর হয়তো আমরা কখনই দেখব না নরম আলোর সকালে এক পিতা তাঁর সন্তানকে কী সুন্দরভাবে বাড়ির আঙিনায় হিসু করিয়ে দিচ্ছেন, আর দেখব না এক অভিনেত্রীর মেকাপের ফাঁকফোকরের টুকিটাকি মুহূর্ত। অথবা সংখ্যালঘু এক রমণী কীভাবে তাকিয়ে থাকেন অপলক। সেদিক থেকে দেখলে আমাদের দেখার চোখের আলো কমে গেল। আমাদের অভিনেতা অভিনেত্রীদের যে নতুনভাবে প্রয়োগ করা যায় এমন পরিচালকের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। শ্যাম বেনেগাল সেখানেও দৃষ্টান্ত ছিলেন, সেখানেও আমাদের মস্ত ক্ষতি হয়ে গেল। আমাদের জন্য হয়তো আর কেউ এত গুছিয়ে গল্প বলবেন না। তবুও মনে হয় দৃশ্য ও ধ্বনির সৌজন্যে গল্প নির্মাণ করাই তো স্রষ্টার একমাত্র কাজ নয়। তবে শ্যাম তাঁর অজস্র তথ্যচিত্রে সময়কে যে ধরে রাখতে হয় তাও তো জানিয়েছিলেন পরম যত্নে। তাই বা কম কী!

এই দ্বন্দ্বের নিরসণ অবশ্য মহাকাল করতে পারে, আমি নই। বিদায় শ্যাম বেনেগাল।

More Articles