একচিলতে ঘরেই কেটে গেল জীবন, এনার্জিতে আশি বছরের বৃদ্ধ বিমান লজ্জায় ফেলবেন তরুণদেরও
বিমান বসুর জীবনধারা ও সম্পত্তির খতিয়ান কি লজ্জায় ফেলবে না আজকের নেতা-মন্ত্রীদের?
'সে কী রে, প্রায় দশ কিলোমিটার হেঁটে ফেলেছেন তো! আর কতটা যাবেন!’
সালটা ২০১৬। বয়স ৭৬। মাঘের মধ্যদুপুর। চোখ-মুখ লাল। কিন্তু ক্লান্ত নন ৭৬ বছরের এই 'যুবক’। হাঁটায় তিনি তখন কাত করে দিচ্ছেন নবীনদের। সহযাত্রীদের মধ্যে উসখুস। চন্দ্রকোনা টাউন হল থেকে শুরু হয়েছিল মিছিল। দুপুর ১২টা নাগাদ কেশপুর ব্লকের মুখে।
'এবার একটু গাড়িতে উঠবেন তো?’ আমতা আমতা করে কথাটা পাড়লেন এক বয়ঃকনিষ্ঠ কমরেড। তাঁকে দাবড়ে পাকা চুল ধুতি-পাঞ্জাবি চেঁচিয়ে উঠলেন, 'বলছি কিনা পুরোটা হাঁটব।'
এরপর কেশপুরের নেড়াদেউলে আধঘণ্টাখানেক বিশ্রাম। দুই কাপ দুধ চা। ফের হন্টন। বিমান বসু থামলেন বিকাল ৩টেয়। পুরো ২১ কিলোমিটার পথ পদব্রজে পার করে গরম জলে পা ধুলেন কেশপুর পার্টির জোনাল অফিস জামশেদ ভবনে। দিনটা ছিল ৩১ জানুয়ারি। দলীয় কর্মসূচি।
আরও পড়ুন: একটা গাড়িও নেই, এক চিলতে ঘরেই জীবনটা কাটিয়ে দিলেন ‘ডাক্তারবাবু’ সূর্যকান্ত মিশ্র
বিমান বসু সেদিন হেঁটে কতটা নজির তৈরি করেছিলেন, তা ইতিহাস মনে রাখবে কি না, সেই আলোচনায় না গিয়েও বলা যায়, তাঁকে এই প্রাণশক্তি দিয়েছে তাঁর আড়ম্বরহীন জীবন। পারিবারিক বিলাস, বৈভব ছেড়ে এই সাদামাটা জীবনে তিনি ঝাঁপিয়েছিলেন মাত্র ১৭ বছর বয়সে। পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই(এম) পার্টির প্রাক্তন সম্পাদক বিমান বসু মাত্র ১৭ বছর বয়সে দলে যোগ দেন এবং ১৮ বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে দলীয় কার্যালয়ে থাকতে শুরু করেন। আজ অনেক নেতা-মন্ত্রী ট্রেড মিলে হাঁটেন। অনেকে ভুঁড়ির ভারে জুবুথুবু। সে যাই হোক, আলিমুদ্দিনের বাসিন্দার এই ফিটনেস ধরে রাখার পিছনে আসল রহস্য হলো সাদামাটা ডায়েট। মাংস নৈব নৈব চ। দুপুরে ভাতও বয়কট করেছেন অনেককাল। বিলাসিতা কোনওদিন তাঁর ডিকশনারিতে নেই।
প্রথম জীবনে বালিগঞ্জে পার্টি করতে গিয়ে দলের নেতাদের অভিজাত-সুলভ আচরণ দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ফিরে আসেন কিশোর বিমান, তারপর পার্ক সার্কাস অঞ্চল থেকে প্রথম পার্টির জন্য কাজ শুরু করেন বিমান বসু। এরপর দীর্ঘ সময় কেটেছে জঙ্গলমহলে আদিবাসীদের আন্দোলনে। এখনও বিমান বসু মানে একটু লিকার চা, শশা একটি তোয়ালে আর পার্টি। বিমান বসু একজন রাজনৈতিক সন্ন্যাসী। বিমান বসুর জীবনের শুরু থেকে শেষ, সবটাই পার্টি। পার্টি-অন্তপ্রাণ বিমান বসু থাকেনও দলের রাজ্য দফতর মুজফফর আহমেদ ভবনে। এখনও পর্যন্ত তিনি যা হাঁটেন, তাতে তিনি পিছনে ফেলতে পারেন একাধিক তরুণ-তরুণীকে। এত কিছুর পরেও রাজ্য কমিটি থেকে অবসরের পর বিমান বসুর সাফ জবাব, “কমিটি ছেড়েছি, পার্টি তো ছাড়িনি।"
রাজ্যের নানা প্রান্তে ইমারত, গ্যারেজে বিলাসবহুল গাড়ির লাইন, বছরে নিয়ম করে বিদেশ ভ্রমণ এবং অবশ্যই কালো টাকা। সঙ্গে গুছিয়ে নেওয়া। এটাই তো এই মুহূর্তে রাজ্যের নেতা মন্ত্রীদের জীবনযাপনের ডেফিনেশন। এই কনক্লুশনে আসার জন্য কারও বেশি বুদ্ধিধর হওয়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারের পর টাকার পাহাড়ের নির্লজ্জ প্রদর্শন দেখেছে রাজ্য। এরপর অনুব্রতর গ্রেফতার। পার্থকে ঝেড়ে ফেললেও অনুব্রত তৃণমূলের গলার কাঁটার মতো বিঁধে আছেন। দিদি তা না পারছেন গিলতে, না পারছেন উগরোতে। এই অবস্থায় এত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে বাম নেতাদের অনাড়ম্বর জীবনের সহজ পাঠ থেকে শিক্ষা নেবে রাজ্যের শাসক দল? উত্তর মেলা ভার।
আজ রাজ্যের যে দুর্নীতির পচা শামুকে পা কেটে রক্তাক্ত অবস্থা, তাতে বেশি করে মনে পড়ছে না কি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র এবং অবশ্যই প্রমোদ দাশগুপ্তদের কথা? বিমান বসু আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ছাদে থাকেন একটা ছোট্ট ঘরে। সারাটা জীবন সেখানেই কাটিয়ে দিলেন। তাঁকে যেসব সাংবাদিক খুব কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁরা বলেন, তিনি সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন করতেন। আলিমুদ্দিনের ছাদে যত্ন করে গাছের পরিচর্যা করতেন। সেগুলি ফুলের টব নয়, প্রচুর শাকসবজি হতো। কখনও কখনও সেইসব সবজি দিতেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং নিরুপম সেনকে। দিল্লিতে যখন যেতেন, থাকতেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পার্টি মিটিংয়ে যাওয়ার আগে নিজে ব্রেকফাস্ট বানাতেন। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে তাঁর অনুরাগের কথা অনেকের অজানা। বিমান বসু রান্না করতে খুব ভালবাসেন।
সম্পন্ন পরিবারের সন্তান বিমান বসু কমিউনিস্ট আন্দোলনের তাগিদে ঘর ছেড়েছিলেন, সেই কবে, তা আজ বিস্মৃতির অতলে। একসময় পার্টি কমিউনে থাকতেন। নিজে রেঁধে খেতেন। নিজের জামাকাপড় নিজে হাতে কাচতেন। পরে সিপিএমের পার্টি অফিস আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের একচিলতে ঘরে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন। আলিমুদ্দিনের ছাদে বাগান করেছেন। খুপরি হাতে সেই বাগানের পরিচর্চায় তাঁর অনেকটা সময় কাটে। স্মৃতি রোমন্থন করলে ছাত্রজীবনের সেই ঝোড়ো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন থেকে স্টুডেন্ট ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া। ১৯৮৫ সালে রাজ্য সম্পাদক হওয়া, আরও কত কী! হারিয়েছেন জ্যোতি বসুর মতো পথপ্রদর্শককে, কমরেড সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তীর মতো সতীর্থরা চলে গেছেন। প্রমোদ দাশগুপ্তর মতো অভিভাবক আজ স্মৃতির আড়ালে। কত যুদ্ধ, কত পথে নেমে লড়া।
বিমান বসু ৭০ বারের বেশি রক্তদান করেছেন, চিকিৎসক যখন আর রক্ত নিতে অস্বীকার করেন, তখনই তাঁকে থামতে হয়। শুধুমাত্র হেঁটে তরুণদের কাত করেন, তা নয়, আসলে সাদামাটা জীবনের আদর্শই তাঁর জিয়নকাঠি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মৌলানা আজাদ কলেজে পড়ার সময় বিমান বসু রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে যখন বিমান বসু স্কুলছাত্র, তখনই তিনি বিধানসভার উপনির্বাচনে পার্টির হয়ে প্রচারে নেমে পড়েন। ১৯৫৭ সালে বিমান বসুর নাম পার্টি সদস্য হিসেবে সুপারিশ করা হলেও তখন তা গ্রাহ্য হয়নি, কারণ তখনও বিমান বসুর বয়স ১৮ বছর হয়নি। ১৯৫৬ সালে বাংলা ও বিহার সংযুক্তিকরণের বিরুদ্ধে ও ১৯৫৯ সালের খাদ্য আন্দোলনে বিমান বসু সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে বিমান বসু প্রথম গ্রেফতার হন। এরপর অনেক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তাঁকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে যে অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়িয়েছিলেন, সেই লম্বা সফর দেখতে দেখতে হয়ে গেল কয়েক দশক। ১৯৪০ সালের ১ জুলাই জন্ম বিমানবাবুর। আজ তাঁর বয়স আটের কোঠায়। বয়সের কারণে ১১/১২ বছর ধরে ভাত খান না। খাবারের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন অনেক কিছুই।
বিমান বসুর জীবনধারা ও সম্পত্তির খতিয়ান কি লজ্জায় ফেলবে না আজকের নেতা-মন্ত্রীদের? বয়স তখন মাত্র ১৭/ ১৮। পারিবারিক বৈভব। সামনের সচ্ছল জীবনযাপনের হাতছানি। সুখের ঠিকানা। সেই ঐশ্বর্যর অংশীদার তো হতে পারতেন তিনিও। কিন্তু না, এসব তাঁকে আকর্ষণ করেনি। তাই কি বেছে নিয়েছেন কার্যত সন্ন্যাসীর মতো জীবন? কাটিয়েছেন দলীয় কার্যালয়ের চিলেকোঠায়? আন্দোলন থেকে উঠে এসেছেন বলেই কি গাড়ি, বাড়ি করার দায় ছিল না তাঁর? আলিমুদ্দিনের আনাচকানাচে ঢুঁ মেরে বিমান বসুর সম্পত্তির খবর নিতে হলে, হয়তো কোনও অকিঞ্চনকেও লজ্জায় পড়তে হবে। একবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছিলেন বিমান বসুর অ্যাকাউন্টে ১৬ কোটি টাকা আছে। তদন্তের দাবি করেন তিনি। এখন তাঁর সরকারই দুর্নীতির পাঁকে হাবুডুবু খাচ্ছে। প্রশ্ন ওঠে, মমতা সুযোগ পেয়েও কেন তা প্রমাণ করলেন না?
বিমান বসু নিজের কাজ নিজে করে চলেছেন। এটাই তাঁর ট্রেডমার্ক। অনাড়ম্বর, সাদামাটা জীবনের ট্রেডমার্ক। আর এদিকে গ্রেফতারের পর জানা গেছে, পার্থকে নাকি স্নান করিয়ে দিতে হয়। মোদ্দা কথা হলো বিমান বসুরা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে সাজানো বাগান তৈরি করেছেন, আজ কি তা মাড়িয়ে যাওয়ার সময়? বিমান বসুর জীবনাদর্শ কি হতে পারে না দুর্নীতির পাতালঘরে প্রবেশ করা একটা সরকারের কাছে সহজ পাঠ?