‘কই আপনার কার্ড দেখি?’ ভয় ছড়ানোর নতুন মুখ বাংলার সংবাদমাধ্যম?
SIR in Bengal: 'একের পর বস্তিতে অনুপ্রবেশকারী! কবে বুলডোজার চলবে?'— এই শিরোনামে প্রাইম টাইম শো করা হচ্ছে। এই ধরনের সংবাদ পরিবেশন সাধারণ মানুষের মনে অস্থিরতা তৈরি করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের এসআইআর (Special Intensive Revision) চালু হতেই সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ের আবহ তৈরি হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের দাবি, এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য হলো পুরনো তথ্য সংশোধন করা, মৃত ভোটারের নাম বাদ দেওয়া এবং নতুন ভোটারদের যুক্ত করা। কিন্তু বাস্তবে এই প্রক্রিয়াকেই ঘিরে এখন রাজ্যে তৈরি হয়েছে তীব্র ভয়ের পরিবেশ। তবে প্রশ্ন উঠছে, এই ভয়টা কি স্রেফ নথি থাকা না থাকা? নাকি ভয় ধরাচ্ছে, ভয় ছড়াচ্ছে বাংলার সংবাদমাধ্যম?
রাস্তাঘাটে, বাজারে, দোকানে— হঠাৎ কেউ বুম হাতে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করছে, “কই আপনার কার্ড দেখি?” এই এক বাক্যেই তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক। ভোটার তালিকা সংশোধনের আড়ালে এখন ভয় ছড়াচ্ছে কিছু সংবাদমাধ্যম। শুধু তাই নয়, গত কয়েক সপ্তাহে টিভি ডিবেট, ওয়েব নিউজ ও সোশ্যাল মিডিয়ার একাংশে এমন সব শিরোনাম ছড়িয়েছে—
•“নাম মুছে দিচ্ছে কমিশন!”,
•“কার্ড নেই মানে দেশছাড়া!”,
•“বাংলাদেশিদের খোঁজে অভিযান শুরু”
শুধু তাই নয়, 'একের পর বস্তিতে অনুপ্রবেশকারী! কবে বুলডোজার চলবে?'— এই শিরোনামে প্রাইম টাইম শো করা হচ্ছে। এই ধরনের সংবাদ পরিবেশন সাধারণ মানুষের মনে অস্থিরতা তৈরি করেছে। অনেক প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে, যথাযথ তথ্য যাচাই না করেই নাটকীয় শিরোনাম ও চমকপ্রদ শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। এক কথায় বললে চরম দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার পরিচয় দিচ্ছে বাংলার সংবাদমাধ্যম।
আরও পড়ুন
এসআইআর: ভোটের আগে ‘ব্র্যান্ড মমতা’র হাতে চাঁদ?
সম্প্রতি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে, মূলত রাজারহাট ও নিউ টাউনের কিছু এলাকার তালা ঝোলানো বাড়ির দৃশ্য দেখিয়ে দাবি করা হচ্ছে— “বাংলাদেশিরা ভয়ে ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে”। কিন্তু বাস্তবেই কি তাই? হতেই পারে যেসব বাড়িতে তালা দেখা যাচ্ছে, সেগুলির মালিক বা ভাড়াটেরা অনেকে কাজের সূত্রে অন্যত্র গিয়েছেন বা বহুদিন ধরেই সেখানে থাকেন না বা সেই মুহূর্তেই ঘরে নেই। ফলে যেসব দৃশ্য ‘পালিয়ে যাওয়া’র প্রমাণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, সেগুলির পেছনের প্রেক্ষাপট যাচাই না করেই প্রচার করা হচ্ছে, আর তাতেই বাড়ছে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক।
শিরোনাম করা হচ্ছে—
•'অনুপ্রবেশকারীদের ঘাঁটি'
•'রাজারহাটে গিজগিজ করছে অনুপ্রবেশকারীরা!'
•'(সংবাদমাধ্যমের নাম) একের পর এক অন্তর্তদন্ত'
•'সল্টলেকে বাংলাদেশি ডেরা'
•'অন্তর্তদন্তে পর্দাফাস'
বীরভূম, মালদহ বা নদিয়ার মতো সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে মানুষের উদ্বেগ বারবার সংবাদ শিরোনামে উঠে আসছে। বৃদ্ধ মানুষ থেকে শুরু করে যুবক-যুবতীরা পর্যন্ত ভোটার তালিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। বেশ কিছু মৃত্যুর ঘটনাও শিরোনাম হয়েছে। রাজনৈতিক দলের স্বার্থ চরিতার্থ করতে বাজারে নামা সংবাদমাধ্যমের একাংশ এই পরিস্থিতি ভয়ের মাত্রা যেন আরও বাড়িয়ে দিতে চাইছে। ফিল্ড ওয়ার্কে গিয়ে রিপোর্টার সাধারণ মানুষকে প্রশ্ন করে বসছে— “কই আপনার কার্ড দেখি?” প্রশ্ন হলো এর নাম কি রিপোটিং? রিপোটার কি আদৌ কারও নথি দেখতে চাইতে পারে?
সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য এসআইআর বিতর্ক ও মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি ইনস্ক্রিপ্ট-কে জানান,
“বাংলার মানুষ এই গোদি মিডিয়া, বাজারি মিডিয়া এবং মেরুকরণ করতে চাওয়া বিজেপি-কে ২০২৬ সালের নির্বাচনে উপযুক্ত শিক্ষা দেবে। শুভেন্দু অধিকারীদের এখনই পালানোর জায়গা ঠিক করে রাখা উচিত, কারণ সেই সময় হেলিকপ্টারে করেও পালানো যাবে না। হাসিনা যেমন একসময় দিল্লি এসেছিলেন, তেমন সুযোগও এরা পাবেন না।”
তিনি আরও বলেন,
“এই গোদি মিডিয়া আর গেরুয়া শিবিরের নেতারা এসআইআর-এর নামে ভয় ছড়াচ্ছেন, গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করছেন। প্রশ্ন হলো— এই মিডিয়া কি এখন তদন্ত সংস্থা? তারা কি নাগরিকদের বাবা-মায়ের কাগজ দেখতে চাওয়ার অধিকার রাখে?"
তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন,
“নরেন্দ্র মোদি কি নিজের বাবা-মায়ের কাগজ দেখিয়েছেন? নিশীথ প্রামাণিক কি দেখিয়েছেন?”
সুমন ভট্টাচার্যের দাবি,
“কোন চ্যানেলের মালিক কার কাছ থেকে টাকা নেয়, কোন ইউটিউব প্ল্যাটফর্ম কার স্বার্থে কাজ করে— বাংলার মানুষ সব জানে। সময় এলে তারাই জবাব দেবে।”
তিনি শেষে নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে সম্প্রতি জয়ী হওয়া জোহরন মানদানির-র উদাহরণ টেনে বলেন,
“যেমন মামদানি বলেছেন— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীদের দেশ, তেমনই ভারতও সংবিধান অনুযায়ী সব ধর্ম, সব মানুষের দেশ— হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সকলের।”
আরও পড়ুন
এসআইআর বিরোধী আন্দোলন কি তৃণমূলকে শক্তি বাড়াতে সাহায্য করবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,
“‘গোদি মিডিয়া’ বলতে যাদের বোঝানো হয়, তাঁরা আসলে সাংবাদিকতার কাজ করেন না। তাঁরা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রচার চালান। এসআইআর আসলে ঘুরপথে এনআরসি, আর এটা কার রাজনৈতিক প্রকল্প— তা আমরা সবাই জানি। যাঁরা নিজেদের সাংবাদিক বলে দাবি করেন কিন্তু আসলে রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রচার চালান, তাঁদের কাজকে সাংবাদিকতা বলা যায় না। এ কথা তাঁরা যেমন জানেন, আমরাও তেমন জানি।”
তিনি আরও বলেন,
“বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সাধারণ মানুষের কাগজপত্র দেখতে চাওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেটি সাংবাদিকতার আওতায় পড়ে না। এভাবে ‘কার্ড দেখি’ বলা বা ভয় তৈরি করা তাঁদের এক্তিয়ারের বাইরে।”
অনির্বাণের কথায়,
“যারা ফিল্ডে গিয়ে সত্যিই রিপোর্টিং করছেন, তাঁরা হয়তো বাধ্য হচ্ছেন এই কাজ করতে। কিন্তু তাঁদের উচিত একটু রুখে দাঁড়ানো। না হলে, মানুষ যখন রুখে দাঁড়াবে, তখন আর পালানোর পথ থাকবে না।”
বাংলাপক্ষের সম্পাদক গর্গ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য বিষয়টিকে বাঙালি বনাম বাংলাবিরোধী শক্তির লড়াই হিসেবেই দেখছেন। তাঁর কথায়,
"আজ থেকে কয়েক বছর আগেই আমরা দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও সাধারণ মানুষ বাঙালিদের কাছ থেকে কাগজ দেখতে চাইছেন। এখন সেই একই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেও ঘটছে। বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট— যদি বাংলার মানুষকে কাগজ দেখাতে হয়, তাহলে আমরাও জানতে চাইব, যারা বাংলায় থাকেন কিন্তু বাংলায় কথা বলেন না, তাঁদের কাগজ কোথায়?"
তিনি আরও বলেন,
"আইনের চোখে ‘সংবাদ মাধ্যম’ বলে কারও আলাদা অধিকার নেই। সাধারণ মানুষ কাগজ দেখতে চাইলে সাংবাদিকরাও দেখতে চাইতে পারেন আইন সবার জন্য সমান।"
উল্লেখ্য, এখন এসআইআর ঘিরে আতঙ্কের এই আবহে সবচেয়ে প্রয়োজন স্পষ্ট ও দায়িত্বশীল তথ্য প্রচার। বিশ্লেষকদের মতে, সংবাদমাধ্যমের কাজ হলো প্রশ্ন তোলা, ভয় বাড়ানো নয়। অন্যথায়, “কই আপনার কার্ড দেখি” বলার এই আস্ফালন কেবল ভয় নয়, গণতন্ত্রের প্রতি অবিশ্বাসও তৈরি করবে— যা শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যমের নিজের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে।

Whatsapp
