নোটবন্দির ছ'বছর পরেও ভারতে কালো টাকার রমরমা
নতুন নোট ছাপতে খরচ হয়েছিল ২১,০০০ কোটি টাকা। এবার সবকিছু যোগ যদি করা যায়, তাহলে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ লক্ষ কোটি টাকায়। যার জেরে দেশের অর্থনীতিকে এখনও ভুগতে হচ্ছে।
"আমি দেশের মানুষের কাছে পঞ্চাশ দিন সময় চেয়েছি। যদি ডিসেম্বর ৩০-এর পর আমার কাজে আপনারা কোনও খামতি পান, বা যদি মনে করেন আমার উদ্দেশ্য ভালো নয়, তাহলে দেশবাসী আমাকে যা শাস্তি দেবেন, আমি মাথা পেতে নেব।" কথাগুলো বলেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ৮ নভেম্বর, ২০১৬।
কালো টাকা, সন্ত্রাসবাদ, জাল নোট, দুর্নীতি। দেশের এই চার শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করতে আজ থেকে প্রায় ছয় বছর আগে নোটবন্দি ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। রাতারাতি ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল হয়ে গিয়েছিল। গোটা দেশ দাঁড়িয়ে পড়েছিল লাইনে। আতান্তরে পড়েছিলেন দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখা গিয়েছিল বহু মানুষকে, কারণ বাতিল হয়ে যাওয়া নোট তাঁরা পাল্টে নিতে পারেননি, এবং সেই নোট কোনও হাসপাতাল গ্রহণও করেনি। সরকারি নথি বলছে, পুরো প্রক্রিয়ায় মারা গিয়েছিলেন চার জন। কিন্তু বিভিন্ন রিপোর্টে উঠে এসেছে যে, এই নোটবন্দির কারণে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ১৫০ জন। ধসে পড়েছিল দেশের অর্থনীতি। আরও অনেক বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তার আগে দেখে নেওয়া যাক, দেশবাসীর এত কষ্ট, ত্যাগ, লাঞ্ছনার ফল কি পাওয়া গেল? দেশ কি মুক্ত হল জাল নোট থেকে?
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে দু'দিন আগে। সেই রিপোর্ট বলছে, ২০২১-'২২ অর্থবর্ষে জালনোটের সংখ্যা বেড়েছে ১০.৭ শতাংশ। সবথেকে চাঞ্চল্যকর বিষয় হল, পাঁচশো টাকার নোট জাল হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে ১০২ শতাংশ।
আরও পড়ুন: দেশের নব্বই শতাংশের রোজগার এতটা নিচে! সরকারি নথিতে স্পষ্ট ভারতের অর্থনীতির চেহারা
দু'হাজার টাকার নোট জাল হয়েছে ৫৫ শতাংশ বেশি। আরবিআই-এর বার্ষিক রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, জাল নোট সবথেকে বেশি ধরা পড়েছে ব্যাঙ্কগুলিতে, ৯৩.১ শতাংশ এবং ৬.৯ শতাংশ আরবিআই-তে। আর একটু বিশদে এই বিষয়ে জানা যাক।
২০২০-'২১ অর্থবর্ষে জাল নোটের সংখ্যা কমলেও সেই সাফল্য ধরে রাখা যায়নি। সেই অর্থবর্ষের ২,০৮,৬২৫টি জালনোট থেকে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৩০,৯৭১টি নোটে।
এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, শুধু ৫০০ এবং ২০০০-এর নোটই নয়, দশ, কুড়ি এবং দুশো টাকার নোটও প্রচুর পরিমাণে জাল হয়েছে।
২০১৬ সালে নোটবন্দি ঘোষণার দু'-বছর পরে রিপোর্ট আসে যে, ডিমনিটাইজড নোটের ৯৯.৩ শতাংশই রিজার্ভ ব্যাঙ্কে ফেরত চলে এসেছে। যেখানে বিশেষজ্ঞদের দাবি ছিল যে, প্রায় তিরিশ শতাংশ নোট কালো টাকার রূপে দেশে ছড়িয়ে আছে। তারা আশা করেছিলেন, সেই তিরিশ শতাংশ আর কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কাছে ফিরবে না। এমনকী, এসবিআই-ও দাবি করেছিল যে, ১৫.৪৪ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের নোট ব্যাঙ্কে ফিরবে না।
কিন্তু তাদের এই প্রত্যাশা তো পূরণ হলো না? ১৫.৪৪ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে ১৫.৩১ লক্ষ কোটি টাকার নোট ফেরত চলে এল। পড়ে রইল মাত্র ১৩,০০০ কোটি টাকা। সেই টাকার মধ্যে বেশ কিছু টাকা আছে নেপাল এবং ভুটানে, যা ভারত সরকার ফেরত নিতে পারেনি। প্রবাসী ভারতীয়দের কাছে বেশ কিছু টাকা আছে, যা ফেরত দিতে তাঁরা আসেননি। খুব কমসংখ্যক হলেও ছিল দেশের প্রান্তিক, দরিদ্র মানুষের কাছে, যা তাঁরা ফেরত দিতে পারেননি। এবং সবথেকে মজার হল, মন্দিরের প্রণামী। হ্যাঁ, দেশের হাজার হাজার মন্দিরে ভক্তদের দেওয়া টাকা রয়ে গেছে, যা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
জাল নোটের বিষয়ে তো পড়লেনই। একটু যদি পিছনের দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে যে নোটবন্দির কিছু দিনের মধ্যেই বাজারে ২০০০ টাকার জাল নোট ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৭ সালের জুন মাসের মধ্যে এগারো কোটি টাকারও বেশি জাল নোটের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। এটা সরকারি হিসেব। বেসরকারি কত হবে, তাহলে আপনারা নিজেরাই বুঝে নিন। অর্থাৎ জাল নোটের বিরুদ্ধে সরকারের 'লড়াই' যে একেবারেই বিফলে গেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এছাড়াও তাদের সন্ত্রাসবাদ দমনের যে দাবি ছিল, তাতেও সরকার ডাহা ফেল। নোটবন্দির এক মাসের মধ্যেই আসাম, কাশ্মীর এবং নাগরোটায় সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়।
সবথেকে বড় বিষয় হল, যে দুর্নীতি এবং কালো টাকার বিরুদ্ধে হামলা করেছিল সরকার, সেখানে এত বড় ব্যর্থতার কারণ, কালো টাকা শুধু নোটের মধ্যে তো সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং সেই সংখ্যা অনেকটাই কম। বেশিরভাগ মানুষই কালো টাকা রাখেন সম্পত্তির রূপে। বাড়ি, সোনা, গাড়ি, জমি এই সবের রূপে, বা বিদেশে। নোটবন্দিতে কোনও দিশাই ছিল না সেইসব দিকগুলির প্রতি নজর দেওয়ার।
শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নোটবন্দির পুরো প্রক্রিয়ায় মানুষের ঠিক কতটা হয়রানি হয়েছিল। এবার আরও একটু তলিয়ে দেখা যাক।
নোটবন্দির প্রথম পঞ্চাশ দিনে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয় ১.২৮ লক্ষ কোটি টাকা। প্রথম চার মাসে চাকরি যায় পনেরো লক্ষ মানুষের। জিডিপির হার বৃদ্ধি কমে যায় ২.২ শতাংশ। ক্ষতির খতিয়ান আরও আছে। নতুন নোট ছাপতে খরচ হয়েছিল ২১,০০০ কোটি টাকা। এবার সবকিছু যোগ যদি করা যায়, তাহলে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ লক্ষ কোটি টাকায়। যার জেরে দেশের অর্থনীতিকে এখনও ভুগতে হচ্ছে। আর্থিক বৃদ্ধির গতি এখনও খুবই ধীর।
পঞ্চাশ দিন পেরিয়ে কেটে গেছে ছয় বছর। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের প্রতিশ্রুতি কবে রাখবেন?