মুসলিম মেজরের তৈরি স্লোগান আগুন জ্বেলেছিল ভারতবাসীর মনে, স্বাধীনতার অজানা ইতিহাস
এইসব স্লোগানে নিহিত রয়েছে ভারত আত্মাকে জাগরিত করার অমোঘ মন্ত্র, যা স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উৎসবে শুধু স্মরণ করার নয়, সেই সঙ্গে দেশের অস্থি-মজ্জায় মিশে থাকা রক্তক্ষয়ী মন্ত্রর নাম- 'স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার’।
স্বাধীনতা মানে আবেগ। এর সঙ্গে জড়িয়ে অসংখ্য শহিদের আত্মবলিদানের ইতিহাস। আজ দেশ স্বাধীনতার 'অমৃত মহোৎসব’ পালন করছে। ইসরো মহাকাশে ওড়াচ্ছে তিরঙ্গা। দেশ সেজে উঠেছে তিরঙ্গায়। মূল্যবৃদ্ধির ছ্যাঁকাকে সাবধানে একপাশে সরিয়ে রেখে দোকানে দোকানে জাতীয় পতাকা কেনার হিড়িক। নিজেকে দেশপ্রেমিক প্রমাণ করার দায় তো রয়েইছে! এই আবহে দেশের ২০০ বছরের ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে নানা কাহিনি উঠে আসছে স্মৃতিপটে। সেই সঙ্গে হয়তো মনে পড়ে যাচ্ছে রক্ত গরম করা সেই সব স্লোগান। নেতাজির সেই ডাক- 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। সেই ডাকেই তো সাড়া দিয়ে দেশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আন্দোলনে। আজ দেশ যে উৎসবের মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে, তার ক্ষেত্র একদিন তৈরি করে দিয়ে গেছেন অগণিত শহিদ। তাঁদের তৈরি পথেই অবাধে বিচরণ করছেন আজকের নাগরিকরা। আজ কি এই দেশের বুকে কান পাতলে শোনা যায় না সেইসব স্লোগান?
নেতাজির 'জয় হিন্দ'
১৯৪৩ থেকে '৪৫ সালে জাপানের সাহায্যে যখন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা আইএনএ-র পুনর্গঠন করলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, তখন তিনি সেনাবাহিনীর অভিবাদনের জন্য এমন কিছু স্লোগান চেয়েছিলেন, যার মধ্যে মিশে থাকবে ভারতীয় গন্ধ। অনেকে তাঁকে নানারকম স্লোগানের সুপারিশ করেন। তখনই হায়দরাবাদের তৎকালীন জেলাশাসকের ছেলে জৈন-উল-আবেদিন হাসান নেতাজির কাছে 'জয় হিন্দ' স্লোগান লিখে নিয়ে যান। যা সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয়। আইএনএ-র মেজর ছিলেন আবেদিন। অভিযোগ, আজ বিজেপি এই স্লোগান ধার করে হাওয়া গরম করার চেষ্টা করে। কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। এই স্লোগান প্রথম দিয়েছিলেন নেতাজি, যাঁর সেনাবাহিনীতে ছিলেন বিভিন্ন ভাষাভাষি, অঞ্চল এবং ধর্মের মানুষ। যার প্রমাণ, এক মুসলিম মেজরের লেখা 'জয় হিন্দ’ স্লোগান।
নেতাজির 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি স্বাধীনতা দেব’
আসমুদ্রহিমাচল কাঁপিয়ে নেতাজি ডাক দিয়েছিলেন, 'তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’। তাঁর মুক্তিমন্ত্রে জেগে উঠেছিল সমগ্র উপমহাদেশ। কিন্তু ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে অবাঙালি নেতাদের কারণে তিনি উপলব্ধি করেন, দেশে থেকে স্বাধীনতা আনা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর শুরুর দিকে তিনি বিদেশে পাড়ি জমান। বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, বিশ্বযুদ্ধর সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজদের তাড়াতে হবে।
আরও পড়ুন: গান্ধীজির ইচ্ছায় তৈরি হলো স্বদেশি কালি, স্বাধীনতার ৭৫-এ অনুপ্রেরণা হতে পারে সুলেখা
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'বন্দে মাতরম'
ভারত-আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে আজও প্রতিধ্বনিত হয় বন্দে মাতরম। ১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত একটি গান এই 'বন্দে মাতরম'। এটি ভারতমাতার বন্দনাগীতি। ঋষি অরবিন্দ বন্দে মাতরম গানটিকে বঙ্গদেশের জাতীয় সংগীত বলে উল্লেখ করেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই গানটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৮৯৬ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গওয়া হয় বন্দে মাতরম। গানটি পরিবেশন করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ১৯৫০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের `জনগণমন অধিনায়ক...’ জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করলে বন্দে মাতরম গানটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় স্তোত্রের মর্যাদা দেওয়া হয়।
মৌলানা হরসৎ মোহনীর 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ’
সুপরিচিত যেসব ঐতিহাসিক স্লোগান আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। খুঁজে দেখলে জানা যাবে, এটি কিন্তু আসলে পার্সি শব্দবন্ধ। ১৯২১ সালে উর্দু কবি তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা মৌলানা হরসৎ মোহনী এটিকে প্রথম স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করেন। এর অর্থ হলো, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। পরবর্তীতে ভগৎ সিং তাঁর বক্তৃতা ও লেখার মাধ্যমে এই স্লোগানকে জনপ্রিয় করে তোলেন। ১৯২১ সালের জুন মাসে দিল্লি হাই কোর্টে এই স্লোগান ধ্বনিত হয়। এই স্লোগান বহু বিপ্লবীকে বিপ্লবে অংশ নিতে উজ্জীবিত করে।
বিসমিলের 'সারফারোশি কি তামান্না’
১৯২৭ সালের ডিসেম্বরে একজন ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, "I wish the downfall of the British Empire.’’ তিনি কাকোরির ঘটনার অন্যতম নায়ক শহিদ রামপ্রসাদ বিসমিল। ৩০ বছর বয়সে তিনি দেশের জন্য প্রাণ দেন। রেখে যান একটি দেশাত্মবোধক গান, 'সারফারোশি কি তামান্না...’। স্বাধীনতার এত বছর পরেও ভারতের শিরায়-ধমনিতে প্রতিধ্বনিত হয় এই কথাগুলো, সারফারোশি কি তামান্না।
গান্ধীজির 'ডু অর ডাই’
১৯৪২ সালের ৮ অগাস্ট মহাত্মা গান্ধী জাতীয় কংগ্রেসের বম্বে অধিবেশনে 'ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। এই আন্দোলনটাই ব্রিটিশ শাসনের কফিনে শেষ পেরেক। আন্দোলনের শুরুতে গান্ধীজি 'ডু অর ডাই’ স্লোগান দিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছিলেন, ব্রিটিশকে অবিলম্বে ভারত ত্যাগ করতে হবে, না হলে পরিণতি হবে মারাত্মক। কারণ গান্ধীজির ডাকে সেদিন দেশ নেমে এসেছিল রাস্তায়। তাঁদের মুখে তখন, করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে, দেশকে স্বাধীন করার মূল মন্ত্র।
ব্রিটিশরা সেদিন ভেবেছিল, নেতা না থাকলে বিপ্লব ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। আন্দোলন দমন করা যাবে সহজেই। তাদের ধারণা অচিরেই ভুল প্রমাণিত হয়। তারা অনুভব করতে পারেনি যে, ভারতীয়দের মধ্যে জ্বলতে থাকা স্বাধীনতার আগুন উসকে দিয়েছিলেন নেতারা। তাঁদের দেওয়া স্লোগানে ভর করে দেশ জেগে উঠেছিল। জাগ্রত হয়েছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। ভারতের বুকে লেখা হয়েছিল 'সত্যমেব জয়তে’-র মতো স্লোগান। যার উল্লেখ মেলে মুণ্ডক উপনিষদে। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন বালগঙ্গাধর তিলক বলেন, "স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার..।‘’
এইসব স্লোগানের তালিকা তৈরি করতে বসলে তা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, বলা মুশকিল। তবে একটা কথা বলাই যায়, এইসব স্লোগানে নিহিত রয়েছে ভারত আত্মাকে জাগরিত করার অমোঘ মন্ত্র, যা স্বাধীনতার ৭৫ বছরের উৎসবে শুধু স্মরণ করার নয়, সেই সঙ্গে দেশের অস্থি-মজ্জায় মিশে থাকা রক্তক্ষয়ী মন্ত্রর নাম- 'স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার’।

Whatsapp
