একদিন আমিও স্মৃতি মন্ধনা হব
Smriti Mandhana: ওয়ান ডে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হোক বা টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা টেস্ট ক্রিকেট, স্মৃতির রেকর্ড সর্বত্র। তিন ফরম্যাটেই তাঁর নাম জড়িয়ে আছে একাধিক বিশ্বরেকর্ডের সঙ্গে।
সূর্য তখন মুম্বইয়ের ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে ঢলে পড়ছে। স্ট্যান্ডে হাজার মুখ আর বাতাসে উত্তাপ। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতীয় মেয়েদের স্কোরবোর্ডে তখন শূন্য উইকেটে ১৯০ রান। মাঠের মাঝে এক শান্ত, স্থির চোখ, মুখে আত্মবিশ্বাস। বোলার দৌড়ে এসে বল ছুঁড়তেই গ্যালারিতে গর্জে উঠল একটা নাম। ঠিক যেমনটা হত সচিন ব্যাট হাতে ক্রিজে দাঁড়ালে। মহারাষ্ট্রের ছোট শহর সাংলির ধুলো মাখা মাঠ থেকে এই মাইলফলকে পা দেওয়া সেই আত্মবিশ্বাসী মেয়েই স্মৃতি, স্মৃতি মন্ধনা।
১৯৯৬ সালের ১৮ জুলাই মুম্বইতে জন্ম হলেও বেড়ে ওঠা মহারাষ্ট্রের সাংলিতে। বাবা শ্রীনিবাস মান্ধানা ছিলেন জেলা স্তরের ক্রিকেটার, ভাই শ্রবণও খেলতেন। বাড়ির উঠোনেই চলত অনুশীলন,বাবা বল করতেন, ভাই কিপিং, আর মাঝখানে বাম হাতে ব্যাট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত ছোট্ট স্মৃতি। নয় বছর বয়সে অনূর্ধ্ব–১৫, এগারো বছরেই অনূর্ধ্ব–১৯ দলে ডাক পান তিনি। এক ধরনের নীরব জেদ, ততোধিক লুকনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাকে চালিত করত। খেলার প্রতি এই টানই ক্রমশ তাঁকে পৌঁছে দেয় জাতীয় দলে। ২০১৩ সাল। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ভারতের জার্সিতে প্রথম আন্তর্জাতিক অভিষেক। সেই বছরেই গুজরাটের বিরুদ্ধে ঘরোয়া একদিনের ম্যাচে ১৫০ বলে ২২৪ রান,ভারতের প্রথম মহিলা হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি। ক্রিকেট মহল চমকে গিয়েছিল। এক অচেনা সকালে গোটা দেশের ক্রীড়ামন এক নতুন নাম চিনল, স্মৃতি মন্ধানা।
সেই থেকেই শুরু স্বপ্নযাত্রার । ২০১৭ সালের বিশ্বকাপে তাঁর ৯০ রানের ইনিংস ভারতকে পৌঁছে দেয় ফাইনালে। ২০১৮-তে আইসিসির বর্ষসেরা ক্রিকেটার, ২০১৯-এ নিউজিল্যান্ডের মাটিতে শতরান, ২০২১-এ অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ব্যাটিংয়ের নৈপুণ্যে অপরাজেয় দৃঢ়তা। ২০২৩ সালে জায়গা পেলেন আইসিসি উইমেনস টি-টোয়েন্টি টিম অব দ্য ইয়ারে। আর ২০২৪ এ নিজের নেতৃত্বে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুকে এনে দিলেন প্রথম উইমেন প্রিমিয়ার লিগ ট্রফি। অধিনায়িকা হিসেবে তিনি যেন ক্রিকেটের বুদ্ধ । তরুণ ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়িয়ে বলতেন, “খেলো নিজের ছন্দে, ভয় পেও না।” তাঁর নেতৃত্বের ভিতর মিতালি রাজের মতো স্থিরতা ছিল, ছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো হৃদয় নিংড়ে লড়ে যাওয়ার মনোভাব।
আরও পড়ুন-ব্রিটিশদের গুঁড়িয়ে দিয়ে বিশ্বজয়, ‘আমরাই পারি’ প্রমাণ করে দেখাল ভারতের শেফালি, তিতাসরা
২০২৫ সালে উইজডেনের বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মহিলা ক্রিকেটার খেতাব আসে মন্ধনার ঝুলিতে। চোট, ব্যর্থতা আর কঠিন সময়ের মধ্যেও কখনও হার মানেননি তিনি। ভারতের ওপেনিং ব্যাটিংকে নতুন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেছেন। স্মৃতির ব্যাট যেন প্রতিবারই বলে, “আমি এখনও এখানে আছি, আরও উঁচুতে উঠব।”
ওয়ান ডে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হোক বা টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা টেস্ট ক্রিকেট, স্মৃতির রেকর্ড সর্বত্র। তিন ফরম্যাটেই তাঁর নাম জড়িয়ে আছে একাধিক বিশ্বরেকর্ডের সঙ্গে।
যেদিন সূর্য মুম্বইয়ের ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে ঢলে পড়ছে। গ্যালারি জুড়ে গর্জে উঠল স্মৃতি, স্মৃতি, স্মৃতি। এক অসাধারণ শতক। তাঁর ৯৫ বলে ১০৯ রানের ইনিংস যেন ইতিহাসের অধ্যায়। প্রীতিকা রাওয়ালের সঙ্গে গড়া ২১২ রানের উদ্বোধনী জুটি নতুন ভারতের ক্রিকেট স্বপ্নের প্রতীক। সেই দিনেই তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে পার করেন ৫,১৮৬ রান, আর বছরের শেষে ১,২৫৯ রানে করে উঠে আসেন বিশ্বের এক নম্বর ওপেনার হিসেবে।
সংখ্যা কাহিনির সবটুকু বলে না। স্মৃতির আসল শক্তি তাঁর ধৈর্যে, তাঁর প্রত্যাবর্তনে, তাঁর বিশ্বাসে। চোট, ব্যর্থতা, ক্লান্তি— প্রতিটি অধ্যায় থেকে তিনি ফিরে এসেছেন আরও উজ্জ্বল হয়ে। প্রাক্তন অধিনায়ক মিতালি রাজ একবার বলেন, “স্মৃতি শুধু রান করে না, সে দলে আত্মবিশ্বাস ঢেলে দেয়।” ছোট শহরের মেয়ের এই আত্মবিশ্বাস আজ ভারতের মহিলা ক্রিকেটকে নতুন দিগন্ত দিয়েছে। প্রতিটি ইনিংস, প্রতিটি স্ট্রোক যেন বলছে— স্বপ্ন কখনো ছোট হয় না, চেষ্টা থাকলে সব সম্ভব।
বাঁ-হাতি এই ব্যাটারের ব্যাটে শুধু বলের শব্দ নয়, বাজে এক সুর, যা স্বপ্নের, পরিশ্রমের, চেষ্টার গল্প বলে। প্রতিটি বাউন্ডারি যেন মেয়েদের মনে নতুন আশা জাগায়। তিনি চান মেয়েরা ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে ভাবুক। শুধু রান নয়, সেই বিশ্বাসটাই দিতে চান তিনি। প্রতিটি ভোরে প্র্যাকটিসের জন্য উঠে যাওয়া, তরুণ খেলোয়াড়দের শেখানো, দলের পাশে থাকা— এই সবই প্রমাণ করে তিনি শুধু খেলোয়াড় নন, তিনি এক প্রজন্মের আস্থা, এক প্রজন্মের প্রেরণা। যে মাঠে শুরু হয়েছিল ধুলো-মাখা ব্যাটিং, আজ সেই একই মাঠে জ্বলছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আলো, আর সেই আলোয় অনুপ্রাণিত হচ্ছে অসংখ্য মেয়েরা, যারা বলছে—“একদিন আমিও স্মৃতি মন্ধনা হব।”
Whatsapp
