বিনিয়োগ টানতে ১০০ ট্রিলিয়নের তাস! নরেন্দ্র মোদির ভারত কি পারবে চিনকে টেক্কা দিতে?

PM Narendra Modi: ১৯৮০ বা ২০১০ সালে বাণিজ্যিক উন্নতির জন্য যে পথ বেছেছিল চিন বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বেশিরভাগ দেশগুলি যে বাণিজ্যিক মডেল মেনে চলেছিল ঠিক সেইভাবেই ভারতের বাণিজ্যিক মডেল প্রস্তুত করা হবে।

ডোকালাম সীমান্ত থেকে লাদাখ কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক সব ক্ষেত্রেই ভারত চিন বোঝাপড়া শেষ কয়েক বছরে অনেকটাই তলানিতে এসে ঠেকেছে। এশিয়া মহাদেশে যত নিজের প্রতিপত্তি ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটাতে শুরু করেছে চিন, ততই বিরোধিতার পথে হেঁটেছে ভারত। ইউরোপ বা আমেরিকার বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলির কাছে বিক্রির জন্যে ভারতের বাজার গুরুত্বপূর্ণ হলেও জিনিস নির্মাণ ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চিনের প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে বিদেশি কোম্পানিগুলি। কিন্তু করোনা পরবর্তী সময়ে আমেরিকা ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সঙ্গে ও চিনের বাণিজ্যিক সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে সক্রিয় হয়েছে ভারত। ভারতের বাজারে বিদেশি বিনিয়োগের রাস্তা প্রশস্ত করতেই উদ্যোগী হয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

মোদির এই ভাবনা থেকেই ভারত সরকার তৈরি করেছে প্রধানমন্ত্রী গতি শক্তি যোজনা। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য সরকারের ১৬ টি মন্ত্রককে একত্রিত করে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যা বিভিন্ন প্রকল্পের গতি বৃদ্ধিতে এবং দ্রুত প্রকল্পের বিকাশের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এই খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ১০০ ট্রিলিয়ন অর্থ। এই প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রকের বক্তব্য, “এই মিশনের লক্ষ্য হল, বাজেট মেনে সময়ের মধ্যে যে কোনও সরকারি প্রকল্পকে সুষ্ঠু ভাবে রূপায়ণ করা। ভারত যদি এই নজির তৈরি করতে সক্ষম হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ভারতকে তাদের উৎপাদন ক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্ব প্রদান করতে শুরু করবে।”

ভারতের ক্ষেত্রে যে কোনও সরকারি প্রকল্পের রূপায়ণের ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হল সময়। দেখা যাবে চারটি সরকারি প্রকল্পের মধ্যে হয়তো একটি প্রকল্প রূপায়ণ করতে গিয়ে বরাদ্দ অর্থের হিসেব অতিক্রম করে গেছে আর বাকি তিনটি এখন ও অর্ধেকের বেশি বাকি অবস্থায় পড়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মোদির ধারণা পরিকাঠামোর উন্নয়ন ও সঠিক প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমেই এই ধরনের সমস্যাগুলির মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে ভারত।

আরও পড়ুন- সৌজন্য না কৌশল? যে কারণে মোদি-বিরোধিতার সুর নরম করছেন মমতা

প্রধানমন্ত্রী গতিশক্তি মিশন ভারতে রূপায়ণের পথে থাকা যাবতীয় প্রকল্পের তথ্য সংগ্রহ করবে, যে কোনও প্রকল্পের খরচ নির্ধারণ করবে এবং বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করবে যাতে দেশি এবং বিদেশি কোম্পানিগুলি ভারতের বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগের পথে হাঁটে।

সরকারি সূত্রের মতে, ১৯৮০ বা ২০১০ সালে বাণিজ্যিক উন্নতির জন্য যে পথ বেছেছিল চিন বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বেশিরভাগ দেশগুলি যে বাণিজ্যিক মডেল মেনে চলেছিল ঠিক সেইভাবেই ভারতের বাণিজ্যিক মডেল প্রস্তুত করা হবে।

২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর দেশের বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে আন্তঃসংযোগ বাড়াতে এবং পরিকাঠামোর উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই প্রধানমন্ত্রী গতি শক্তি প্রকল্পের সূচনা করেন। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদেশি যে কোম্পানিগুলি চিনে বিপুল বিনিয়োগ করেছে তাদের ভারতের বাজারে নিয়ে আসা। ব্যবসায় বিনিয়োগ করার সুবিধের জন্যে একটিই স্বয়ং সম্পূর্ণ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল যা বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করবে।

এই প্রসঙ্গে ২০২১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, “বর্তমান ভারত বিশ্বের বিনিয়োগকারীদের এক নতুন ক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশে নতুন পরিকাঠামো তৈরি করা হয়েছে যাতে বিদেশি বা দেশি কোনও প্রকল্পই অহেতুক বাধার সম্মুখীন না হয়। সময়ের মধ্যে যে কোনও প্রকল্প শেষ করার যাবতীয় পরিসর সফলভাবে প্রস্তুত করেছে ভারত।"

বাণিজ্য মন্ত্রকের বিশেষ সচিব অমৃত লাল মীনা এই প্রসঙ্গে বলেন, “এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হল যে কোনও প্রকল্পকে বরাদ্দ সময় এবং বরাদ্দ অর্থের মধ্যে শেষ করা। এই লক্ষ্যমাত্রায় আমরা পৌঁছতে পারলেই বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলি ভারতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগ্রহী হবে।”

আরও পড়ুন- কংগ্রেস-বিজেপির আধিপত্য ছাপিয়ে যাদব রাজত্বের ধ্বজা উড়িয়েছিলেন মুলায়ম সিং যাদব

বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে চিনের সঙ্গে টক্কর দিতে পারবে ভারত?

এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারত। এই গতি শক্তি মিশনের মাধ্যমে ভারত প্রকল্পগুলির দ্রুত রূপায়ণের জায়গা থেকে চিনকে টেক্কা দিতে পারবে এমনটাই মত বাণিজ্যিক মহলের। ভারতের ব্যাবসা বাণিজ্যের এই বিকাশকে আরও সাহায্য করবে ভারতের উন্নত কর্মীর সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি। এমনিতেই বিশ্বের বাজারে ভারতীয় কর্মীর চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। সেই সব দক্ষ কর্মীদের যদি ভারতের বাজারে কাজ করানো যায় তাহলে অবশ্যই ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশে তা বিশেষ সহায়ক হয়ে উঠবে।

রাজনৈতিক ভাবে চিনের মোকাবিলা করা ছাড়া ও বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতায় চিনকে টক্কর দেওয়া ভারতকে কূটনৈতিক জায়গায় অনেকটাই এগিয়ে রাখবে বলে মনে করেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

ভারতের বাণিজ্যিক মহলের ধারণা গতিশক্তি মিশন আমলাতন্ত্রের ফাঁস অনেকটাই আলগা করবে। এত বছর ধরে লাল ফিতের ফাঁসে যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বন্ধ অবস্থায় পরে ছিল সরকারের এই নতুন উদ্যোগ তাতে গতি আনবে।

মে মাস পর্যন্ত কেন্দ্রের প্রায় ১৫৬৮ টি প্রকল্পের মধ্যে ৭২১ টি সময়ে শেষ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি আর বাকি ৪২৩ টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে বরাদ্দ অর্থের বেশি খরচ হয়েছে। এই অনিয়ম রুখতেই এবার কঠোর নীতি প্রণয়নের পথে হেঁটেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। ইতিমধ্যেই তার ফলও মিলেছে খানিক। আর দু’মাসের মধ্যেই ভারতেই আইফোন নির্মাণের প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে অ্যাপল। ২০১৮ সালে ভারতে বিশ্বের বৃহত্তম মোবাইল ফ্যাক্টরি তৈরি করেছে বহুজাতিক সংস্থা স্যামসাং। মোদি সরকারের নতুন নীতি ভারতকে বাণিজ্যিকভাবে চিনের থেকে কতটা এগিয়ে দেয় সেটাই এখন দেখার।

More Articles