“শ্মশানে কাজ! কেউ বিয়ে করবে না”, যেভাবে সমাজকে জবাব দিয়েছেন ‘ডোম’ টুম্পা দাস
Dom Tumpa Das: আশেপাশের লোকেরা বলেছিল, শ্মশানের কাজ করলে বিয়ে হবে না। ডোমের মেয়েকে কেউ ঘরে নেবে না। কিন্তু মা পাশে ছিলেন। প্রথমের দিকে শ্মশানে কাজ করতে যাওয়ার সময় মা সঙ্গে যেতেন।
“যে পথ দিয়ে চলতাম, লোকে সে পথ দিয়ে চলত না। রাতের অন্ধকারে কেঁদেছি, কিন্তু আমার কষ্টটা কাওকে জানতে দিইনি। সকালে শ্মশানের কাজ শুরু করি হাসিমুখেই। কারণ আমি জানি, আমাকে লড়তে হবে।” কথাগুলো বলছিলেন টুম্পা দাস, বাংলার একমাত্র মহিলা ডোম বলে তিনি পরিচিত। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বারুইপুরের পূরন্দরপুর শ্মশানে দশ বছর ধরে শবদাহের কাজ করে চলেছেন। মাধ্যমিক পাস করে টেলারিং শিখেছিলেন। তারপর নার্সিং শিখে সেই কাজ করছিলেন। কিন্তু বেতন খুব বেশি ছিল না সেকাজে। অগত্যা অন্য পেশায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
কল্যাণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পুরন্দরপুর শ্মশানে প্রথমে কাজ করতেন টুম্পা দাসের বাবা। তিনি এই এলাকার জামাই বলে জানান উপ-পুরপ্রধান সুরজিৎ পুরকাইত। টুম্পার মামাবাড়ির পরিবারেরই এক সদস্য আগে সেই শ্মশানে কাজ করতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর টুম্পার বাবা সেই কাজের দায়িত্ব নেই। কিন্তু শরীর ভালো থাকতো না তাঁর, তাই টুম্পা বাবাকে সাহায্য করতে আসত। তখন ছিল কাঠের চুল্লি। বলছিলেন কল্যাণপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপ-পুরপ্রধান সুরজিৎ পুরকাইত।
আরও পড়ুন- লিঙ্গবৈষম্যের মুখে সপাট জবাব! দেশ ভুলেছে প্রথম মহিলা চিত্রসাংবাদিক হোমাই ভ্যারাওয়ালাকে
২০১৪ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর টুম্পা বুঝতে পারছিলেন না কী ভাবে সংসার চলবে। একদিকে বাবার মৃত্যুতে মা ভেঙে পড়েছিলেন, বোন গর্ভবতী এবং ডিভোর্স হয়েছে, ভাইও ছোট। সুতরাং তাঁর কাজ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সেসময় উপ-পুরপ্রধান তাঁকে শ্মশানের কাজটা করার জন্য বলেন। ২০১৫ সাল থেকে শুরু, তখন ২৪ ঘণ্টা কাজ করতে হতো, কাঠের চুল্লিতে। এখন তো তিনি ভাবতেই পারেন না, কী ভাবে দশটা বছর এই পেশায় কাটিয়ে ফেললেন। ইনস্ক্রিপ্টের সঙ্গে কথপোকথনে বলছিলেন টুম্পা দাস।

টুম্পা দাস, পুরন্দরপুর শ্মশানকর্মী
আশেপাশের লোকেরা বলেছিল, শ্মশানের কাজ করলে বিয়ে হবে না। ডোমের মেয়েকে কেউ ঘরে নেবে না। কিন্তু মা পাশে ছিলেন। প্রথমের দিকে শ্মশানে কাজ করতে যাওয়ার সময় মা সঙ্গে যেতেন। রাত-বিরেতে শবদাহ করতে এলে চিন্তা তো থেকেই যায়। উপ-পুরপ্রধান ইনস্ক্রিপ্টকে জানান, ক্লাবের লোককে বলা থাকে। নানা ধরনের মানুষ আসেন শ্মশানে। কেউ ঝামেলা করলে ক্লাবের ছেলেরা সামলায়। তাছাড়া টুম্পাও বেশ কড়া মেজাজে পরিস্থিতি সামাল দেন বলে জানান। প্রয়োজনে বকাও দেন।

টুম্পা দাস, পুরন্দরপুর শ্মশানকর্মী
শুরুর দিনগুলোর কথা স্মৃতিচারণ করে টুম্পা বলেন, লোকে বলেছিল, অন্য কাজ করতে। মেয়ে হয়ে ভারী কাঠ কী ভাবে তুলবে! কোদাল কী ভাবে চালাবে? প্রশ্ন করেছিল সমাজ। "শবদাহ করাতে এসে মানুষজন জিজ্ঞেস করেছে, তুমি দাহ করবে? পারবে তো? আবার কাজ শেষে তারাই ভালভাবে কথা বলেছে, আশীর্বাদ করেছে। কাজ করার সময় হাসিমুখে থাকি। আপনজনকে হারিয়ে শোকাহত মানুষরা আসেন, যতক্ষণ আমার কাছে থাকে তাঁদের হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করি।"

টুম্পা দাস, পুরন্দরপুর শ্মশানকর্মী
প্রথমের দিকে একাজ করতে খুব খারাপ লাগত বলে জানান টুম্পা। বিশেষত কম বয়সে কেউ মারা গেলে তার আফসোস হয়। তাঁর কথায়, "ছোট ছোট বাচ্চারা দুনিয়ার কি বা দেখল! পূর্ণ জীবন কাটিয়ে মারা গেলে অতটা কষ্ট হয় না। কিন্তু এটাই ভবিতব্য। আমিও বাবাকে হারিয়েছি। কষ্ট হয়েছে, কিন্তু নিজেকে সামলাতে হয়েছে সংসার চালাতে। তখন শুধু একটাই কথা মাথায় ছিল, আমাকে পরিবারকে দেখতে হবে। লোকে কত কথা বলেছে। যে রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম, সে রাস্তা বদলে নিত মানুষ। আমাকে ছুঁলে নাকি স্নান করতে হবে। রাতের অন্ধকারে কেঁদেছি, তারপর হাসিমুখে সকালে শ্মশানে গেছি।"

টুম্পা দাস, পুরন্দরপুর শ্মশানকর্মী
২০১৯ সাল থেকে ইলেকট্রিক চুল্লি হওয়ার পর ডিউটির সময় কমেছে টুম্পার। এখন আর ভারী কাঠ তোলার কষ্টটা হয় না। তবে আগুনের কাছে এতটা সময় কাজ করে শরীরে ছাপ তো পরেই। ছুটি পেলে একটু ঘুরতে যায়, সাজগোজ করেন বলে জানান টুম্পা। এইভাবেই এক অন্য প্রতীক, অন্য দুর্গা হয়ে উঠেছেন বাংলার মেয়ে টুম্পা দাস। তাঁর কথায়, এই বেশ ভাল আছেন তিনি। কেউ যদি বিয়ে করে, তাঁকে শ্মশানের কাজ করতে দিলেই হবে। আর এই কাজ যদি ছাড়তে হয়, বিয়েই করবেন না।

Whatsapp
