চারশো টাকা না পেলে হাসপাতাল থেকে ফিরত না স্ত্রী! যেভাবে আমজাদ খান হলেন গব্বর সিং
Sholay: 'শোলে' মুক্তি পায়। রাতারাতি আমজাদ খান স্টার হয়ে ওঠেন। গ্লুকোজ-ডি বিস্কুটের বিজ্ঞাপনে দেখা যায় হাতে বন্দুকের বদলে বিস্কুট।
সিপ্পি ফিল্মসের বম্বে অফিসের সবচেয়ে ছোট ঘরটায় প্রায় সারাদিন মাথা গুঁজে বসে থাকত দুই অল্পবয়সি ছোকরা। সাতের দশকের শুরুতে যখন বম্বে-তে স্টুডিও কালচার প্রায় উঠে যাব যাব করছে, তখন বেশিরভাগ সিনেমায় গল্প তৈরি হতো সেটে গিয়ে। পরিচালক বা সহ-পরিচালক মুখে মুখে কিছু একটা বানিয়ে নিতেন। ডায়লগ সেখানেই বানানো হতো। মোটামুটি গোঁজামিল দিয়ে একটা খাড়া করে দিলেই হতো। সিনেমা চলত নায়কের নামে। ক্রেডিট কার্ডে জ্বলজ্বল করতেন “অ্যান্ড অ্যাবাভ অল জিতেন্দ্র”। 'বোম্বাইয়ের বোম্বেটে' উপন্যাসে সত্যজিৎ যে টিপিক্যাল ফরমুলা ছবির কথা বলেছেন, সে ফরমুলা মেনে সাপ্লাই চেনে একের পর এক সিনেমা ধাক্কা খেত পর্দায়, শুক্কুরবার শুক্কুরবার করে। কপাল ভাল থাকলে সগৌরবে তৃতীয় সপ্তাহ, তা না-হলে পরের হপ্তাতেই মুখ দেখাতেন অন্য কোনও নায়ক-নায়িকা।
এই বাজারে ঠাসবুনট গল্পের সুযোগ কম। তবু জিপি সিপ্পির ছেলে রমেশের এই দুই বন্ধুকে একরকম প্রশ্রয়ই দেওয়া হতো। একজন একটু রগচটা, নাম সেলিম খান, অন্যজন নেহাত শান্ত, হাসিমুখ, কবিতাপ্রেমী। জাভেদ আখতার। এক সকালে এই দুই মুর্তি গুটি গুটি পায়ে জিপি-র অফিসে এসে হাজির। একটা ভাল প্লট মাথায় এসেছে। যদি জিপি অনুমতি দেন।
“শোনাও গল্প।”
“আজ্ঞে, গল্প এখনও কিছু লিখিনি। একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। এক পুলিশ অফিসারের গোটা পরিবারকে এক ডাকাত হত্যা করবে। প্রতিশোধ নিতে সেই অফিসার দুইজন চিন্দি-চোর টাইপ ছ্যাঁচড়া গুন্ডার সাহায্য নেবে।”
আরও পড়ুন: নির্ভেজাল, নিঃশর্ত বন্ধুত্বে বিশ্বাস করেননি সত্যজিৎ?
“তারপর?”
“তারপর জানি না। আপনি অভয় দিলে বাকিটা লিখি।”
“বেশ লিখে ফেলো।”
মজার ব্যাপার এই দুই লাইনে ভারতীয় সিনেমার চার আইকনিক চরিত্র ঢুকে গেল। হয়তো সেলিম-জাভেদ খেয়াল-ও করেননি। চিত্রনাট্য লেখা শেষ হওয়ার আগেই এই চারজনের তিনজনের কাস্টিং হতে সময় লাগল না। সঞ্জীবকুমার, অমিতাভ বচ্চন আর ধর্মেন্দ্র ইমিডিয়েট চয়েস। মুশকিল হলো, সেই ডাকাতকে নিয়ে।
যতই চিত্রনাট্যের শেষের দিকে এগোচ্ছিলেন দু'জনে, বুঝতে পারছিলেন, গল্প তাঁদের হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওই দুই গুন্ডাকে ছাপিয়ে পর্দায় বড় হয়ে উঠতে যাচ্ছে সেই পুলিশ অফিসার আর ডাকু। নাম ততদিনে ঠিক হয়ে গেছে। গব্বর সিং। কিন্তু এই ডাকুকে এমন হতে হবে, যিনি অভিনয়ে বাকি তিন মহারথীর সঙ্গে শুধু পাল্লাই দেবেন না, হলে দর্শকের শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের হিমশীতল স্রোত বইয়ে দিতে পারবেন। সে যখন পর্দায় বলবে “ইহাঁ সে পঁচাশ পঁচাশ কোস দূর গাঁও-মে যব বাচ্চা রোতা হ্যায়, তো মা কহতি হ্যায় কে বেটা শো যা, নেহি তো গব্বর আ যায়েগা”, দর্শক যেন এই আতঙ্ক নিজেরা উপলব্ধি করেন।
একের পর এক ভিলেনের অডিশন হলো। কাউকেই পছন্দ হয় না। সবাই যেন একই গতে বাঁধা। যদি বা ড্যানি দেনজংপা-কে বাছা হলো, তিনিও শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ালেন ফিরোজ খানের 'ধর্মাত্মা'-য় অভিনয় করবেন বলে (আজও ভদ্রলোক এই সিদ্ধান্তের জন্য হায় হায় করেন)।
আলো দেখালেন সেলিম খানের বন্ধু সত্যেন কাপ্পু। আইপিটিএ-তে একজন অল্পবয়সি অভিনেতা আছে, নাম আমজাদ খান। একেবারে নতুন মুখ। যদি সেলিমের পছন্দ হয়। আমজাদ তখন ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় অপরিচিত। টাকাপয়সা তলানিতে। সদ্য প্রথম সন্তান সাদাবের জন্ম হয়েছে। কিন্তু স্ত্রী-কে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে আনবেন সেই পয়সা নেই। দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন টাকার জন্য। প্রত্যাখ্যাত হচ্ছেন। 'হিন্দুস্থান কি কসম' ছবিতে ছোট্ট একটা রোল পেয়েছিলেন। সেই ছবির পরিচালক চেতন আনন্দ চারশো টাকা দিলে স্ত্রী-কে হাসপাতাল থেকে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। পাগলের মতো কাজ খুঁজছেন, পাচ্ছেন না। এমন সময় সেলিম খানের সঙ্গে আলাপ। তিনি বললেন, দ্রুত রমেশ সিপ্পির সঙ্গে দেখা করতে।
যখন আমজাদ সিপ্পির ঘরে ঢুকলেন, ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সিপ্পি দরজার দিকে পিছন করে মাটিতে বসে কিছু একটা করছিলেন। আমজাদের গলার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই তাঁর মনে হলো দরজাজুড়ে দৈত্যাকার এক মানুষ দাঁড়িয়ে। চমকে উঠলেন। আরেহ! এমনটাই তো চাইছিলেন তিনি। আমজাদকে সৈনিকের পোশাক পরিয়ে, দাঁত কালো করে স্ক্রিন টেস্ট নিতেই সিপ্পি বুঝে গেলেন, তিনি তাঁর গব্বরকে পেয়ে গেছেন। সমস্যা একটাই। এর আগে যত নামকরা ভিলেন ছিলেন, কারও গলা আমজাদের মতো পাতলা না। এমনকী, এই ছবিতেও বাকি তিনজন তাঁদের ভারী গলার জন্য বিখ্যাত। এই ছবিতে আরও মুশকিল আছে। সেরা সেরা ডায়লগগুলো সেলিম খান বেছে বেছে রেখেছেন গব্বরের জন্য।
গলায় যা হবে না, সেটা আমজাদ পুষিয়ে দিলেন ম্যানারিজমে। ডায়লগ থ্রোয়িং-এ এমন এক অদ্ভুত পিকিউলিয়ারিটি দেখালেন, যা ভারতীয় ট্র্যাডিশনাল ভিলেনি আগে কোনও দিন দেখেনি। সামান্য গলা খাদে রেখে “কিতনে আদমি থে” যখন বলেন, সেই স্টাইলাইজেশনে এখনও কেঁপে উঠতে হয়।
'শোলে' মুক্তি পায়। রাতারাতি আমজাদ খান স্টার হয়ে ওঠেন। গ্লুকোজ-ডি বিস্কুটের বিজ্ঞাপনে দেখা যায় হাতে বন্দুকের বদলে বিস্কুট। ওপরে লেখা “গব্বর কি আসলি পসন্দ”।
দিন যেতে লাগল। 'শোলে' ছবির বাকিরা অনেক আগে এগিয়ে গিয়েছিলেন। 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি', 'লাভ স্টোরি', 'ইয়ারানা', 'উৎসব'-এর মতো কিছু ব্যাতিক্রমী চরিত্র বাদ দিয়ে সারাজীবন আমজাদ গব্বরের ছায়া হয়েই রয়ে যাচ্ছিলেন। অমিতাভের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ার বড় খেসারত দিতে হয় তাঁকে। কাজ পাচ্ছিলেন না। যেসব রোলে অভিনয় করছিলেন, তা হাস্যকর। তাঁর উপযুক্ত না।
ফিরে আসার মরিয়া চেষ্টা করেন শেষবারের মতো। অজিত দিওয়ানি পরিচালিত সেই ছবি 'রামগড় কি শোলে'-তে অমিতাভ বচ্চন, দেব আনন্দ, অনিল কাপুর আর গোবিন্দা-র লুক অ্যালাইকদের মাঝে অরিজিনাল শুধু গব্বরের ভূমিকায় আমজাদ। প্যারডি ছবি হলেও প্রায় বেলুনের মতো ফুলে যাওয়া আমজাদ আর আগের মতন ভয় ধরান না। বরং তাঁকে দেখে হাসি পায়, বিষন্ন হই। অনেক পরে রামগোপাল ভর্মার 'আগ'-এ গব্বর করতে গিয়ে ভয়ানক বিপর্যয় ঘটিয়েছেন স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন। প্রমাণ করেছেন, গব্বরকে কেউ রিক্রিয়েট করতে পারে না। এমনকী, অমিতাভ বচ্চনও না।