জিনোমিক্সের দৌড়ে নামছে ভারতীয় ক্রীড়াবিশ্ব, কোচ নন, ডিএনএ-এই শেষ কথা বলবে?

Sports Genomics: ভারতের মতো দেশে, যেখানে আর্থিক সুযোগ ও প্রশিক্ষণ পরিকাঠামো সমান নয়, সেখানে জিনের পরীক্ষা হয়তো এক নতুন সামাজিক বিভাজন তৈরি করতে পারে।

MG

মাঠের পাশে থেকে হঠাৎ রতনদা বলে ওঠে , “ওই ছেলেটাকে দেখেছিস - প্রশিক্ষণ নেই, ব্যায়াম নেই কিন্তু দৌড়টা ওর জিনেই আছে!” কথাটা শুনে হাসির রোল উঠলেও অনেকের মুখ চুপসে যায়। যাঁরা উদয়স্ত ঘাম ঝরাচ্ছে বিষয়টা খুবই উদ্বেগের তাঁদের জন্য। অনেকেই বলেন এই কথাগুলো, অমুকের রক্তে খেলা আছে, ওর বাপ-ঠাকুরদাও নাকি খেলোয়াড় ছিল! সব গুণ নাকি রক্তের শিল্প, খেলা, লেখাপড়া, এই যা হয় আর কী!

কিন্তু আজ, ঠাট্টা, রসিকতা গুলোই ল্যাবরেটরির আলোয় প্রমাণিত সত্য। বাদ যাচ্ছে না ক্রীড়াবিশ্বও। খেলোয়াড়ি মনের পাশাপাশি শরীরেও আছে খেলাধুলার ছাপ।

যে জিন ঠিক করে দেয় কার বেশি শক্তি, কে দ্রুত ছুটবে আর কে দৌড়ের মাঝে হাঁপাবে, সেই জিনের মানচিত্র এখন খুলে ফেলেছেন ভারতীয় ক্রীড়া বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, খেলোয়াড়ের প্রতিভা বা দুর্বলতা সবই লেখা আছে তার ডিএনএ-তে। আর সেই সূত্র ধরেই ভারতীয় খেলায় ঢুকছে এক নতুন বিজ্ঞান “স্পোর্টস জিনোমিক্স”।

আরও পড়ুন- রূপান্তরকামী মহিলারা ক্রিকেট খেললে মহিলাদের অধিকার কমে যায়?

আজকের দিনে পেশাদার খেলোয়াড় তৈরি মানেই শুধু শারীরিক পরিশ্রম নয়। তাঁদের পেশির গঠন, ফুসফুসের ক্ষমতা, সহনশক্তি সবই এখন বিজ্ঞানের মাপজোখে। কিন্তু, কেউ যদি বলত এই সব তথ্য তাঁর জন্মের সময়ই শরীরে লেখা ছিল? তখন হয়তো সবাই হাসত। আজ সেই হাসি থেমে যাচ্ছে, কারণ বিজ্ঞান বলছে - একজন অ্যাথলিটদের ক্ষমতা অনেকটাই নির্ভর করে তাঁর জিনের উপর। এসিটিএন৩ (ACTN3) বা এসিই (ACE) নামের দুটি জিনই নাকি ঠিক করে দেয় কে স্প্রিন্টে দ্রুত ছুটবেন, না কি ম্যারাথনে দীর্ঘপথের যোদ্ধা হবেন, কে কত সময়ে সুস্থ হয়ে উঠবেন, কার হাড়ের ক্ষমতা কত।

আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এবং চিন— বিশ্বের তাবড় তাবড় দেশগুলোর ক্রীড়া প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে জিনোমিক্সের ব্যবহার ছিল আগে থেকেই। ভারতও এখন সেই দৌড়ে নিজের নাম লিখিয়েছে।

ইতোমধ্যেই কিছু বেসরকারি স্পোর্টস সায়েন্স ইনস্টিটিউট জিন টেস্ট শুরু করেছে। প্রশিক্ষণ শুরুর আগেই তাঁরা জানাতে চান, কোন খেলোয়াড়ের শরীর কোন ধরনের খেলায় মানাবে। এক অর্থে, এটা যেন ভবিষ্যতের প্রতিভা মানচিত্র তৈরি করছে। খেলোয়াড়ের বিশেষত লিগামেন্ট এর স্বাস্থ্যের জন্য এটা যাচাই করে নেওয়াটা খুব জরুরি। এখানেই প্রশ্ন, আগামী দিনে খেলোয়াড় কি তৈরি করা হবে, না শুধু খুঁজে নেওয়া হবে?

আরও পড়ুন- ফাতিমা সানা: পুরুষতান্ত্রিক পাকিস্তানে মহিলা ক্রিকেট বিপ্লবী

ভারতের মতো দেশে, যেখানে আর্থিক সুযোগ ও প্রশিক্ষণ পরিকাঠামো সমান নয়, সেখানে জিনের পরীক্ষা হয়তো এক নতুন সামাজিক বিভাজন তৈরি করতে পারে। বিত্তবানরাই হয়তো প্রযুক্তির সুবিধা পাবে, আর দরিদ্র প্রতিভারা সুযোগ হারাবে। 

যদিও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন জিন একা কিছু করতে পারে না। পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, মানসিক শক্তি সবই গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, কারও জিনে ‘দৌড়বিদ’ লেখা থাকলেও, পরিশ্রম ছাড়া সে মাঠে নামতে পারবে না। সব কিছুরই সুফল আর কুফল এই ক্ষেত্রেও রয়েছে, খেলোয়াড়ের জিনগত তথ্য যদি বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হয়—তাহলে সেটি বায়োলজিকাল প্রোফাইলিং-এর শামিল। একজন ভালো কিশোর বা কিশোরী খেলোয়াড় যদি জানেন, তাঁর জিনে ‘দুর্বলতা’ আছে তাহলে কি অচিরেই তাঁর আত্মবিশ্বাসের মিনার ভেঙে পড়বে না? হয়তো এই ভয়টা থেকেই যাবে বা কখনও জিনের কারণে আগেভাগেই পরাজয় শিকার করে নেবে সে।

সব মিলিয়ে স্পোর্টস জিনোমিক্স এখন এক অদ্ভুত দ্বিধার মুখে দাঁড় করাচ্ছে খেলাধুলোর বাস্তুতন্ত্রকে। একদিকে এটি প্রশিক্ষণ আর ফিটনেস প্রোগ্রামকে নিখুঁত করে তুলতে যেমন পারেঅন্যদিকে এটি প্রতিভার মানবিক দিকটিকে “ডেটা” বানিয়ে ফেলতেও দেরি করবে না। যে খেলোয়াড় একসময় নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে বিশ্বজয় করতেন, তাঁর জায়গা নিচ্ছে ডিএনএ রিপোর্ট কার্ড। প্রশ্ন একটাই - এই রিপোর্ট কি স্বপ্ন দেখতে শেখাবে, না স্বপ্নকে মাপতে বসবে?

More Articles