ভারতের দু'টিমাত্র ১০৮ শিব মন্দির, রয়েছে বাংলারই এক জেলায়, মাহাত্ম্য জানুন

বর্ধমানের মহারাজাদের রাজত্বকাল থেকেই কালনার গরিমা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।মহারাজা ও রানিদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মন্দির ও দেবতা-বিগ্রহ আজও কালনার ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে চলেছে। কালনাকে করে তুলেছে মন্দির শহর। ১৭০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে কালনায় অসংখ্য মন্দির তৈরি হয়।


১০৮ শিব মন্দির কালনার ভক্তি, আবেগ ও ভালবাসার মূর্ত প্রতীক। ভারতে মাত্র দু'টি ১০৮ শিব মন্দির আছে। একটি বর্ধমানে ও একটি কালনায়। দু'টি মন্দির-ই তৈরি হয় বর্ধমানের তেজচন্দ্র মহারাজের মা বিষণকুমারীর ইচ্ছায়।


১০৮ শিব মন্দিরটির প্রতিষ্ঠা লিপিতেই লেখা আছে:


শাকে চন্দ্র শিবাক্ষি সপ্ত কুমিরে শ্রী
তেজচন্দ্রাভিধৌবা সূর্যইব স্থির
রার্পিত চলচ্চন্ড প্রতাপানল:
শম্ভোর্ধাম পরম নবাধিকশত শ্রী
মন্দিরৈর্মন্ডলম প্রকার্ষীম্মহদ
অম্বিকাখ্য নগরে কৈলাসমেত্ নব্৷

অর্থাৎ এই 'নবাধিক শত' মন্দিরটি ১৭৩১ শকাব্দে, অর্থাৎ ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে তেজচন্দ্র কর্তৃক নির্মিত হয়। ১৭৮৮ সালে মা তেজচন্দ্রের মাতা বিষাণকুমারী বর্ধমানের নবাবহাটে ১০৮ শিব মন্দির নির্মাণ করান। মূলত মন্দিরটি নবকৈলাশ মন্দির নামে খ্যাত। বর্ধমানের মন্দিরটি আয়তক্ষেত্রাকার বিশিষ্ট, কিন্তু কালনার ১০৮ মন্দিরটি বৃত্তাকার। দু'টি বৃত্তের মধ্যে ১০৮টি শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। প্রথম বৃত্তটিতে ৭৪টি মূর্তি অধিষ্ঠান করছে। দ্বিতীয় বৃত্তটিতে ৩৪টি মূর্তি রয়েছে। প্রথম বৃত্তটির প্রতিটি মুর্তি একটি কৃষ্ণবর্ণ ও একটি শ্বেতবর্ণ, কিন্তু ভেতরের বৃত্তটিতে সব লিঙ্গগুলোই শ্বেতবর্ণ। এই মন্দিরের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষনীয়। মন্দিরের শিবলিঙ্গগুলো ঘড়ির কাঁটার মতো সাজানো এবং মন্দিরের যে কোনও স্থান থেকে একসঙ্গে পাঁচটি শিব দর্শন করা যায়। আপনি হাজার চেষ্টাতেও একসঙ্গে এর বেশি দর্শন করতে পারবেন না। ভেতরের বৃত্তের শিবগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট।

আরও পড়ুন: সাধক কমলাকান্ত থেকে ভবা পাগলা– এখানে আসতেই হবে কালীভক্তদের

দ্বিতীয় বৃত্তের মাঝখানে একটি বিরাট ইদারা আছে। এই ইদারাটি নিয়ে বিভিন্ন তথ্য শোনা যায়। কেউ কেউ বলেন মন্দির নির্মাণ করার সময় এখানে এক বিরাট কম্পাস গর্ত করে বসিয়ে বৃত্তের সঠিক পরিমাপ করা হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন উৎসব-অনুষ্ঠানে ও পুজো-পার্বণে জলের প্রয়োজনের জন্য মহারাজ এই ইদারা তৈরি করেন। কেউ বা বলেন এটি মহাশূন্য, পরম শিবের প্রতীক, নিরাকার ব্রহ্ম।

প্রত্যেকটি শিবলিঙ্গের মন্দিরের প্রবেশদ্বারের ওপর, শিবলিঙ্গের নামকরণ লিপিবদ্ধ করা আছে। ১০৮ শিব মন্দিরের বাইরে, রাস্তা যেখানে তিনমাথা হয়েছে, সেইখানে আরও একটি শিব মন্দির আছে। এই মন্দিরের দরজার শিলালিপিতে ১০৯ সংখ্যাটি লেখা আছে। এর মধ্যে যে লিঙ্গটি রয়েছে, তা কৃষ্ণবর্ণের। এই শিবলিঙ্গটি 'জলেশ্বর' নামে খ্যাত। এই মন্দিরটির ধাঁচে আরও একটি পঞ্চরত্ন মন্দির আছে। এটি 'রত্নেশ্বর' নামে খ্যাত। সেই অনুসারে মোট ১১০টি মন্দির আছে।

অনুমান করা যায়, সেই সময় মহারাজ তেজচন্দ্র সাধক কমলাকান্তের সংস্পর্শে আসেন এবং বীজমন্ত্র গ্রহন করেন। ১০৮সংখ্যাটি একটি সিদ্ধ বীজমন্ত্রের প্রতীক। বর্ধমানের ইতিহাসবিদ যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী বলেছেন যে, বীজমন্ত্রের জপমালায় যেমন ১০৮টি রুদ্রাক্ষের সঙ্গে কয়েকটি বড় রুদ্রাক্ষ গাঁথা থাকে। শিবলিঙ্গগুলো চৈতন্য ও জ্ঞানের প্রতীক।

১০৮ শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার একটি ইতিহাস আছে। ১৭৮৮সালে নবাব হাটে একবার ভয়ংকর মহামারী দেখা দেয়। তখন রাজমাতা বিষাণকুমারী দেবী শোকসন্তপ্ত প্রজাগণকে ঈশ্বরমুখি করে তোলার জন্য বর্ধমানের ১০৮ মন্দিরটি তৈরি করান। জনশ্রুতি আছে মহারানি বিষাণকুমারী বিধবা হওয়ার পর নাবালক পুত্র তেজচন্দ্রকে নিয়ে রাজ্যপাট দেখভালের কাজে মন দেন। সেই সময় বর্ধমানের বহু অংশ পত্তনি দেওয়ার ফলে আয় বৃদ্ধি হতে থাকে এবং ঋণ পরিশোধ করার পরেও রাজকোষ উপচে পড়ে। ইতিমধ্যে, সাবালক পুত্র তেজচন্দ্র রাজকার্য হাতে নেন এবং অনিবার্যভাবেই উশৃঙ্খল হয়ে ওঠেন। পুত্রকে সংযত করতে না পেরে তখন মহারানি বিষাণকুমারী অধিকাংশ সময় কালনায় এসে বসবাস শুরু করেন। ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে রাজকার্য চালাতে অক্ষম রাজা পুনরায় তাঁর মায়ের শরণাপন্ন হন। আবার বিষাণকুমারী রাজকার্য হাতে তুলে নেন। ১৭৯৮ সালে রাজমাতা বিষাণকুমারীর মৃত্যু হয়। তাঁর শেষ ইচ্ছানুযায়ী ১৮০৯ সালে কালনার ১০৮ শিব মন্দির তৈরি হয়। পূর্বে ১২ জন ব্রাহ্মণ এই ১০৮ মন্দিরের সেবাইত ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকে ৯টি প্রত্যহ করে শিব পুজো করতেন। পুজোর উপচার ছিল: চিনি আধা সের, সুপারি ৪টি, পান ৯টি, তেল ১ পোয়া, ঘি আধাপোয়া, পাটালি ১ পোয়া ইত্যাদি। কালের নিয়মে পূজা পদ্ধতি এবং উপচারের পরিবর্তন ঘটেছে।

এই মন্দির শৈলী অসাধারণ। মন্দিরগুলো আটচালা গঠনের।চারচালার ওপর ক্ষুদ্রাকৃতি আরও চারচালা। উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট, প্রস্থে সাড়ে ৯ ফুট। প্রথম বৃত্তের ভেতরের পরিধি প্রায় ৭০০ ফুট, ভেতরের বৃত্তের পরিধি প্রায় ৩০০ ফুটের একটু বেশি।

এই মন্দির কালনার ঐতিহ্যকে আরও মহিমান্বিত করেছে। এর ইতিহাস বারবার মানুষকে টেনে আনে এই মন্দির প্রাঙ্গণে, এর গঠনশৈলী মুগ্ধ করে মানুষকে। মন্দির শহর কালনার শ্রেষ্ঠতম ও ঐতিহ্যশালী কীর্তি এই ১০৮ মন্দির।

[তথ্যসূত্র: পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি (প্রথম খণ্ড): বিনয় ঘোষ, কালনার জনশ্রুতি ও অমিত কুমার সাহা (কৃতজ্ঞতা স্বীকার)]

More Articles