মাত্র ১৫ বছরেই অসাধ্য সাধন! বুলেট ট্রেনের দ্রুতগতির পৃথিবীতে যে ভাবে বিপ্লব ঘটাল চিন
China Bullet Train : বুলেট ট্রেনের মানচিত্রে চিন আগে ধর্তব্যের মধ্যেই ছিল না। আজ, ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে, মাত্র ১৬ বছরের মধ্যে বদলে গিয়েছে পরিস্থিতিটা।
হাই স্পিড ট্রেন, বুলেট ট্রেন - বিগত বেশকিছু বছরে নিশ্চয়ই এই শব্দগুলি আপনার নজরে এসেছে। আমাদের দেশে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার মুখে। ২০১৭ সালে উদ্বোধন হয় মুম্বই থেকে আহমেদাবাদ বুলেট ট্রেন প্রকল্পের। ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার বেগে ছুটবে এই ট্রেন। আট ঘণ্টার দূরত্বকে কমিয়ে আনবে মাত্র দু'ঘণ্টায়। এতটাই দ্রুত যে, মানুষ গুজরাতের এই শহর থেকে দেশের অর্থনৈতিক রাজধানীতে যাওয়ার জন্যে আর হয়তো বিমানে চাপবেন না। কিন্তু এই সুবিধা পেতে গেলে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত।
ভারত পৃথিবীর পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হলেও, বুলেট ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে সেই ২০২৭ সাল পর্যন্ত। পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আজ অবধি কোনও বুলেট ট্রেন নেই। যদিও তার কারণ ভিন্ন। পৃথিবীর খুব কম সংখ্যক দেশের কাছেই এই অবিশ্বাস্য গতির রেল ব্যবস্থা রয়েছে। আচ্ছা, বুলেট ট্রেনের প্রসঙ্গ উঠলেই আপনার কোন দেশের কথা সবার আগে মাথায় আসে? জাপান? আপনার কি মনে হয়, তাদের কাছে পৃথিবীর সবথেকে বেশি উন্নত বুলেট ট্রেন ব্যবস্থা রয়েছে? তাহলে দুঃখের সঙ্গে জানাতে হচ্ছে যে, আপনার জবাব ভুল!
আপনার জবাব জাপান হওয়ার অবশ্য সঙ্গত কারণ রয়েছে। ১৯৬৪ সালে জাপানেই সর্বপ্রথম শিনকানসেন ট্রেনের যাত্রা শুরু হয়, যার ইংরাজি অর্থ হলো 'বুলেট'। কিন্তু এই ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে যদি সবথেকে বৃহৎ এবং শক্তিশালী বুলেট ট্রেনের পরিকাঠামোর কথা ওঠে, তাহলে অবধারিতভাবে সামনে আসবে চিন। এ এক অভূতপূর্ব গল্প, ভবিষ্যতের জন্যও এ এক আশা জোগানোর কাহিনি।
আরও পড়ুন : বুলেট ট্রেনের চেয়েও দ্রুত ছুটবে নতুন বন্দে ভারত, চোখ ধাঁধিয়ে দেবে এই ট্রেনের অন্দর
সালটা ২০০৭। জাপানের সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বেশকিছু দেশে তখন বুলেট ট্রেন দাপিয়ে চলছে। বুলেট ট্রেনের মানচিত্রে চিন তখন ধারেকাছেও নেই। আজ, ২০২৩ সালে দাঁড়িয়ে, মাত্র ১৬ বছরের মধ্যে বদলে গিয়েছে পরিস্থিতিটা। এখন আপনি বেজিং থেকে সাংহাইয়ের মধ্যে ১৩০০ কিলোমিটারের দূরত্ব অতিক্রম করবেন মাত্র চার ঘণ্টায়! বেজিং থেকে গুয়াংজো শহর পৌঁছবেন আট ঘণ্টায়; যেখানে আগে সময় লাগতো ২২ ঘণ্টা! শুধু সমতলে নয়,সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩০০০ মিটার উচ্চতায়, তিব্বতেও চাপতে পারেন বুলেট ট্রেনে। যার ভিতরে রয়েছে অক্সিজেনের ব্যবস্থা; সঙ্গে এমন এক জানলা, যাতে সূর্য আপনার ত্বক ঝলসে দিতে না পারে।
হ্যাঁ, মাত্র দেড় দশকে চিন এই অসাধ্য সাধন করেছে। ৪০,০০০ কিলোমিটারের নেটওয়ার্ক নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম বুলেট ট্রেন পরিকাঠামোর মালিক এখন চিন। ২০৩৫ সালের মধ্যে তাদের লক্ষ্য, এই দূরত্ব ৭০,০০০-এ নিয়ে যাওয়া। আজ পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ বুলেট ট্রেনের নেটওয়ার্ক শুধুমাত্র চিনের দখলে রয়েছে। শুধু তাই নয়, এই প্রযুক্তি অন্যান্য দেশে পৌঁছে দেওয়ার দৌড়ে জাপানকেও টেক্কা দিচ্ছে তারা। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার প্রথম বুলেট ট্রেনের বরাত পেয়েছে তারা, জাপানকে পিছনে ফেলে।
কিন্তু কোন জাদুবলে এমন অবিশ্বাস্য এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলল চিন? তাও এত কম সময়ে?
সবার আগে সামনে আসে চিনের অর্থনৈতিকভাবে চাঙ্গা হয়ে ওঠার কাহিনি। বিশ্বের কারখানা হয়ে উঠে চিন অকল্পনীয়ভাবে ধনী হয়ে ওঠে। সেইসঙ্গে বুঝতে পারে যে, অর্থনীতির চাকাকে আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। দেশকে জুড়ে ফেলতে হবে এমন এক জালে যা মানুষের জীবনকে করে তুলবে সহজ এবং সেটা ব্যবসার জন্য অনেক বেশি সুবিধাজনক।
আরও পড়ুন : কে এই মহিলা? চিনা গুপ্তচর নাকি! দলাই লামার জীবন নিয়ে কেন আশঙ্কা ভারতের
তারপরই বলা যেতে পারে খরচের কথা। বুলেট ট্রেনের পরিকাঠামো নির্মাণ করা কিন্তু ভীষণ খরচসাপেক্ষ একটি কর্মকান্ড। কিন্তু চিন এখানেই বাকিদের এক ডজন গোল দিয়েছে বলা যায়। এক কিলোমিটার বুলেট ট্রেনের লাইন তৈরি করেছে মাত্র ১৭-২১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে। যেখানে ইউরোপে এই অংকটা গিয়ে দাঁড়ায় ২৫-৩৯ মিলিয়নে। এমনিতেই চিনের রাজনৈতিক পরিকাঠামো এই সুবিধাটা রাষ্ট্রকে দিয়েছে যে, তারা শ্রমিককে খুব কম বেতন দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে। সেইসঙ্গে এই প্রকল্পের কাঁচামালও চিন খুব কম দামে আদায় করেছে। সমস্ত প্রয়োজনীয় কাঁচামাল তারা কিনেছে দেশীয় ব্যবসায়ীদের থেকেই, যা আখেরে তাদের দেশের অর্থনীতিকেই আরও শক্তিশালী করেছে।
পরের কারণটি খতিয়ে দেখতে গেলে একটি বিষয় সামনে আসে। চিনের রাজনৈতিক পরিকাঠামো। চিনের রাষ্ট্র ব্যবস্থা এই প্রকল্পের জমি জোগাড় করার কাজে খুবই সাহায্য করেছে। প্রচুর পরিমাণে মানুষকে প্রকল্পের কারণে বাস্তুহারা হতে হয়েছে। সবাই যে ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন বা পুনর্বাসন হয়েছে তারও কোনো অকাট্য প্রমাণ নেই। সরকার এতটাই নির্মম যে, যখন কেউ জমি ছাড়তে চাননি, তখন তার জমি বা বাড়ির চারপাশে নির্মাণকাজ করেছে। এমনভাবে করেছে, যাতে বাসিন্দারা বাধ্য হয়েছেন জায়গা ছেড়ে দিতে। অন্যদিকে জার্মানি হোক বা ভারত, সব জায়গায় জমি সংক্রান্ত কোনও না কোনও সমস্যা এসেছে বুলেট ট্রেন প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নে। কিন্তু এই ধরণের সমস্যা চিনে ঠিক পাত্তা পায় না। মানবাধিকার শব্দটির সঙ্গে সেখানকার ক্ষমতাসীন নেতারা বিশেষ পরিচিত নন।
২০১৩ সালের মধ্যে ১০,০০০ কিলোমিটার রেল লাইনের গণ্ডি ছাড়িয়ে যায় চিন। যা গোটা ইউরোপের বুলেট ট্রেন লাইনের আয়তন। এই পুরো বুলেট ট্রেন ব্যবস্থা কিন্তু চিন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও চালাচ্ছিল। তার কারণ?
আবারও সেই রাজনীতি। প্রথমেই যে কারন উঠে আসে, তা হলো রাজনৈতিক ভাবে অস্থির যে সমস্ত জায়গা আছে, তাদের এই বুলেট ট্রেন কাঠামোর মাধ্যমে জুড়ে দেওয়া। তা সে তিব্বতই হোক বা সিনজিয়াং। এরপর উঠে আসে চিনের বিশ্বজয় করার জন্যে স্বপ্নের সেই প্রকল্প। 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ'। যে প্রকল্পের মাধ্যমে চিন বিশ্বকে জুড়তে চায়, ঘিরে ফেলতে চায় তার শত্রুকে। দেশের মধ্যেই সেই প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল বুলেট ট্রেন। তাই আর্থিক ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও বুলেট ট্রেনকে তারা আরও প্রসারিত করে গেছে।
আরও পড়ুন : ২৫৬ বছরের জীবনে মোট ২৩ বার বিয়ে! চিনের এই ‘রহস্যময়’ বৃদ্ধ আসলে কে!
তবে এ কথাও ঠিক যে, চিনের বাসিন্দারা তাদের সরকারের গর্বের এই প্রকল্পের সুবিধা দু'হাত ভরে নিয়েছেন। বুলেট ট্রেন চিনে আজ অত্যন্ত জনপ্রিয়। দেশের মানুষ খুবই কম বিমান চড়েন। বুলেট ট্রেনের ব্যবস্থা যত ভালো, চিনের ভেতর বিমান পরিষেবা ততটাই দুর্বল। বিমান পরিবহন ব্যবস্থাও সম্পূর্ণভাবে সেনার অন্তর্গত; তাদের অনুমতি ছাড়া একটিও বিমান আকাশে উড়তে পারে না। স্বাভাবিকভাবেই বিমান ছাড়পত্র পেতে অনেক দেরি হয়। ফলে ভোগান্তি হয় বাসিন্দাদের। সেই কারণে আরও বেশি করে বুলেট ট্রেনকে আঁকড়ে ধরেছেন চিনের বাসিন্দারা।
পরিবেশের জন্যেও এ এক দারুণ খবর। ২০৬০ সালের মধ্যে নিজেদের কার্বন নিউট্রাল করার লক্ষ্য নিয়েছে চিন। এই বুলেট ট্রেনের নেটওয়ার্ক সেই কাজে তাদের নিশ্চিতভাবেই অনেক সাহায্য করবে।
চিন এখানেই থামছে না। বিশ্বের দ্রুততম ম্যাগলভ ট্রেন, যা চলবে চৌম্বকীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তাও আগামী কিছু বছরেই চালু করবে তারা। চালু হওয়ার পর ট্রেনটির গতি হবে ৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি, যা পৃথিবীর দ্রুততম স্থলযান হতে চলেছে।
চিনের এই অভূতপূর্ব সাফল্য আরো বেশি করে আলোচনার যোগ্য। কারণ, পৃথিবীর আর কোনও দেশ এই কাজে তাদের ধারেকাছেও নেই। আগামী ১০০ বছরেও তাদের ছুঁতে পারবে না বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। গোটা দেশকে এত দ্রুত গতির এক পরিবহণ ব্যবস্থায় মাত্র ১৫ বছরে মুড়ে ফেলা এক অবিশ্বাস্য কীর্তি, এবং তাদের লক্ষ্য বহুদূর।
ভারত কি প্রতিবেশীকে দেখছে?