দুই স্তন কেটে কলাপাতায় মুড়ে তুলে দিয়েছিলেন হাতে! দলিত নাঙ্গেলি কেন প্রতিবাদেরই ছদ্মনাম?

Breast Tax: নিজের স্তন দুটো কেটে কলা পাতায় মুড়িয়ে এনে স্তন শুল্ক দিয়ে নাঙ্গেলি বলেন, "যে জিনিসের জন্য আমাকে অতিরিক্ত শুল্ক গুনতে হয়, সেই জিনিসই আমি রাখব না।"

সমাজ পিতৃতান্ত্রিক, সবারই জানা। এই পিতৃতান্ত্রিকতায় নারীর নিজস্ব স্থান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কাজ যে কতটা কঠিন তাও সবারই ভীষণভাবে জানা, ইতিহাসই তার সাক্ষী। প্রাচীন যুগের শাসকের চোখে অলঙ্কার, অর্থ, জমির মতো নারীও ছিল ভোগেরই বস্তু, অবস্থা এখনও বদলায়নি। যার হাতে যত বেশি ক্ষমতা, সেই নারীর অধিকার পাবে। মহিলাদের প্রতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে অথবা বৈষম্যের বিরুদ্ধে মহিলাদের পালটা ঘুরে দাঁড়ানো বা প্রতিবাদের ইতিহাসও নতুন কিছু নয়। কিন্তু নাঙ্গেলির কাহিনি একটু অন্য। নাঙ্গেলির নাম না শোনাই স্বাভাবিক। নাঙ্গেলি কোনও স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহন করেননি, কোনও বীর যোদ্ধাও ছিলেন না। কিন্তু ভারতীয় মহিলাদের জন্য তিনি যা করেছিলেন সেই ইতিহাস ভুলে যেতে পারে না দেশ, চাইলেও না।

প্রতি বছরই নারী দিবস পালিত হয় নারী অধিকার আন্দোলনের ইতিহাসকে স্মরণ করতে। এই নারী দিবসেই কেরল এমন এক নারীকে স্মরণ করে যিনি নিম্নবর্ণের দলিত সম্প্রদায়ের এবং নারীর আত্মমর্যাদার লড়াইয়ের পথে একাকী সেনানী ছিলেন। নিজের জীবন দিয়ে তিনি দলিত নারীদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

কাহিনির সূত্রপাত

অনেক কালের আগের কথা। আজ থেকে ঠিক ২২০ বছর আগে, সাল ১৮০৩, স্থান কেরলের চেরথালা। সমুদ্রের পাশে সাজানো গোছানো ছোট্ট একটা শহর। অস্পৃশ্যতা সেই সময় কেরলের অন্যতম বড় রোগ। ব্রাহ্মণ শ্রেণির সঙ্গে অন্য শ্রেণির ব্যবধান সমাজে বিষ ছড়াচ্ছিল। সেই সময় কেরলের রাজা ছিলেন ত্রিভাঙ্কুর। কিছু অদ্ভুত এবং নির্মম নির্যাতনের রীতি প্রচলিত ছিল কেরলে।নিম্নবর্ণের বা দলিত শ্রেণির মানুষকে শোষণ করতেন রাজা বিবিধ উপায়ে। যেমন, পুরুষদের গোঁফ রাখার উপর কর দেওয়ার রীতি ছিল। আবার নারীদের স্বাধীনভাবে অলঙ্কার পরার উপরও কর দিতে হত। আরও একটা নিয়ম ছিল যার চেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ ইতিহাস খুঁড়লেও মিলবে কী না সন্দেহ। নারীদের স্তন কর দিতে হত, যা স্থানীয় ভাষায় ‘মূলাক্করম’ নামে পরিচিত ছিল।

আরও পড়ুন- স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত ছবি মিত্তল || পুরুষদেরও হতে পারে এই রোগ?

কী এই স্তন কর?

মূলত দক্ষিণ ভারতের নিম্নবর্ণের হিন্দু মহিলারা গায়ে, বিশেষ করে বুকের উপর কোনও কাপড় দিতে পারবেন না। তাদের স্তন সব সময় উন্মুক্ত রাখতে হবে। যদি কেউ নিজের বুকের ওপর কাপড় জড়িয়ে রাখতে চায় তাহলে তাকে ট্যাক্স বা কর দিতে হবে। তবে সব হিন্দু মহিলাদের জন্য এই আইন প্রযোজ্য ছিল না। হিন্দুদের মধ্যে যারা উচ্চ বংশের তারা এই কর থেকে মুক্ত ছিল, তাদের বুকের উপর কাপড় দেওয়ার একচ্ছত্র অধিকার ছিল। নিম্নবর্ণের হিন্দু নারীরাই আইনের কবলে পড়ে শোষিত হত।

প্রতিবাদী নাঙ্গেলি

এবার আসা যাক আসল ঘটনায়। রাজা ত্রিভাঙ্কুরের সময়ে বলবৎ এই স্তন কর আইন বেশিদিন টেকেনি। নিম্নশ্রেণীর নারীদের প্রতিবাদেই ধ্বংস হয়েছিল এই আইন। আর এই আইন ভঙ্গের পেছনে যিনি সর্বেসর্বা ছিলেন তিনিই নাঙ্গেলি। ইজাভা সম্প্রদায়ের দলিত নাঙ্গেলি ছিলেন চেরথালা শহরের বাসিন্দা। শোনা যায়, ওই শহরের তরুণীরা সবসময় নিজেদের সৌন্দর্য নিয়ে বিব্রত থাকতেন। রাজার আদেশের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস তাদের ছিল না। দেহের সৌন্দর্যই জীবনের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

Mulakkaram-Breast-tax

অন্যদিকে নাঙ্গেলি ছিল একটু আলাদা। চেরথালার আনাচে কানাচে কান পাতলে শোনা যায়, বছর ৩৫-এর নাঙ্গেলি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। নিজের সৌন্দর্য নিয়ে কোনওমতে আপোস করতে রাজি ছিলেন না তিনি। তিনি আর তাঁর স্বামী চিরুকান্দান, দু'জনের ছোট্ট পরিবার। চাষ করেই দিন কাটে। দরিদ্র পরিবারের ভাত কাপড় জোটাতে চিরুকান্দানকে প্রায়ই বাড়ির বাইরে যেতে হতো। আর নাঙ্গেলি সর্বদাই নিজের স্তন ঢেকে রাখতেন। এই কারণে তাঁর স্তন কর জমেওছিল বিপুল। একদিন কর আদায়কারী কিছু লোক নাঙ্গেলির বাড়িতে আসে স্তন কর আদায় করতে। কিন্তু দিন আনতে পান্তা ফুরোয় নাঙ্গেলি সেই কর দিতে নারাজ।

এরপর আরেকদিন স্থানীয় এক শুল্ক কর্মকর্তা আবার নাঙ্গেলির বাড়িতে কর আদায় করতে এলে দেখে নাঙ্গেলি বুকের উপর কাপড় জড়িয়ে রেখেছে। তিনি নাঙ্গেলিকে কর শোধের জন্য চাপ দিতে লাগলেন। নাঙ্গেলির বিষয়টি মন্দিরের পুরোহিত এবং উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। দিনের পর দিন কর আদায়কারীরা নাঙ্গেলিকে কর দেওয়ার জন্য অতিষ্ঠ করে তোলে।

আরও পড়ুন- “জি-স্পটটা কোন দিকে?” সঙ্গিনীকে যৌনসুখ দিতে যা খুঁজছেন, তা কি আদৌ আছে?

শেষে একদিন নাঙ্গেলি কর দিতে রাজি হলেন। নির্দিষ্ট দিনে কর আদায়কারী কর্তা তার বাড়িতে কর নিতে এলে নাঙ্গেলি তাদেরকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ঘরের ভেতর যান। এরপর এক ধারালো অস্ত্র দিয়ে নিজের স্তন দুটো কেটে কলা পাতায় মুড়িয়ে এনে স্তন শুল্ক হিসেবে কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেন এবং বলেন, "যে জিনিসের জন্য আমাকে অতিরিক্ত শুল্ক গুনতে হয়, সেই জিনিসই আমি রাখব না।" বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় শুল্ক আদায়কারী সহ গ্রামের সকলে। স্তন কেটে ফেলার পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে নাঙ্গেলির মৃত্যু হয়। পুরো ভারতে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছিল এই ঘটনা। এর কিছুদিন পর রাজা ত্রিভাঙ্কুর স্তন কর সহ আরও নানা অবৈধ কর বাতিল করতে বাধ্য হন।

কিন্তু কাহিনি এখানেই শেষ নয়। শোনা যায়, যখন নাঙ্গেলির চিতার আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে সেই সময় এক ব্যক্তি দৌড়ে এসে সেই আগুনে ঝাঁপ দেন। তিনি নাঙ্গেলির স্বামী চিরুকান্দান। ভারতের ইতিহাসে এটাই হয়তো স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর সহমরণে যাওয়ার প্রথম ও শেষ ঘটনা। ইতিহাস এই প্রেমিক পুরুষের নাম খোদাই করার তাগিদই অনুভব করেনি।

নিজের অজান্তেই নাঙ্গেলি ভারতের মেয়েদের মধ্যে নিজের শরীরের অধিকার নিয়ে চিন্তার বীজ বপন করে যান। যে প্রতিবাদ আর চোখে চোখ রেখে কথা বলার আগুন নাঙ্গেলি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তা আজও জ্বলজ্বল করছে। স্তন কর ছিল দলিত শোষণের এক নগ্ন প্রকাশ। সমাজের প্রান্তিক মানুষের অসহয়তার সুযোগ নিয়ে দমনপীড়ন। নাঙ্গেলির প্রতিবাদের আঁচ বাঁচিয়ে রেখেছেন লীনা আম্মাও। নাঙ্গেলির উত্তরাধিকারি তিনি। নাঙ্গেলির বোনের নাতনি লীনা আম্মা আজও গর্বের সঙ্গে এই বীরাঙ্গনার কথা সকলের সামনে তুলে ধরেন।

 

More Articles