আখ্যান যা বলে || কেন বাঁশি হাতেই দেখা যায় কৃষ্ণবিগ্রহ, কেনই বা ময়ূরপালক তাঁর প্রিয়
শ্রীকৃষ্ণের কিন্তু একটি বাঁশি ছিল না। তিনি তিন রকমের বাঁশি ব্যাবহার করতেন। একটি বেণু, অন্যটি মুরলী, আর আরেকটি বংশী।
জন্মাষ্টমী মানে কৃষ্ণের জন্মদিন। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আখ্যান বলছে, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথিতে দুষ্টের দমনে ও শিষ্টের পালন এবং ধর্ম রক্ষার জন্য মহাবতার ভগবান রূপে তার জন্ম হয়। পুরাণচর্চাকারী এবং ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, ১৫০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম হয়। আখ্যানকাররা দেখান, অসুরদের অত্যাচার বেড়ে চলার কারণে বাধ্য হয়ে তারা বিষ্ণুর শরণাপ্রার্থী হলে তিনি দৈববাণী দেন, খুব তাড়াতাড়ি তিনি যদুবংশীয় রাজার রাজধানী মথুরার রাজা সুরসেনের পুত্র বসুদেবের সন্তান রূপে দেবকীর অষ্টম গর্ভ এ জন্ম নেবেন।
সেই আখ্যান সবার জানা। ক্ষমতালোভী কংস তার বাবাকে বন্দি করে নিজে সিংহাসনে বসলেন। আর তার বোন দেবকীর সঙ্গে তার বিশ্বস্ত বন্ধু বাসুদেবের বিবাহ দিলেন। কিন্তু বোনের বিবাহের পর তিনি দৈববাণী পান যে তার বোনের গর্ভের অষ্টম সন্তান তার মৃত্যুর কারণ হবে। ক্রোধের বশে কংস দেবকীকে হত্যা করতে গেলে বাসুদেব বলেন তার গর্ভের সব সন্তান সে কংসের হাতে তুলে দেবে। এরপর তাদের জায়গা হয় কারাগারে। সেই কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থাতেও দেবকীর অষ্টম সন্তান শ্রীকৃষ্ণ কীভাবে জন্মের পরই কারাগার ভেঙে নিজেকে মুক্ত করেছিল আর পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিল সে কথা কৃষ্ণভক্তদের জানা।
জন্মাষ্টমী উপলক্ষে হিন্দু গার্হস্থ্যে আজ ধূমধাম। গোপালের জন্মদিন বলে কথা। আজ গোপালকে সাজিয়ে গুছিয়ে হাতে বাঁশি দিয়ে, মাথায় ময়ূরের পেখম দিয়ে সাজানো হয়। এই দুটো জিনিসই যে তার বড় প্রিয়। কিন্তু জানেন কি কৃষ্ণের যেই বাঁশির আওয়াজ শুনে বৃন্দাবনের সকলে মোহিত হয়ে যেত, সেই বাঁশি কীভাবে কৃষ্ণের হতে এসেছিল? আখ্যান বলে, শ্রীকৃষ্ণ যথারীতি তার বাল্য লীলায় ব্যস্ত। খেলতে খেলতে দেখলেন নদীর পাড়ে একজন বৃদ্ধ বাঁশি বাজাচ্ছেন এবং বিক্রি করছেন। তার ওই বাঁশির সুর এতই পছন্দ হয় যে তিনি ওই বৃদ্ধের কাছে গিয়ে বলেন যে, আপনার বাঁশির সুর খুব সুন্দর, আপনি কি আমাকে বাঁশি বাজানো শেখাবেন? তখন বৃদ্ধ লোকটি বললো যে, তুমি তো খুব ছোট, তুমি বাঁশি বাজাতে পারবে না। এই শুনে শ্রীকৃষ্ণের প্রায় কান্নার জোগাড়। শ্রীকৃষ্ণের এমন লীলা দেখে তো স্বর্গের সব দেব-দেবতা হাসছেন। না যার কাছে সব কিছু নতজানু হয়, তিনি নাকি বাঁশি শেখার জন্য কাঁদছেন। বৃদ্ধ আর কী করবেন তিনি কৃষ্ণের ওই কান্না মুখ দেখে একটু দয়া হল, তিনি বললেন ঠিক আছে আমি তোমাকে বাঁশি বাজানো শেখাব কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। আমি ঠিক যেভাবে বাঁশিতে ফুঁ দেব তুমিও ঠিক সেই ভাবেই বাঁশিতে ফুঁ দেবে। কৃষ্ণ রাজি হয়ে গেলেন। বয়স্ক ব্যক্তি যখনই বাঁশিতে ফুঁ দিলেন কৃষ্ণও তাই করলেন। আর শ্রীকৃষ্ণের সেই বাঁশির সুর শুনে সমস্ত জগৎ সংসার বিমোহিত হয়ে গেল। তখন সেই বৃদ্ধ লোকটি ভাবলেন এই বালক কোনও সাধারণ বালক নয়, কৃষ্ণ যখন বাঁশি বাজাতে ব্যস্ত তিনি তখন তার পা ধরে শুয়ে পড়লেন। এইভাবেই শ্রী কৃষ্ণের হাতে বাঁশি এল।
তাই বলে শ্রীকৃষ্ণের কিন্তু একটি বাঁশি ছিল না। তিনি তিন রকমের বাঁশি ব্যাবহার করতেন। একটি বেণু, অন্যটি মুরলী, আর আরেকটি বংশী। বেণু অত্যন্ত ছোট, তাতে ৬ টি ছিদ্র আছে। মুরলীর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৮ ইঞ্চি এবং তাতে ৫ টি ছিদ্র আছে। বংশী প্রায় ১৫ ইঞ্চি, তাতে ৯ টি ছিদ্র থাকে। শ্রী কৃষ্ণ প্রয়োজন অনুসারে সেই বাঁশি বাজাতেন।
শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি নিয়ে আরেকটি কাহিনিও প্রচলিত। খেয়াল করে দেখবেন শ্রীকৃষ্ণের বাঁশির একটা মাথা একটু মোড়ানো থাকে। অনেকে ভাবেন এই মোড়ানো অংশটা ময়ূর আসলে কিন্তু তা নয়। এই পেঁচিয়ে থাকা অংশটি হল মকর মাছ। কিন্তু কীভাবে এই মকর মাছ কৃষ্ণের বাঁশিতে স্থান পেয়েছিলেন?
কৃষ্ণলীলা করতে করতে বেড়ে উঠছিল নন্দ রাজার গৃহে। সে সবার আদরের, সকলের চোখের মণি। একদিন মা যশোদা ভুল করে একাদশীর দিন ভাত রান্না করে ফেললেন। রান্নার পর মনে পড়ল আজ তো কেউ অন্ন ছোঁবে না তাহলে এতগুলো ভাত কী হবে? চিন্তিত হয়ে মা যশোদা বাড়ি থেকে অন্ন নিয়ে বেরিয়ে দেখলেন মানুষ তো দূর কোনও পশু পাখিও সেই অন্ন গ্রহণ করছে না। ভাবতে ভাবতে তিনি এক জলাশয়ের ধারে বসলে দেখতে পেলেন জলে এক মকর মাছ ঘুরছে। তিনি মকর মাছের কাছে গিয়ে তার অন্ন খেয়ে নেবার আবদার জানলে মকর মাছ জানায়, সে মায়ের অন্ন খেয়ে নেবে কিন্তু একটা শর্ত আছে। কী সেই শর্ত ? একাদশীর দিন অন্ন খেলে সে সহস্র পাপের অধিকারী হবে আর সেই পাপ মোচন করতে গেলে তার কৃষ্ণের সাহায্যের দরকার। কৃষ্ণ যদি তার বাঁশিতে মকর মাছকে স্থান দেয় তাহলে সে পাপ মুক্ত হবে। মা যশোদা রাজি হলেন আর বললেন তুমি অন্ন গ্রহণ কর আমি কথা দিচ্ছি কৃষ্ণের বাঁশিতে তোমার স্থান হবে।
অন্নগ্রহণের পর যশোদার সঙঅঘএ মকরও গেল কৃষ্ণের কাছে। কৃষ্ণের নিকট গিয়ে মা যশোদা বললেন একাদশী তিথিতে ভাত রান্না করে আমি পাপী হয়েছি আর মকর মাছ আমার অন্ন খেয়ে আমাকে পাপ মুক্ত করেছে কিন্তু নিজে সহস্র পাপের অধিকারী হয়েছে। তুমি এই মকর মাছকে তোমার বাঁশিতে স্থান দাও, আর তাকে পাপ মুক্ত কর। তখন শ্রীকৃষ্ণ বললেন, আজ থেকে মকর মাছ সর্বদা আমার বাঁশিতে থাকবে। যেখানেই কৃষ্ণের বাঁশি থাকবে সেখানেই মকর মাছ থাকবে, মকর ছাড়া কৃষ্ণের বাঁশি অসম্পূর্ণ। এই ভাবেই কৃষ্ণের বাঁশিতে স্থান পেল মকর মাছ।
এবার আসা যাক আরেকটি কাহিনিতে। কৃষ্ণের প্রিয় ময়ূর পালক। কৃষ্ণের রূপ তার বাঁশির সুরের মতোই মনোমুগ্ধকর। মেঘের মতো দেখতে সুপুরুষ ব্যক্তি। আর ঠোঁটে সবসময় যেন একটা দুষ্টু হাসি লেগেই আছে। আর কৃষ্ণের রূপের বর্ণনায় সবথেকে সেরা অংশ হল তার মাথায় শোভা পাওয়া ময়ূরের পালক। কিন্তু কী তাৎপর্য আছে কৃষ্ণের মাথায় ময়ূরের পালকের -
পুরাণে কৃষ্ণের মাথায় এই ময়ূরের পালক নিয়ে অনেক কাহিনি তুলে ধরা আছে। বলা হয়, এক মনোরম পরিবেশে দুপুর বেলা নিজের মনে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। অপূর্ব সেই সুর। সেই সুরে মোহিত হয়ে সব প্রাণী উচ্ছ্বসিত হয়ে নাচতে শুরু করেন, তার মধ্যে ময়ূরও ছিল। বাঁশির সুর বন্ধ হলে ময়ূরের দল কৃষ্ণের দিকে এগিয়ে আসলে ময়ূরের সব পালক ঝরে পড়ে। কৃষ্ণকে এই সব পেখম গুরুদক্ষিণা হিসেবে দান করা হয়। কৃষ্ণ খুব আনন্দের সাথে এই উপহার গ্রহণ করেন এবং জানান যে উনি এই পালক চিরকাল তার মাথায় স্থান দেবেন এবং অন্য কোনো প্রাণীর পালক সেই স্থান নিতে পারবে না।
ময়ূরের পালক নিয়ে আরেকটি কাহিনি বর্ণনা করা যাক। বিষ্ণু দেবী পার্বতীর ভাই হিসেবে ধরা হয়। শাস্ত্রে আছে যে বিষ্ণু বিয়ের সম্পর্কে দেবী পার্বতীকে মহাদেবের কাছে দান করেন। তাই একদিক থেকে দেখতে গেলে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ যিনি কিনা বিষ্ণুর অবতার, তিনি কার্তিকের মামা বটে। আর শ্রীমান কার্তিকের বাহন হল ময়ূর। মানা হয় যে ভগবান কৃষ্ণ ময়ূরের পেখম নিজের মাথায় সাজান যাতে, যুদ্ধের দেবতা কার্তিক নিজের সকল প্রয়াসে সফল হতে পারে।

Whatsapp
