ভারতের এই গ্রামে বিচার হয় স্বয়ং দেবতাদের! কড়া শাস্তি পান দেবদেবীরা
Bhangaram Devi Mandir: রায় ঘোষণা করা হলে সেই দেবী বা দেবতার মূর্তিকে মন্দির থেকে বের করে এনে একটি খোলা জায়গায় নির্বাসনে রাখা হয়।
নানা ধর্মের, নানা সংস্কৃতির, নানা মানুষের মিলনক্ষেত্র ভারতবর্ষ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এমন অনেক সংস্কৃতি থাকে, এমন অনেক লোকাচার থাকে যা সম্বন্ধে সেই অঞ্চলের মানুষ ছাড়া বাইরের মানুষ খুব একটা জানেন না। কয়েকদিন আগে আপনাদের এমনই একটি সংস্কৃতির কথা বলেছিলাম, অসুর পুজো! দুর্গাপুজোর সময় অসুরের বংশধররা অসুরের শোকসভা পালন করে থাকেন। সেই সময় তাঁরা বাড়ি থেকে বের হতে চান না পাছে তাঁদের অনিষ্ট হয়। যদিও সময় এখন পাল্টেছে, তাঁরাও লেখাপড়া শিখেছেন, আধুনিক হয়েছেন। ফলত সেই পূর্ববর্তী ছুৎমার্গ এখন আর নেই। তাঁরাও আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই পুজোর আনন্দ করেন। আজও এমন আরেকটি লোকাচারের কথাই বলব যা অনেকেই আগে কোনদিনও শোনেননি।
আজও যখন দু’পক্ষের মধ্যে বিবাদ হয় কোনও বিষয় নিয়ে, কোনও এক পক্ষকে মাঝেমধ্যেই বলতে শোনা যায়, কোর্টে দেখে নেব। কোর্ট বা আদালতের কাজ বিচার করা এবং ন্যায় সিদ্ধান্ত নেওয়া। কোর্টে মূলত মানুষে মানুষেই মামলা-মোকদ্দমা হয়। বিচারও হয় মানুষেরই। কিন্তু কখনও কি শুনেছেন আদালতে ভগবানের বিচার হচ্ছে? ভগবানের আবার বিচার হয় নাকি? আজ্ঞে হ্যাঁ, হয়, আমাদের ভারতেই হয়।
ছত্তিশগড়ের একটি জেলা দান্তেওয়াড়া। মাওবাদী কার্যকলাপের জন্য প্রায়ই সংবাদ শিরোনামে থাকে এই জেলা। এই দান্তেওয়াড়ার কাছেই আরেকটি জেলা হল বাস্তার। বাস্তার জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে খারকাই নদী যা নিজের মধ্যে সোনা বহন করে নিয়ে চলে। বাস্তারের একটি ছোট্ট গ্রাম কেশকাল নগর। এই গ্রামেই রয়েছে ভাঙ্গারাম দেবীর মন্দির। আশেপাশের পঞ্চান্নটি গ্রামে পূজিত হন এই দেবী। স্থানীয়দের মতে খুবই জাগ্রত তিনি। প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহে এই মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় যাত্রা। আশেপাশের নয়টি পরগনার মোট পঞ্চান্নটি গ্রামের থেকে হাজার হাজার মানুষ আসেন এই যাত্রা দেখতে। যাত্রার পর সারারাত ধরে চলে দেবীর বিচার সভা। তারপর সকালবেলা ঘোষণা করা হয় রায়। কখনও দেবতারা বেকসুর খালাস পেয়ে যান, কখনও আবার তাদের ভাগ্যে জোটে শাস্তি।
আরও পড়ুন- সারা কালনা অন্ধকারে ডুবিয়ে নিরঞ্জন হয় প্রতিমার! অবাক করবে মহিষমর্দিনীর ঐতিহ্য
এই উৎসবে আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ আসেন এবং পুজো দেন। এরপর দেবীর কাছে গিয়ে এক এক করে দেবী দেবতাদের বিরুদ্ধে নিজেদের অভিযোগ জানান। কেমন অভিযোগ? ধরা যাক, কেউ অসুস্থ হয়েছেন। তার বাড়ির লোক দেবতার কাছে প্রার্থনা করেছেন মানুষটিকে সুস্থ করে দেওয়ার জন্য। ঠাকুর যদি তাকে সুস্থ না করেন তাহলে ঠাকুরের বিরুদ্ধে বিচার হয় ওই উৎসবে। শুধু তাই নয়, ভাল চাষবাস না হলে, বা দেবতা কোনও মনস্কামনা পূর্ণ না করলেও সেই দেবতার বিরুদ্ধে নালিশ করা হয় ভাঙ্গারাম দেবীর কাছে। স্থানীয়দের কথায়, ভাঙ্গারাম দেবীর মন্দিরের পুরোহিতের মধ্যে দেবী প্রবেশ করেন। এরপরই দেবী রায় ঘোষণা করেন। অপরাধের উপর নির্ভর করে হয় শাস্তির প্রকারভেদ। কখনও মন্দির থেকে ছয় মাসের নির্বাসন তো কখনও বা অনন্তকালের জন্য নির্বাসন, আবার কখনও নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ারও নিদান দেওয়া হয়। দেবী যেরকম নির্দেশ দেন সেরকমই পালন করেন ভক্তরা। নির্বাসনের রায় ঘোষণা করা হলে সেই দেবী বা দেবতার মূর্তিকে মন্দির থেকে বের করে এনে একটি খোলা জায়গায় নির্বাসনে রাখা হয়। সেক্ষেত্রে মূর্তির গায়ের থেকে গয়না সব খুলে মন্দির কর্তৃপক্ষ নিজের কাছেই রাখে এবং ঘোষিত সময় অনুযায়ী নির্বাসন দেওয়া হয় ওই দেবী বা দেবতাকে।
নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হলে ঠাকুরকে আবার মন্দিরে স্থাপন করা হয়। এরপর দেব-দেবীদের নিজেদের ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। তারা জনকল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিলেই মন্দিরে প্রবেশ করানো হয় তাদের। এবার স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে দেবী বা দেবতা কীভাবে প্রতিশ্রুতি দেবেন সাধারণ মানুষকে? মনে করা হয় ভাঙ্গারাম দেবীর মন্দিরের পুরোহিতের স্বপ্নে এসে ঠাকুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করেন, ওই মন্দিরের পুরোহিতের মধ্যে দৈব ক্ষমতা রয়েছে। যে কোনও সমস্যার সমাধানের জন্য গ্রামবাসীরা সর্বপ্রথম মন্দিরের পুরোহিতের পরামর্শই নেন। প্রতিদিন ওই মন্দিরে হাজার হাজার ভক্ত নিজেদের সমস্যা নিয়ে আসেন এবং সমাধানের জন্য পুরোহিতদের সাহায্য নেন। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, প্রতিবছর ভাদ্র মাসের শেষ সপ্তাহে ভাঙ্গারাম দেবীর মন্দিরে এই যে যাত্রা এবং বিচারসভা অনুষ্ঠিত হয়, এখানে নারীদের প্রবেশ নিষেধ। এমনকি এই পুজোর প্রসাদও নাকি নারীদের খেতে নেই, এমনটাই নিয়ম।
আরও পড়ুন- ২৭৩ বছরের রীতি অমলিন, এই পুজোয় পান্তাভাত আর কচু শাকের ভোগেই সন্তুষ্ট দুর্গা
ভাঙ্গারাম দেবীর মন্দির নিয়ে একটি লোককথা প্রচলিত আছে স্থানীয় এলাকায়। শোনা যায়, বাস্তারের রাজার স্বপ্নে দেবী দৈবাদেশ দিয়েছিলেন। দেবী রাজাকে বলেছিলেন যে তিনি তাঁর রাজ্যে প্রবেশ করতে চান। এই স্বপ্নাদেশ পেয়ে রাজা তাঁর প্রজা সমেত গেলেন গ্রামের সীমান্তে দেবীকে বরণ করে আনতে। কিন্তু এই সময়ে হঠাৎ প্রবল ঝড়ের উদয় হয়। ঝড়ের মধ্যেই দেখা যায় একজন ব্যক্তি ঘোড়ায় চেপে আসছেন। মনে করা হয়, দেবী প্রথমে ঘোড়ায় চড়ে একজন পুরুষের রূপে আবির্ভূত হন এবং তারপরে একজন নারীর রূপ ধারণ করেন। কেশকাল গ্রামের এই উপত্যকায় যেখানে দেবী প্রথম আবির্ভূত হয়েছিলেন সেখানেই তৈরি করা হয় দেবীর এই মন্দিরটি।
এক্ষেত্রে ছত্রিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী ভূপেশ বাঘেলের কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। ভুলেও ভাববেন না যে তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক রয়েছে বা সাক্ষাৎ হয়েছে কখনও। সম্প্রতি একটি জনপ্রিয় ইউটিউব চ্যানেলে ইন্টারভিউয়ের সময় তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় ছত্তিশগড়ের এমন একটি দিক গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে যা ছত্তিশগড়বাসী ছাড়া আর কেউ জানেন না। তখনই তিনি এই সম্পূর্ণ ঘটনাটির কথা উল্লেখ করেন এবং সেখান থেকেই এই লেখার জন্ম।