স্কুটার বিক্রির টাকায় প্রথম বাস, স্বপ্ন দেখতে জানলে কতদূর যাওয়া যায়, দেখিয়েছে শ্যামলী পরিবহণ

পরিবহণ ব্যবসায় নামার পর ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। গণেশচন্দ্র ঘোষ এখন নিজেই একটা সফল প্রতিষ্ঠানের নাম। তাঁর হাত ধরে জন্ম নিয়েছে আজকের বিলাসবহুল বাস সফর `শ্যামলী পরিবহণ’। একদিন স্কুটার বিক্রির টাকায় কেনা হয়েছিল শ্যামলী পরিবহণের প্রথম বাস। সেই বাস প্রথম সফর শুরু করে বাংলাদেশের  রাজশাহী-নগরবাড়ি সড়কে। শ্যামলী পরিবহণ এক লড়াইয়ের নাম।

 

এই সাফল্যের আখ্যান খুললে দেখা যায় এক স্কুটার চালকের স্বপ্নের উড়ান পাড়ি দিয়েছিল প্রথমে বাংলাদেশের পথে পথে। আজ তা আন্তর্জাতিক চেহারা নিয়েছে। শ্যামলী পরিবহণ আজ শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের নানা অঞ্চলে পৌঁছে যায় শ্যামলীর বাস। 

 

সালটা ১৯৭২। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। অবিনাশচন্দ্র ঘোষ তাঁর বিরাট পরিবার নিয়ে থাকতেন পাবনা শহরে। ১৩ জন সদস্যের পরিবার, জীবন চালানোই ছিল এক সংগ্রাম। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র গণেশচন্দ্র ঘোষ তখন এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র। পরিবারের অর্থনৈতিক দায় এসে পড়ল তাঁর কাঁধে। কিছু টাকা জমিয়ে ১৯৭২ সালে তিনি একটি স্কুটার কিনে ফেললেন। তারপর পাবনা-সুজানগরের রাস্তায় বাণিজ্যিকভাবে তিন চাকার স্কুটার চালাতে শুরু করলেন। সেই ভাড়াতেই সংসার চলত তাঁদের। 

 

প্রতিদিনের উপার্জিত অর্থ জমাতে শুরু করলেন। নতুন ব্যবসার স্বপ্ন দেখলেন তিনি। গণেশচন্দ্র পড়া ছাড়েননি। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে পড়তেন স্কুটার নিয়ে। ধীরে ধীরে পয়সা জমিয়ে কয়েকটি নতুন স্কুটার কিনলেন। এভাবেই শুরু হল শ্যামলী পরিবহণের পথচলা। স্কুটারের সংখ্যা যতই বাড়ল, ততই সেটি একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হল। ২ বছর বাদে তিন চাকার স্কুটারগুলো বিক্রি করে সেকেন্ড হ্যান্ড বাস কিনে ফেললেন গণেশচন্দ্র। সেই বাসই জন্ম দেয় সাফল্যের। আজ শ্যামলী সফর করছে ভারতেও। 

 

রাজশাহী থেকে নগরবাড়ি পর্যন্ত চালানো হত পুরনো ওই বাসটি।বাস চালিয়ে উপার্জিত অর্থ, পরিবারের সদস্যদের সোনার গয়না বিক্রির অর্থ এবং সোনালী ব্যাংক পাবনা জেলা শাখা থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় ১৯৭৮ সালে কেনা হয় চকচকে একটি নতুন বাস। সেদিনই পূরণ হয় গণেশচন্দ্রের নতুন বাস কেনার স্বপ্ন। তখন থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপর বছরে বছরে কেনা হয় নতুন নতুন বিলাসবহুল আধুনিক বাস।

 

১৯৭২ থেকে ৪৪ বছর পেরিয়েছে। আজ পরিবহণ পরিষেবা ক্ষেত্রে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী গণেশ চন্দ্র ঘোষ। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও চলে তিল তিল করে গড়ে তোলা শ্যামলী পরিবহণের বাস। দেশে-বিদেশে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার টিকিট কাউন্টার। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাখো মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে এই পরিবহণে। বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিধি ক্রমে বেড়েই চলেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ ভারতের উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার সর্বত্র চলে শ্যামলী পরিবহণের বাস।

 

আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে ঢাকা-কলকাতা, আগরতলা-ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি-ঢাকা, ঢাকা-বুড়িমারি-শিলিগুড়ি, চট্টগ্রাম-ঢাকা-কলকাতায় (ট্রানজিট) চলছে শ্যামলীর বাস। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ করপোরেশনের (বিআরটিসি) সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক রুটে চালানো হচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ১০টি অত্যাধুনিক বাস। দেশের অভ্যন্তরে শ্যামলী ব্র্যান্ডের বাসের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪০০। এর মধ্যে অর্ধশত বাস শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।

 

এখন দেশে-বিদেশে শ্যামলী পরিবহণ একটি ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। তাদের আধুনিক একটি চেয়ার কোচের দাম ৭০ লাখ টাকা। অত্যাধুনিক বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি বাসের দাম দেড় কোটি থেকে পৌনে দুই কোটি টাকা।  শ্যামলীও আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ।

 

প্রজ‌ন্মের সিঁড়ি বেয়ে শ্যামলী পরিবহণের ব্যবসা ছে‌লে রা‌কেশ ঘো‌ষের হা‌তে।  আরও দক্ষ ও পু‌রোদস্তুর প‌রিবহণ ব্যবসায়ী হ‌য়ে আগের চে‌য়ে বিস্তৃত পরিসরে ছ‌ড়ি‌য়ে‌ছেন ব্যবসা। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে শ্যামলী ডানা মেলেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও।

 

আরও পড়ুন-ফের বিশ্বকে অতিমারীর অন্ধকারে ঠেলে দেবে চিন?

 

২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন বাবা তাঁকে শ্যামলী বাসের ব্যবসায় জড়ান। গণেশচন্দ্র লড়াই করে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেছেন। তাই ছেলেকেও তিনি মূল্যবোধের পাঠ দিয়েছেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, রাকেশ ঘোষ বাস মালিক হয়েও হেলপার, চালক, সুপারভাইজর সবাইকে 'কাকা' সম্বোধনে ডেকে মাতিয়ে রাখেন। বিনিময়ে পেয়েছেন সবার অকুণ্ঠ ভালোবাসা। 
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আর এক যোগাযোগের মাধ্যম ভারত সরকারের `সৌহার্দ্য’। কলকাতা-ঢাকা রুটে ভারত সরকারের বাস পরিবহণ মাঝখানে বন্ধ ছিল। করোনার কারণে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল দুই দেশের মধ্যেকার সেতু। করোনার দমক কমেছে। স্বাভাবিক হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত। করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘ দুই বছর বন্ধ ছিল। করোনা আবহে ২০২০ সালের ১২ মার্চ থেকে দুই দেশের মধ্যে এই বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর লকডাউন ও সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে তা আর চালু হয়নি। কিন্তু ফের দুই বছর পর গতি পাচ্ছে বাসসফর। স্বাভাবিক হচ্ছে যাত্রাপথ। 

 

আরও পড়ুন-কী ভাবে গাড়ি চালালে বাঁচবে পেট্রল? রইল মোক্ষম নিদান

 

দারিদ্রকে তিনি জয় করেছেন। দেখিয়ে দিয়েছেন পরিশ্রমকে পুঁজি করে স্বপ্নের উড়ান উড়তে পারে। তবে গণেশচন্দ্রের চলার পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। শ্যামলী পরিবহণের সাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লড়াইয়ের আখ্যান। প্রায় ৫০ বছর আগে একটি জীর্ণ পুরাতন তিন চাকার স্কুটার থেকে একটি চকচকে নতুন বাস কেনার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। তাঁর সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আজ ব্র্যান্ডনেম শ্যামলী।

 

পাবনা শহরের শালগাড়িয়ার অভাবী ঘরের সেই গনেশচন্দ্র ঘোষ আজ গোটা দেশের পরিবহণ ব্যবসার এক দিকপাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সেই জীর্ণ স্কুটারটি যেন এক চারাগাছ, যা এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে। সেই চারাগাছ রোপন করেছিলেন গনেশচন্দ্র ঘোষ। শ্যামলীর চাকা গড়িয়েছে প্রতিবেশী ভারতে। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের পরিবহণ শিল্পের ইতিহাসে এক সাফল্যের অধ্যায় লেখা হয়ে থাকল গণেশচন্দ্র ঘোষকে ঘিরে। তিনি পাবনার মাটিতে যে চারাগাছ রোপন করেছিলেন, আজ সেই গাছের শাখা প্রশাখা ভারতেও বিস্তৃত।

More Articles