লাইফ ইজ় বিগার দ্যান দ্য কোর্ট
Sunil Chhetri: অন্য খেলার বা বলিউডি মহীরূহরা কিন্তু রাজপ্রাসাদের ঝুলবারান্দায় না হোক, গোপন কোনও কুঠুরিতে বসে নিভৃতে ল্যুট বাজাচ্ছিলেন বোধহয় তখন। সুনীলের কি ভয় ছিল না?
সম্প্রতি আমেরিকার ডার্টমথ কলেজ সাম্মানিক ডিগ্রি দিয়ে অভিবাদন জানাল রজার ফেডেরারকে। সম্মাননা জ্ঞাপনের পর ফেডেরার ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলেন। ইন্টারনেট উত্তাল তা নিয়ে। খুব স্বাভাবিক। ফেডারার সেখানে যা বলেছেন, তার অনেক কিছুই আমরা আগেও নানা গুণীজন বা ভাবুকের মুখে শুনেছি। ফেডেরার মুগ্ধ করেন তা-ও। সেটা তাঁর ক্ষমতা। কিন্তু ইন্টারনেট কেন উত্তাল হল এমনতরো ‘জানা’ কথায়? তুখোড় রূপে ছক-ভাঙা কথা তো তিনি কিছু শোনাননি? ঠিকই, কিন্তু ফেডেরার যা করলেন, তা হল রকেট-স্পিডে ক্রমশ শুষ্ক, অনউর্বর হয়ে ওঠা একটি আবহে, শান্ত ও দৃপ্ত কণ্ঠে তিনি গত জন্মের নিশান ওড়ালেন। বললেন, ‘এফর্টলেস ইজ় আ মিথ’, বললেন ‘ইট্স ওনলি আ পয়েন্ট, পারফেকশন ইজ় ইম্পসিবল’, বললেন ‘লাইফ ইজ় বিগার দ্যান দ্য কোর্ট’…
এই শেষ কথাটি নিয়ে আরও খানিক বললেন ফেডেরার। ‘ডার্টমথ-এ তোমরা যখন যে কোনও বিষয় নিয়েই মেজর করছো, তার অর্থ তোমরা সে বিষয়ে আরও কত গভীরে ঢুকছো। কিন্তু তার তো আরও এক অর্থ রয়েছে, তোমাদের জ্ঞানের বিস্তৃতি এক লাফে কতটা বেড়ে যাচ্ছে। তোমরা শুধু একটি ক্ষেত্রেই আটকে থাকছ না। ইঞ্জিনিয়ারেরা আর্ট হিস্ট্রি পড়ছে, এক জন কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট জার্মান শিখছেন, এক জন দৌড়বিদ আকাপেলা গাইছেন… এখানেই তো শিক্ষার সার্থকতা। আমার তো মনে হয় এই ভাবে পরিচিত চৌহদ্দিকে ছাড়িয়ে, নির্ভয়ে ডিঙিয়ে নতুন ও অজানা এক প্রান্তরের খোঁজে নেমে পড়ার উত্তেজনাই তো জীবনকে অন্য এক মাত্রা দেয়।’
আরও পড়ুন: রোনাল্ডো আর মেসির পরেই সুনীল ছেত্রী! দেশকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ৩৯-এর তেজি ঘোড়া
সুনীল ছেত্রীকে নিয়ে লেখায়, তাঁকে উদযাপন করার সংখ্যায়, ফেডেরার দিয়ে বেশ কিছুটা কাটিয়ে দেওয়ার মুখ্য এক কারণ, উপরে উল্লিখিত ফেডেরারের কথার সঙ্গে সুনীলের ফুটবল-যাপন কার্যক্রমের এক নিবিড় যোগ, আমার মতে। সুনীল ক'টা ম্যাচে কটা গোল করেছেন, ফুটবল ইতিহাসে অতএব তাঁর কোথায় জায়গা, ক্লাব ফুটবলেও তিনি কেমন করে চমৎকৃত করে ছেড়েছেন আমাদের সকলকে, এ সব আজ থাক। পাঠক নির্ঘাৎ জানেন সে সব জেনে নেওয়ার অজস্র উপায় রয়েছে। ফলে ও সবে আমি যাচ্ছি না। আমার মনে হয় সুনীল ফুটবল টেকনিক বা স্ট্যামিনার বাইরে যা যা করে গিয়েছেন, তার জন্যে সমানতালে তো বটেই, মনে হয় অধিক সমাদৃত হওয়ারও দাবি রাখেন। কারণ তিনি বারে বারে দেখিয়েছেন, লাইফ ইজ় বিগার দ্যান দ্য কোর্ট। বিশ্বাস করেছেন বলেই তো। তাই তো চরম লাঞ্ছনা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সাক্ষী মালিকদের যখন রাস্তায় ফেলে হেনস্থা করা হয়, সুনীল প্রতিবাদে মুখর হন। অন্য খেলার বা বলিউডি মহীরূহরা কিন্তু রাজপ্রাসাদের ঝুলবারান্দায় না হোক, গোপন কোনও কুঠুরিতে বসে নিভৃতে ল্যুট বাজাচ্ছিলেন বোধহয় তখন। সুনীলের কি ভয় ছিল না? আন্তর্জাতিক কেরিয়ার তো ভারতীয় ফুটবলে ঠিক সে অর্থে টগবগে বলা যায় না, তবুও। সুনীল নিশ্চিত ভাবেই আবার সেই অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদের মতো ‘ইট্স ওনলি আ পয়েন্ট’ বা ‘লাইফ ইজ় বিগার দ্যান দ্য কোর্ট’ শব্দবন্ধে অটল বিশ্বাস রেখেছিলেন। খেলার স্পিরিট নিয়ে বড় কথা হয়, সত্যিই তো খেলা অন্য এক স্পিরিটের জন্ম দেয় ধমনিতে। কিন্তু কত জন সেই স্পিরিটে ভর করে মাঠের সীমানা পেরিয়েও নিজ জীবন চালিয়ে যেতে পারেন? ফলে কোথাও একটা একই সঙ্গে মাঠের জীবন ও মাঠ-পরবর্তী জীবন এক আবার আলাদা-ও হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকছে।
অর্থাৎ বলতে চাইছি, সুনীল যখন খেলতে খেলতে শেখা একটা অদম্য স্পিরিটকে খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে অন্যত্র কাজে লাগাচ্ছেন, তখন অন্তত ওই প্রতিবাদের ক্ষেত্রে, তিনি ওই স্পিরিটের প্রতি সৎ থাকছেন আবার ঠিক সে স্পিরিটের প্রতি সৎ থাকছেন বলেই, নিজের বিপদও ডেকে আনছেন, প্রতিষ্ঠানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে। সুনীল তার মানে ধরে নিতে পারি, মাঠের খেলা সজ্ঞানে আলাদা নিয়মকানুনওলা অন্য এক মাঠেও খেলছেন। এখানেই সুনীল সম্ভবত প্রকৃত রোল মডেল হয়ে উঠছেন। বা ধরুন কোভিড-কালে সুনীল তৎকালীন টুইটারে লিখলেন যে তিনি নিজের হ্যান্ডেলটা ‘রিয়েল লাইফ হিরো’-দের জন্যে ছেড়ে দিচ্ছেন, যাতে ওই অন্ধকার সময়ে জীবন বাজি রেখে যাঁরা মাঠেময়দানে কাজ করছেন, তাঁদের এক অর্থে অন-গ্রাউন্ড সাপোর্ট হয়। একটা প্রকৃত কাজের কাজ হয় যাতে, এটাই সুনীলের মুখ্য চিন্তা থাকছে তখন। আবার বলছি, এটা শুনতে বড় সহজ মনে হচ্ছে, যে হ্যাঁ এমনটাই তো হওয়ার কথা কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে কি, এমন তথাকথিত ‘সহজ’ পদক্ষেপ আমরা খুব সহজে আদৌ দেখে অভ্যস্ত নই! সুনীল ভালো জানেন তাঁর রিচ কতটা, ফলে তিনি এ বার প্রয়াসী হলেন সেই রিচ-টা কোভিড-যোদ্ধাদের সহায়ক করে তোলার। যেচে ‘ব্যবহৃত’ হতে চাইলেন এক সুপারস্টার, আঁধার কাটানোর তরে। সুনীল এখানেই অন্য আরও প্রতিভাবানের চেয়ে আলাদা। স্মরণীয়।
আর একটা সোশ্যাল মিডিয়া উত্তাল করা ঘটনার কথা বলব, আমায় চমকে দেয়। ’১৮ সালে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের খেলা যদ্দুর মনে পড়ছে লাওস-এর বিরুদ্ধে। সুনীল একটি অনুরোধ বলুন, আর্তি বলুন, রাখলেন দর্শকের কাছে। ভিডিয়োটা দেখলে দেখবেন, তিনি বলছেন, আপনারা আসুন ভরিয়ে দিন মাঠ, আপনারা জানেন না আমরা কতটা ভ্যাল্যু করি আপনাদের, আপনাদের সমর্থন ইত্যাদি। এটা অবশ্যই আদৌ অভিনব নয় কিছু। কিন্তু যেটা আমায় চমকে দেয় সেটা হল, সুনীল বলছেন — আপনারা তো ভাবছেন নিশ্চয়ই খামখা কেন সময় নষ্ট করব ভারতের খেলা দেখে, বিশ্বমান তো ভুলে যান, ধারেকাছেও নেই ভারত। ঠিক ভাবছেন আপনারা। আমরা বিশ্বমান থেকে বহু দূরে। কিন্তু তা-ও হাত জোড় করে অনুরোধ করব একটি বার মাঠে আসতে। বাড়ি বসে আমাদের নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বা গালিগালাজ করে কী হবে, তার চেয়ে এসে দেখুন মাঠে আমরা একটা চেষ্টা তো করছি। সেখানেই না হয় আমাদের আপনারা মুখের ওপর কটূ কথা শোনাবেন, বলছি না আসুন আর খালি হাততালি দিয়ে বাড়ি চলে যান। না। পছন্দ না হলে মুখের ওপর এসে অপমান করুন আমাদের, আমরা শুনতে চাই সেটা। আমাদের উপকার হবে তাতে। আমরা আরও চেষ্টা করব যে তার পর। কিন্তু দয়া করে বাড়ি বসে থাকবেন না, একটু ভরিয়ে দিন না মাঠ…’
আরও পড়ুন: “রোনাল্ডো, মেসির থেকেও ভালো আমি” : কেন এত বড় দাবি করছেন সুনীল ছেত্রী?
পরের দিন সত্যিই মুম্বইয়ের অন্ধেরি স্পোর্ট্স কমপ্লেক্স ভরিয়ে দিয়েছিলেন দর্শক। কিন্তু সত্যিই তো আমি এমন ধাক্কা মারা কথা কত দিন কারও মুখে শুনিনি। তা-ও আবার এ ইগো-সর্বস্ব যুগে। এটা না স্রেফ গিমিক হতে পারে না, আমার অন্ধ বিশ্বাস। এ বান্দা নিশ্চিত অন্য তারে বাঁধা। প্রায়োরিটি একেবারে ভিন্ন না হলে বোধ হয় কেউ এমন করেন না। সুনীলকে বুঝতে গেলে, অতএব তাঁর দর্শনকে বুঝতে হবে। এবং যেনতেন প্রকারেণ চেষ্টা করতে হবে সেটিকে আত্মস্থ করার। এত দূর অবধি যদি আমরা সত্যিই আসতে পারি, তার পর? কী হবে তার পর? ব্যস খেল খতম? না কি সুনীল ওই বিখ্যাত ভিডিয়োয় যেটা বলেছিলেন, সেটা — অর্থাৎ, আমি আমার অংশটুকু করছি, আপনারা আপনাদেরটা করবেন না?