বিজেপিই রক্ষাকবচ, শুভেন্দুর গায়ে আঁচ না লাগা প্রমাণ করছে সেকথাই?
মুকুলের আসা-যাওয়ার মাঝেই শুভেন্দুর পদ্মপাতায় বেড়ে ওঠা এবং দিল্লি-আবহ ফের সামনে আনছে বাঁচিয়ে দেওয়া এবং বেঁচে যাওয়ার তত্ত্বকে! তাহলে কি সত্যিই..!
তুমি যদি আমার হও
শিখাব তোমায় বিপ্লব, মার্ক্স, এঙ্গেলস যত না মতবাদ
শুনবে তুমি আমার নেতা তোমার নেতা ফটিক চাঁদ, ফটিক চাঁদ
-তুমি যদি আমার হও, রেহানুল হক
আমার হলেই বড্ড ভালো, পরের হলেই খারাপ! গ্রামে-গঞ্জে ঘটে চলা এই বাক্যের আবহ এখন যেন বঙ্গের রাজনীতি শুধু নয়, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও দারুণ সত্য! কারণ, কেন্দ্রের একাধিক তদন্তকারী সংস্থার সাম্প্রতিক কাজে বারবার এমনই অভিযোগ তুলছেন বিজেপি-বিরোধীরা। ইদানীং, সেই অভিযোগই আর উসকেছে দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মণীশ শিশোদিয়া কাণ্ডে। শুক্রবার আম আদমি পার্টির নেতা, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী মোদি-বিরোধী অরবিন্দ কেজিওয়ালের ঘনিষ্ঠ ওই নেতার বাড়িতে সিবিআই অভিযান চলে। শুধু মণীশ নন, মাদক দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত আরও ১৪ জনের বাড়িতে অভিযান চালায় সিবিআই। তেমন কিছু উদ্ধার না হলেও মনীশের নামে লুক আউট নোটিশও জারি হয়। প্রসঙ্গত, ২০২১-২০২২-এ দিল্লি সরকারের আবগারি নীতি এবং সেখানে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। দিল্লির আপ সরকার সেই অভিযোগ অস্বীকার করলেও সক্রিয় হন লেফট্যানেন্ট গভর্নর বিনয় সক্সেনা। রাজ্যপালের 'সক্রিয়তা'-র পরেই জুলাইয়ে ওই আবগারি নীতি প্রত্যাহার করে সরকার।
এই পর্যন্ত সবকিছু চললেও অরবিন্দ কেজিওয়াল এবং মোদির বিরুদ্ধে তাঁর সরব হওয়াকে ছাপিয়ে গিয়েছে মনীশের সাম্প্রতিক বিস্ফোরক দাবি। সোমবার ট্যুইট করে দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, তাঁকে আপ ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, সব কেস মিটিয়ে নেওয়ার কথাও বলা হয়। যদিও মনীশের দাবি, তিনি মহরানা প্রতাপ সিংহের বংশধর, মাথা কাটা গেলেও পিছু হটবেন না। বিজেপি তাঁর বিরুদ্ধে যা করার করতে পারে।
আরও পড়ুন: দুর্নীতির শিখরে একাই পার্থ-অনুব্রত, না কি নেপথ্যে আরও বড় জাল? বাড়ছে জল্পনা
আপ নেতার এই বিস্ফোরণ রীতিমতো টলিয়ে দিয়েছে দেশের রাজনৈতিক ভিত্তিকে। যে অভিযোগ অর্থাৎ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে নিজেদের প্রয়োজনে, বিরোধীদের রুখতে ব্যবহার করার যে অভিযোগ উঠেছিল, সেই জল্পনা আবার মাথা চাড়া দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, বঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি, জেল, জিজ্ঞাসাবাদের চূড়ান্ত নাটকীয়তা এবং কেন্দ্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার যে অভিযোগ তৃণমূল নেতারা করেন, তার ভিত্তিই আরও মজবুত হলো। মণীশ শিশোদিয়ার বয়ানে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে ফের অক্সিজেন পেতে পারে বিরোধীরা। মোদির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে তদন্তকারী সংস্থার অপব্যবহার বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে।
দিল্লি আবহে সরগরম এই বঙ্গও। সারদা থেকে নারদা, মদন থেকে সাম্প্রতিককালের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি এবং পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার। পাশাপাশি বীরভূমের 'ভালো সংগঠক' অনুব্রত মন্ডলের সিবিআই হেফাজত। সব ক্ষেত্রেই বারবার প্রকাশ্যে অভিযোগ উঠেছে সিবিআইয়ের অপব্যবহার নিয়ে। হেরাল্ড দুর্নীতির অভিযোগে সোনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধীর ইডি জিজ্ঞাসাবাদের পরেও কংগ্রেস ঠিক যতটা সরব হতে পারেনি, তার থেকে বহু গুণ বেশি নারদাকাণ্ড এবং একের পর এক দুর্নীতির তদন্তে সিবিআই কার্যকলাপ নিয়ে সরব হয়েছে তৃণমূল। প্রকাশ্য সভায় সরব হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতার অলিন্দে ধরনায় বসেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
সেখানে দাঁড়িয়ে, তৃণমূল যে অভিযোগ বারবার তোলে, বিজেপি-যোগেই সাত খুন মাফ- সেই তত্ত্বই যেন দিল্লি-আবহে আবার সামনে চলে এল। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে কি অরবিন্দ কেজিওয়ালের পাঞ্জাবের পর 'টার্গেট গুজরাত'-ই ভয় ধরাচ্ছে মোদি-অমিত শাহদের মনে। আর তার জন্যই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর 'ডান হাত' মণীশ শিশোদিয়াকে অকেজো করে দেওয়ার কৌশল নিচ্ছে কেন্দ্র! সেখানেই দল পরিবর্তনের জন্য এই টোপ!
এখানেই উঠে আসছে তৃণমূল, বিজেপি এবং বঙ্গের সামগ্রিক পরিস্থিতির কথা। কেন? দেখা গিয়েছে, নারদা দুর্নীতিতে একাধিক তৃণমূল নেতা, মন্ত্রীর নাম জড়ানোর পরপরই বিজেপিতে যোগ দেওয়ার হিড়িক পড়ে অভিযুক্তদের মধ্যে। বিস্ফোরক ভিডিও এবং আদালতে মামলার রায়ে সিবিআই তদন্তের দিকে জল গড়াতেই এই দল বদলে ফেলার প্রবণতা দেখা যায়। সেখানে দাঁড়িয়েই বাংলায় প্রায় ডুবন্ত বিজেপি, তথাগত রায়-রাহুল সিনহাদের ব্যর্থতার পর দিলীপ ঘোষদের কৃতিত্বে খানিকটা উঠে দাঁড়ায়। মোদি ঝড়ে দু'টি লোকসভা (২০১৪) আসন পায় পদ্ম শিবির। উত্তরবঙ্গে ভালো প্রভাব এবং এই বদলের আবহে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে আরও ভালো জায়গা পায় বিজেপি। তার আগেই যদিও তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা মুকুল রায়ের পা পড়েছে মোদিগৃহে। মমতার একদা 'সেকেন্ড ইন কম্যান্ড' ততদিনে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন বিজেপিতে। সারদার পর নারদায় নাম-জড়ানো মুকুল ততক্ষণে প্রায় 'নিরাপদ'। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও শুধুই সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদেই রক্ষা পেয়েছেন তিনি। তৃণমূলের তরফে মুকুল রায় দল পরিবর্তন করেছেন বলে এই ছাড়, এমন অভিযোগ তোলা হয়।
মুকুল-পর্ব সাঙ্গ হতে না হতেই রায়-প্রভাবে ভাঙতে থাকে তৃণমূল। একপ্রকার দলের (তৃণমূল) সঙ্গ ছাড়লেই যে সব মাফ, এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়। অবশেষে বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সৌমিত্র খাঁ, মুকুল রায়দের পথ ধরেন কাঁথির 'যুবরাজ', মমতার নন্দীগ্রাম-পর্বের অন্যতম রাজনৈতিক মহীরুহ শুভেন্দু অধিকারী। বাবা শিশির অধিকারী, ভাই দিব্যেন্দু অধিকারীর প্রকাশ্য পথবদল না ঘটলেও অমিত শাহের হাত ধরে জল্পনা সত্যি করে বিজেপিতে যোগ দেন মমতা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, রাঢ়বঙ্গের 'দ্বিতীয় মুখ' শুভেন্দু। যদিও তাঁর দল পরিবর্তনের কারণ হিসেবে দাবি করা যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারীর সম্পর্কের তিক্ততাকে। যে দাবি উঠেছিল মুকুল রায়ের দলবদলের পরেও। কিন্তু সেই মুকুল রায়কেই বিধানসভা নির্বাচনে হাওয়া ওঠা বিজেপির 'লজ্জার হার'-এর পরেই দেখা গিয়েছে অভিষেকের হাত ধরেই তৃণমূলে ফিরতে। অনেকেই বলেন, একদা মুকুল-শুভেন্দু বিরোধ ফের মাথাচাড়া দেয় বিজেপিতেও। সেই কারণেই মুকুল পুরনো দলে ফেরেন বাধ্য হয়েই। আবার অন্য এক অংশের দাবি, 'সবকিছু মেটাতে'ই পদ্মে গিয়েছিলেন মুকুল! মিটিয়ে নিতে অর্থাৎ নিজে খানিকটা 'মুক্ত' হতেই ফের ঘরে ফেরা।
এই প্রসঙ্গের মধ্যেই অনেকে বলছেন, তাহলে কি সবকিছু মিটিয়ে নিতেই তৃণমূল ছাড়েন শুভেন্দু! একই ঘরে তৃণমূল সাংসদ বাবা-ভাইকে রেখেই বিজেপিতে যোগ দেন শুধুই দুর্নীতিমুক্ত হতে? যদিও তৃণমূলের বর্তমান নেতারা দাবি করেন, বিজেপি মানেই ওয়াশিং মেশিন, সেখানে গেলেই সব পরিস্কার। শুভেন্দু অধিকারীও তাই! তিনিও এত দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরে বিজেপিতে গিয়েছেন মুক্ত হতেই!
যদিও শুভেন্দু ঘনিষ্ঠরা তো বটে, এমন মানতে নারাজ রাজ্য বিজেপির নেতারাও। তাঁদের একাংশের দাবি, অভিযোগ-মুক্ত হতে বিজেপিতে যোগ দিলে বাকি অভিযুক্তরাও আসতেন। তাঁদের দলে নেওয়া হতো। শুভেন্দু মূলত মনের চাহিদা থেকেই মানুষের জন্য কাজ করতেই দলবদল করেছেন। তাঁকে কাজে লাগানো হচ্ছে, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা হিসেবেও তিনি সফল। তাই, স্বার্থে বিজেপি-যোগ হলে এমন সফলতার সঙ্গে দল করতেন না শুভেন্দু।
যদিও বাকি অভিযুক্তরা যে বিজেপিতে যোগ দিতে চাননি, এমন নিশ্চিত করে কেউ বলছেন না। আবার তৃণমূল ভাঙিয়ে 'এজেন্সির বিপদ থেকে বাঁচানো'-র প্রতিশ্রুতিতে যে অনেকের দলবদল হয়নি, এমনও বলছেন না অনেকেই। তাই, মুকুলের আসা-যাওয়ার মাঝেই শুভেন্দুর পদ্মপাতায় বেড়ে ওঠা এবং দিল্লি-আবহ ফের সামনে আনছে বাঁচিয়ে দেওয়া এবং বেঁচে যাওয়ার তত্ত্বকে! তাহলে কি সত্যিই..! প্রশ্ন উঠতেই থাকবে, উত্তর দেবে সময়।