মিষ্টিরও আছে নিজস্ব একটা ঠিকানা! যে ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে কলকাতার বিখ্যাত ‘রসগোল্লা ভবন’

Rossogolla Bhaban at Kolkata : এখানেই জন্ম, বেড়ে ওঠা! ‘রসগোল্লা’র ছোটবেলা স্মৃতি আজও ছড়িয়ে আছে উত্তর কলকাতার এই বাড়িতে...

৫৩২ নম্বর রবীন্দ্র সরণি, একটা সেকেলে বাড়ি। ব্যস্ত রাস্তার এক্কেবারে পাশেই অবস্থিত। এ বাড়ির ঝুল বারান্দায় আজও যেন ইতিহাস এসে উঁকি দেয়। রঙ ওঠা পলেস্তারা, আর চুন খসানো দেওয়াল দেখলে মনে হয় যেন সাক্ষাৎ প্রাচীনত্ব-এর দলিল। বাড়ির সামনে লম্বা গাড়ি বারান্দা। আর তার ঠিক পাশের থামে একটি খোদাই করা নেমপ্লেটে বড় বড় করে লেখা “ROSSOGOLLA BHABAN”। বাংলায় রসগোল্লা ভবন অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে এটাই হল আমাদের প্রিয় মিষ্টি রসগোল্লার বসতবাড়ি।

সত্যিই তো, মানুষের যখন বাড়ি থাকতে পারে, তখন রসগোল্লার থাকলে আর দোষের কি! তার ওপর এ তো আর যে সে মিষ্টি নয়, যাকে বলে রীতিমতো লড়াই করে জিতে নেওয়া মিষ্টি। বাংলা বনাম ওড়িশার দড়ি টানাটানিতে জয় হয়েছে বাংলারই। ‘ডুব দে রে মন রসের দেশে’ বলে রসগোল্লায় কামড় দেওয়ার অভ্যাস তাই আমাদের চিরন্তন। সাদা রঙের তুলতুলে এ মিষ্টি জনপ্রিয়তার নিরিখে আজও সবচাইতে এগিয়ে।

বাংলার মিষ্টি বলতেই যে নামটা সবার প্রথমে আসে তা হল রসগোল্লা। রসগোল্লা যে কেবল একটা মিষ্টি তাই নয়, বাংলার নিজস্ব আবেগ, ঐতিহ্য। তাই এর স্বত্ত্ব নিয়ে এত ধুন্ধুমার। সমস্যা গড়িয়েছিল আদালতেও। নব্বইয়ের দশকের সেই বিখ্যাত গান, “আমি কলকাতার রসগোল্লা” আজও ফেরে লোক মুখে। সেই সঙ্গে ফেরে এর স্বাদও। বাঙালি মাত্রই আসে পরিচিত অনুষঙ্গ মাছ ভাতের কথা, তবে শেষ পাতের মিষ্টি মুখটুকু বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ হয় না কিছুই। শুধু শেষ পাত বলে নয়, শুরু আপ্যায়নেও ভরসা জোগায় সেই মিষ্টিই। ঘরে তৈরি নাড়ু অথবা গুড় চাকতি থেকে শুরু করে হালফিলের বাহারি প্রকারভেদ, এ সফর কেবল দীর্ঘই নয় পাশাপাশি বেশ রসালোও বটে।

আরও পড়ুন - পুডিং-এর স্বাদে মজেছিলেন উত্তম থেকে সত্যজিৎ! কলকাতার সবচেয়ে পুরনো ‘ক্যাফে’ এটিই

এই রসের পথেই সওয়ার রসগোল্লা। সেই ১৮৬৮ সাল থেকে। বাংলায় এর স্রষ্টা হলেন নবীন চন্দ্র দাস। এটুকু ইতিহাস অবশ্য সবাই কম বেশি জানেন। কিন্তু যা জানেন না সেই অজানা কিছুর সন্ধান মেলে এই কলকাতাতেই। তার জন্য হয়তো কবির ভাষায় কলকাতার চেনা অচেনা রাস্তা ধরে খানিক হেঁটে দেখার প্রয়োজন আজও। আর হাঁটতে হাঁটতেই এসে পড়তে পারেন রবীন্দ্র সরণির ওই ৫৩২ নম্বর বাড়িটিতে। যেখানেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এ মিষ্টির।

রসগোল্লা ভবন, নামটা শুনতে একটু অন্যরকম লাগছে ঠিকই, আসলে এ নামের নেপথ্যে লুকিয়ে আছে অন্য গল্প। রসগোল্লা নিয়ে কলকাতার একচেটিয়া অধিকার থাকলেও সেই অধিকারের শুরু যাদের হাত ধরে হয়েছিল সে ইতিহাস ঘাঁটতে গেলেই উঠে আসে এই সেকেলে বাড়িটির ছবি। এ রাজ্যের মিষ্টি শিল্পের শুরুটা হয়েছিল যে পরিবারের হাত ধরে অর্থাৎ রসগোল্লার নেপথ্য নায়ক শ্রী নবীন চন্দ্র দাস ওরফে দাস পরিবারের আবাসস্থল হল এই রসগোল্লা ভবন।

The Rossogolla Bhaban at Kolkata

উত্তর কলকাতার রসগোল্লা ভবন, আজ থেকে দেড়শ বছরেরও বেশি সময় আগে এই বাড়িতে বসেই প্রথম ছানায় পাক দেন বিখ্যাত ময়রা নবীন চন্দ্র দাস। সময়টা ১৮৬৬ সাল, বাগবাজারে ইন্দ্রের “মিঠাই” দোকানের ঠিক বিপরীতে চিৎপুর রোডের ওপর নবীন চন্দ্র দাস তাঁর নিজের একটি দোকান খোলেন। যদিও পাকা ব্যবসায়ীর চাইতে পাকা শিল্পী হিসেবেই বেশি দর ছিলেন তিনি। তাই প্রথমদিকে ব্যবসায় বিশেষ লাভ করতে পারেননি। কিন্তু মিষ্টি তৈরি নেশাকে আঁকড়ে ধরে থেকেছেন।

সেই সময় কলকাতায় মিষ্টি বলতে প্রচলিত ছিল সন্দেশ। আর ছিল ডাল (মসুর) বা বিভিন্ন শস্যের আটার তৈরি মিষ্টি। ছানার সঙ্গে রসের যুগলবন্দিতে মিষ্টি তৈরির চল তখনও শুরু হয়নি। অন্যদিকে সন্দেশ প্রস্তুতকারক হিসেবে ততদিনে অবশ্য বেশ ব্যবসা জমিয়ে ফেলেছেন ভীম চন্দ্র নাগ, ফলে মিষ্টির বাজারে ময়রা হিসেবে স্বীকৃতি থুড়ি জনপ্রিয়তা পেতে নতুন কিছু করে দেখানোর তাগিদ তাড়া করতে থাকে নবীন চন্দ্র দাসকে। আর সেই তাগিদ থেকেই তিনি প্রথাগত সন্দেশের ধারণা থেকে সরে এসে শুষ্ক এবং শক্ত মিষ্টির বিপরীতে নরম রসালো মিষ্টি তৈরি কথা ভাবতে শুরু করেন। যদিও ভাবনার সঙ্গে বাস্তবের যোগাযোগ হতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যায়। অবশেষে তিনি একটি পুরোপুরি ছানার গোলাকার মিষ্টি তৈরি করতে সফল হন। তারপর তাকে ফুটন্ত চিনির সিরাপে দিয়ে একটি অভিনব পদ্ধতির মাধ্যমে তৈরি করে ফেলেন বাঙালির চিরকালীন প্রিয় মিষ্টি রসগোল্লা। স্বাদে এবং ঐতিহ্যে যা আজও স্বতন্ত্র।

আরও পড়ুন - পানের প্রেমে পড়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধিও! আজও কলকাতার গর্ব ১০০ ছুঁইছুঁই এই দোকান

আর এই এত কিছুর পিছনে যে বাড়িটি ছিল তার নাম যে রসগোল্লার নামে হতেই হবে, তা বলাই বাহুল্য। আজও বাগবাজার অঞ্চলের একটি পরিচিত ল্যান্ডমার্ক হিসাবে বিবেচনা করা হয় এই সেকেলে বাড়িটিকে। ১৯২০ সালে এই বাড়ির স্থাপত্য ডিজাইন করে দেন বিখ্যাত স্থপতি নন্দলাল গুইন মহাশয়। এছাড়াও এ বাড়িটির ভিতরেই রয়েছে অসাধারণ সব স্থাপত্য। বিখ্যাত শিল্পী যামিনী রায়ের মতো বেঙ্গল মাস্টারদের আঁকা অজস্র ছবি আজও দাস পরিবারের পৈতৃক উত্তর কলকাতার এই বাসভবনের দেওয়ালে শোভা পায়।

বাবার স্বপ্নকে পরবর্তীকালে বয়ে নিয়ে যান তাঁর যোগ্য ছেলে কৃষ্ণ চন্দ্র দাসও। রসগোল্লার একচেটিয়া বিস্তৃতিকে আরও প্রসারিত করেন তিনি, নিয়ে আসেন আরও একটি জনপ্রিয় মিষ্টি 'রসমালাই'। শুধু তাই নয়, তিনিই প্রথম তিনি ভ্যাকুয়াম টিনজাত রসগোল্লাও চালু করেছিলেন যা এখনও পাওয়া যায় তাঁর পারিবারিক সংস্থা কে.সি. দাস প্রাইভেট লিমিটেড -এ। এটি প্রতিষ্ঠা করেন কৃষ্ণ চন্দ্র দাসের ছেলে তথা উত্তরসূরি সারদা চরণ দাস। কলকাতায় আজও মিষ্টির দুনিয়ায় একচেটিয়া রাজত্ব এই দাস পরিবারের। যদিও কেবল কলকাতা নয়, সময় এবং চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রসগোল্লা এখন ছড়িয়ে পড়েছে শহরতলীতেও। ফলে যে মিষ্টি লোকের মুখে মুখে ফেরে সর্বত্র, সেই মিষ্টির বাড়িটিকে তলিয়ে যেতে দেওয়া যায় কি করে! রসগোল্লা ভবন তাই আজও নিজেই একটা ঐতিহ্য হয়ে থেকে গিয়েছে এই ব্যস্ত তিলোত্তমার অন্দরে। থেকে যাবেও।

তথ্যসূত্র - 'Old Kolkata' ফেসবুক পেজ। 

More Articles