টি-টোয়েন্টি মানেই চমক! ফিরে দেখা কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের সেরা অঘটনগুলি

T20 World Cup: এর আগেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বেশ কয়েকবার আন্ডারডগরা হেভিওয়েটদের হারিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকবারই সৃষ্টি হয়েছে কিছু ইতিহাস এবং কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।

২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ডের প্রথম ম্যাচেই ঘটে গেল অঘটন। গেলংয়ের জিএমএইচবিএ স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপ জয় শ্রীলঙ্কাকে কার্যত উড়িয়ে দিল নামিবিয়া। ৫৫ রানে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে নামিবিয়া। গোটা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছে আফ্রিকার এই দেশের পারফরম‍্যান্সে। কেউ ভাবতেই পারেনি এরকম একটি ফলাফল হবে। সদ্যসমাপ্ত এশিয়া কাপে পাকিস্তান এবং ভারতকে হারিয়ে এশিয়া কাপ জিতে আত্মবিশ্বাসী ছিল শ্রীলঙ্কা। ম্যাচে টস জিতে নিজেদের পরিকল্পনামাফিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল দাসুন শনাকা-র দল। জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ যেই হোক, কাগজে কলমে যত দুর্বলই হোক না কেন, অনুশাসন এবং তাগিদ দেখাতে না পারলে জেতা কঠিন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রীলঙ্কার দায়সারা মনোভাবই হারের কারণ হয়ে দাঁড়াল তাদের জন্য। অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত শ্রীলঙ্কা যখন এশিয়া কাপ জেতে সকলে এই দলের মধ্যে অর্জুন রণতুঙ্গা-র সেই ’৯৬-এর দলের ছাপ দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু অধিক আত্মতুষ্টি, দায়সারা মনোভাব এবং অনুশীলনের অভাবের কারণে একমাসের মধ্যেই সমর্থকদের ফের নিরাশায় ফেলেছেন লঙ্কান ক্রিকেটাররা। অপরপক্ষে ৫৫ রানে জিতে গ্রুপ এ-তে প্রথম ম্যাচ জিতে শুধু পয়েন্টই নয়, নেট রান রেটেও অনেক এগিয়ে গেল নামিবিয়া। প্রথমে বল করতে নেমে চামিরা নামিবিয়ার দুজন ওপেনারকে ফেরাতেই আত্মতুষ্টিতে ভোগার শুরু করে শ্রীলঙ্কা। এখানেই বার্ড, স্মিথ, ফ্র‍্যাঙ্কলিনদের ব্যাটিংয়ের মাধ্যমে পাল্টা ঘুরে দাঁড়ায় নামিবিয়া এবং ম্যাচের খেই হারিয়ে ফেলে শ্রীলঙ্কা। দ্বিতীয় ইনিংসে সঠিক লাইন এবং লেংথ বোলিং এবং দুর্ধর্ষ ফিল্ডিংয়ের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কাকে মাত দেয় এই ম্যাচের ‘আন্ডারডগ’ নামিবিয়া। এর আগেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বেশ কয়েকবার আন্ডারডগরা হেভিওয়েটদের হারিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকবারই সৃষ্টি হয়েছে কিছু ইতিহাস এবং কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।

নামিবিয়ার বিরুদ্ধে দায়সারা মনোভাবই ডোবাল শ্রীলংকাকে

জিম্বাবোয়ে বনাম অস্ট্রেলিয়া (২০০৭)
সেবার ওয়ান ডে বিশ্বকাপ জয়ের পর বেশ ফুরফুরে মেজাজেই প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে আসে রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া। লেখার শুরুতেই বলেছি আত্মতুষ্টি বড় বিপজ্জনক জিনিস। সেবারের টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই হল তাই। ওই বিশ্বকাপের ওপেনিং ম্যাচে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে সকলকে চমকে দেয় অধিনায়ক প্রসপার উৎসেয়ার জিম্বাবোয়ে। এই দলটির থেকে কেউ বেশি আশা করেনি। তরুণ অধিনায়ক প্রসপার উৎসেয়া, তরুণ সহ-অধিনায়ক এল্টন চিগুম্বুরা, হ্যামিল্টন মাসাকাদজা-সহ তরুণ একটি দল সেবার হারিয়ে দেয় ম্যাথু হেডেন, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, রিকি পন্টিং, মাইক হাসি, ব্রেট লি-সমৃদ্ধ একটি দলকে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে এল্টন চিগুম্বুরা, গ্যারি ব্রেন্টের দুর্দান্ত বোলিংয়ে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ১৩৯ রান তুলে অস্ট্রেলিয়া। ১৪০ রানের জবাবে ব্যাট করতে নেমে ব্রেট লি, নাথান ব্র্যাকেনদের বিষাক্ত ডেলিভারি গুলিকে বাউন্ডারির রাস্তা দেখান জিম্বাবোয়ের ওপেনার ব্রেন্ডন টেইলর। ৪৫ বলে ৬০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে ১ বল বাকি থাকতেই দলকে জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন তিনি।

২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে পর্যদুস্ত করে জিম্বাবোয়ে

নেদারল্যান্ডস বনাম ইংল্যান্ড (২০০৯)
২০০৯ সালে ইংল্যান্ডে আয়োজিত হয়েছিল টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই হোস্ট অর্থাৎ ইংল্যান্ডকে কার্যত উড়িয়ে দেয় নেদারল্যান্ডস। সেই ম্যাচে লজে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে নেদারল্যান্ডসকে ১৬৩ রানের টার্গেট দেয় ইংল্যান্ড। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৪ উইকেটে জিতে নেয় নেদারল্যান্ডস। সেই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে রবি বোপারার ৪৬ এবং লুক রাইটের ৭১ রানের ইনিংসে ভর করে ২০ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে ১৬২ রান তোলে ইংল্যান্ড। জবাবে ব্যাট করতে নেমে প্রথম থেকেই সামলে খেলে নেদারল্যান্ডস। টম ডি গ্রুথের ৪৯, পিটার বোরেনের ৩০ এবং রায়েন টেন’ডোশাটের ২২ রানে ভর করে ১৬৩ রান তুলে নেয় নেদারল্যান্ড। ইংল্যান্ডের হয় বল হাতে জেমস অ্যান্ডারসন ৩ উইকেট নিলেও নিজেদের হার বাঁচাতে পারেনি ইংরেজরা। এক্ষেত্রে আপনাদের আরেকটা মজার তথ্য জানিয়ে রাখি, এর পাঁচ বছর পরে, অর্থাৎ ২০১৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আবার মুখোমুখি হয় ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের। ঘটনাচক্রে এবারও শোচনীয়ভাবে ইংরেজদের হারিয়ে দেয় ডাচেরা। ওই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ১৩৩ রান করে নেদারল্যান্ডস। পরে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৮৮ রানেই গুটিয়ে যায় ইংল্যান্ড।

২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডকে হারায় নেদারল্যান্ডস

হংকং বনাম বাংলাদেশ (২০১৪)
২০১৪ বিশ্বকাপে হারানোর জন্য কিছুই ছিল না হংকং-এর কাছে। তাই বোধহয় চট্টগ্রামে বাংলাদেশের মুখোমুখি হওয়ার আগে একদম চাপমুক্ত হয়ে নেমেছিল তারা। নেমে এমন তারা খেলা খেলে যে, স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা বিশ্ব। তার আগে এর আগের প্রেক্ষাপট জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। টুর্নামেন্টের শুরুতেই ৮০ রানে নেপালের কাছে ও ৭ উইকেটে আফগানিস্তানের কাছে হেরে মোটামুটি টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছিল হংকং। স্বভাবতই সেই ম্যাচে বাংলাদেশ ছিল টপ ফেভারিট। একেই বাংলাদেশ পরিচিত জায়েন্ট কিলার হিসেবে।

২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ বধের দুই নায়ক ইরফান আহমেদ এবং মুনির দার

কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে হংকং ২ উইকেটে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশকে। হংকংয়ের দুই স্পিনার নাদিম আহমেদ (৪-২১) ও নিজাকাত খান (৩-১৯) বাংলাদেশকে ১০৮ রানেই আটকে দেন। তামিম ইকবাল, শাব্বির রহমান মাহমুদউল্লাহ চূড়ান্ত ব্যর্থ হন ব্যাট হাতে। বাংলাদেশ দলের মান বাঁচান শাকিব আল হাসান (৩৪ রান) এবং এনামুল হক (২৬ রান)। ব্যাট করতে নেমে হংকংয়ের ওপেনার ইরফান আহমেদ (৩৪ রান) ও মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান মুনির দার (৩৬ রান) করে দলকে জেতান।

আফগানিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০১৬)
২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তবে জানলে অবাক হবেন সেবার দুরন্ত ফর্মে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল ‘আন্ডারডগ’ আফগানিস্তান। ভারতের নাগপুরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাত্র ১২৪ রানের লক্ষ্য ছুঁড়ে দিয়েও শেষ পর্যন্ত জয় তুলে নেয় আফগানিস্তান। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন নাজিবুল্লাহ জাদরান। তাঁর ৪০ বলের ৪৮ রানের ইনিংসে ভর করে ২০ ওভারে ৭ উইকেট হারিয়ে ১২৩ রান তোলে আফগানিস্তান। সেই ম্যাচে সবচেয়ে মজার জিনিস হচ্ছে আফগানিস্তানের মারকুটে ব্যাটসম্যান মহম্মদ শেহজাদের ব্যাটিং। স্কোরকার্ড বলবে তিনি ২২ বলে ২৪ রান করেছিলেন। এই স্ট্রাইক রেট তাঁর ব্যাটিংয়ের ধরনের সঙ্গে খাপ খায় না। আসলে ওই ম্যাচে দুরন্ত ছন্দে থাকা স্যামুয়েল বদ্রীকে আটকাতে ওরকম ধীর লয়ে খেলতে বাধ্য হয়েছিলেন শেহজাদ। সেবার দুরন্ত ছন্দে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সবাই ভেবেছিল এই রান তুড়ি মেরে তুলে নেবে ক্যারিবিয়ানরা। কিন্তু জবাবে ব্যাট করতে নেমে জনসন চার্লস, ডোয়েন ব্রাভো, আন্দ্রে রাসেল, মারলোন স্যামুয়েলসের মত ব্যাটারদের আটকে দেন মহম্মদ নবী, আমির হামজা এবং রশিদ খানের মত স্পিনাররা। তিনজনে মিলে মোট ৫ উইকেট নিয়েছিলেন। এভাবে ৬ রানে ওই বিশ্বকাপের ভাবী চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে দেয় আফগানিস্তান।

স্কটল্যান্ড বনাম বাংলাদেশ (২০২১)
গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে সরাসরি খেলার সুযোগ পায়নি বাংলাদেশ। প্রথম রাউন্ডে দুই গ্রুপে থাকা বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কাকেই ফেবারিট ধরে নিয়েছিল সবাই। কিন্তু ওই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই ঘটে যায় বড় অঘটন। স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে যায় বাংলাদেশে। শুরুটা ভালোই করেছিল বাংলাদেশ। একসময় ৫৩ রানে ৬ উইকেট পরে গিয়েছিল স্কটিশদের। কিন্তু তারপর ঘুরে দাঁড়ায় স্কটিশরা। ক্রিস গ্রেভিস ও মার্ক ওয়াটের লড়াকু ইনিংসের সৌজন্য ১৪০ রানের স্কোরে পৌছায় স্কটল্যান্ড। ৪৫ রান করেন গ্রেভিস ও মার্ক ওয়াট করেন ২২ রান। প্রথমে ব্যাটিং করে ১৪১ রানের টার্গেট দিয়েছিল স্কটল্যান্ড। কিন্তু সেই রান তাড়া করতে গিয়েই হিমশিম খেতে হয় বাংলাদেশের ব্যাটারদের। সেকেন্ড ইনিংসে অত্যন্ত মন্থর হয়ে যায় পিচ। মুশফিকুর-শাকিব-মাহমুদউল্লাহরা চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে বাঁচাতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ৭ উইকেট হারিয়ে ১৩৪ রানে থামতে হয় বাংলাদেশকে। স্কটল্যান্ডের হয়ে ব্র্যাড হোয়েল নেন ৩ উইকেট, ক্রিস গ্রেভিস নেন ২ উইকেট, জস ডেভি ও মার্ক ওয়াট নেন ১ উইকেট। এই ভাবেই ৬ রানে জিতে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল স্কটল্যান্ড। এবার শুরু হয়েছে আরেকটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। কে বলতে পারে, হয়তো এবছরও এরকমই কিছু তাক লাগানো ঘটনা অপেক্ষা করছে আমার আপনার মত ক্রিকেট ভক্তদের জন্য!

More Articles