মার্বেলের গায়ে চওড়া হচ্ছে হলদে ছোপ! বাঁচানো যাবে সাধের তাজমহল?
Taj Turning Green: যে ধবধবে সাদা মাকরানা মার্বেলের তৈরি দেওয়াল দেখে অভ্যস্ত বিশ্বের পর্যটকেরা, সেই দেওয়াল ক্রমশ নিজের জৌলুস হারাচ্ছে।
সেই সপ্তদশ শতকে তৈরি স্মৃতিসৌধের সামনে দাঁড়ালে আজও মানুষ বিস্মিত হয়। বছরের পর বছর ধরে দেশ বিদেশ থেকে ছুটে আসে আগ্রায় বিশ্বের সাত আশ্চর্যের এক আশ্চর্যকে দেখবে বলে। শুধুই যে ইতিহাস তা তো নয়, যুগ যুগ ধরে মানুষের আবেগ বুকে নিয়ে প্রেমের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাজমহল। অথচ সেই তাজমহলের শুভ্র দেওয়ালের রং ক্রমশ বদলাচ্ছে। ক্রমশ হলুদ হচ্ছে সাধের সফেদ দেওয়াল।
যে ধবধবে সাদা মাকরানা মার্বেলের তৈরি দেওয়াল দেখে অভ্যস্ত বিশ্বের পর্যটকেরা, সেই দেওয়াল ক্রমশ নিজের জৌলুস হারাচ্ছে। ঘষেমেজেও তার সেই পুরনো রং ফেরত আনতে পারছেন না মেরামতকর্মীরা। স্বাভাবিক ভাবেই বিষয়টি নিয়ে বেশ উদ্বেগে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া। হ্যাঁ, তাদের হাতেই বিশ্বের আশ্চর্যতম সৌধটির রক্ষণাবেক্ষণের ভার।
আরও পড়ুন: ভয়াবহ বন্যায় অস্তিত্বের সঙ্কটে তাজমহল, ৪৫ বছরে প্রথম সৌধ ছুঁল যমুনার জল
এমনিতেই দিল্লি, আগ্রা, পঞ্জাব-সহ উত্তরভারতের একাধিক জায়গায় দূষণ খুব বড় একটা সমস্যা। যে যমুনা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই তাজমহল, সেই যমুনার জল বিষিয়েছে বহু দিন। প্রায়শই যমুনা নদীর ছবি ভাইরাল হয় নেটবিশ্বে। দেখা যায়, সাদা সাদা ফেনায় ঢেকে গিয়েছে গোটা নদী। সেসব দেখে ফেনা মনে হলেও সেগুলি আসলে যমুনা নদীতে জমা বর্জ্য। কিছুদিন আগেই বৃষ্টিতে জল বেড়েছিল যমুনার। সেই জল ছুঁয়ে ফেলে তাজমহলের দেওয়াল। তাজমহলের শ্বেতশুভ্র দেওয়ালে লেগেছিল যমুনার কাদাজল। গত ৪৫ বছরে সেই প্রথম। বিষয়টি নিয়ে কপালে ভাঁজ পড়েছিল আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের।
তাজমহলের দুধসাদা দেওয়াল নষ্ট হওয়ার পিছনেও নাকি রয়েছে ওই যমুনারই হাত। যমুনা নদীতে বসবাসকারী বিষাক্ত সব কীটপতঙ্গ এবং তাদের বিষ্ঠা, তার সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করেই নাকি ক্রমশ জৌলুস হারাচ্ছে তাজমহলের মার্বেল পাথরের রং। তেমনটাই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। বেশ কয়েকবছর ধরে ভয়াবহ জলদূষণের শিকার যমুনা। নানাবিধ বর্জ্য, বিষাক্ত জিনিস জলকে নষ্ট তো করেইছে। এবার ক্রমে তাজমহলের দিকে হাত বাড়াচ্ছে সেই দূষণ। ইতিমধ্যেই তাজমহলের নিচের দিকের অংশগুলিতে সবুজ রং ধরতে শুরু করেছে। যমুনার দিকে মুখ করে রয়েছে তাজমহলের যে অংশটি, সেখানেও ওই দাগ দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত, যমুনা নদীর জলে বহালতবিয়তে বাস করছে গোয়েলডিচিরোনোমাস নামে একধরনের পোকা। সাধারণত দূষিত জলেই বংশবিস্তার করে তারা। আর তাদের সৌজন্যই ক্রমশ সবুজ হতে শুরু করেছে তাজমহলের মার্বেল পাথরের বিচ্ছিন্ন অংশ।
এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে এএসআই কয়েকজন কর্মীকে নিয়োগ করেন। যাদের কাজ ছিল জল আর তুলো দিয়ে ঘষে ঘষে তাজমহলের ওই সবুজ হয়ে যাওয়া অংশকে আগের জায়গায় ফেরত নিয়ে যাওয়া। এমন তুলোপালিশ করা হয়েছে বেশ কয়েকবার, তবে আগের জৌলুস পুরোপুরি ফিরে আসেনি তাজমহলের।
বরং বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, তুলোপালিশের ফলে যতটা সাফসুতরো করা গিয়েছে তাজমহলকে, ওই বিষাক্ত পোকার দৌলতে তত তাড়াতাড়ি ফের রং হারাতে শুরু করবে তাজমহল। তবে উপায়! দূষিত যমুনা নদীর পাড় থেকে ঐতিহাসিক তাজমহলকে রাতারাতি সরিয়ে ফেলার তো উপায় নেই। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যকে বাঁচাতে যমুনাকে দূষণমুক্ত করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা নেই।
তবে এই প্রথম নয়। এর আগেও তাজমহলের দুধ-সাদা রঙ ফিকে হয়েছে। কখনও হলুদ তো কখনও বাদামী, হয়ে গিয়েছে তাজমহলের মার্বেল। বিষয়টি নিয়ে এর আগে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সুপ্রিম কোর্টও। ব্যাপারটি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার ও এএসআই-কে।
তবে কি ক্রমশ জৌলুস হারাতে হারাতে একদিন সাদামাটায় পরিণত হবে মোঘল আমলে তৈরি এই মনুমেন্ট। প্রিয় স্ত্রী মমতাজের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ধবধবে সাদা এই সৌধটি তৈরি করেছিলেন শাহজাহান। সেখানেই চিরঘুমে মমতাজ। শুধু তিনি নন, প্রিয় স্ত্রীর পাশে শায়িত শাহজাহান নিজেও। এই তাজমহল নিয়ে মানুষের যেমন আকর্ষণের শেষ নেই, তেমনই শেষ নেই বিতর্কেরও। কিছুদিন আগেই মোঘল সম্রাটের তৈরি ওই সৌধটির গভীরে হিন্দু মন্দির খুঁজতে নেমেছিলেন গুটিকতক হিন্দুত্ববাদী। সে নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। তবে শেষপর্যন্ত তাজমহল রয়েছে তাজমহলেই। সেই দুগ্ধসফেদ তাজমহলকে এবার কলঙ্কিত করতে নেমেছে যমুনা নদীর বিষাক্ত পোকা।
যদিও একদল বিশেষজ্ঞের দাবি, তেমন কোনও চিরস্থায়ী ক্ষতি করবে না এই পোকার উপদ্রব। আসলে জলাশয় দূষণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দৌরাত্ম বাড়ে এই ধরনের পোকাগুলির। তাদের আংশিক হজম করা ক্লোরোফিল তাদের বিষ্ঠার সঙ্গে মিলে তাজমহলের দেওয়ালে ওই ধরনের ছোপ ফেলছে বলেই মনে করছেন সেন্ট জনস কলেজের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান গিরিশ মহেশ্বরী।
আরও পড়ুন: তাজমহল নয়, বিরিয়ানির জন্য বাঙালি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে মুমতাজের কাছে! কেন?
তিনি জানান, তাজমহলের দেওয়ালের উপরে পড়া ওই স্তর আসলে জলেতে মিশে যায়। ফলে তুলো ও জল দিয়ে তাজমহলের দেওয়াল পরিষ্কার করার সিদ্ধান্ত একেবারেই ঠিক বলে মনে করছেন তিনি। তবে তাজমহলের দেওয়াল পরিষ্কার করলেই হবে না। আসল সমস্যার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলেই মনে করছেন তিনি।
সাদা রংকে সংরক্ষণ করা সবসময়েই কঠিন কাজ। ২০১৫ সালের একটি ইন্দো-মার্কিন সমীক্ষায় ধরা পড়ে ক্রমাগত দূষণ, আবর্জনা পোড়ার ধোঁয়া ও ধুলিকণার কারণে ক্রমশ বাদামী রং ধারণ করছে ওই দুধসাদা মার্বেল। তার পরে নয়া বিপদ এই পোকার উপদ্রব। ক্রমাগত বেড়ে চলা দিল্লি, আগ্রা-সহ উত্তরভারতের দূষণ বন্ধ না করতে পারলে শুধু তাজমহলই নয়, ওই সব এলাকার সমস্ত ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও সৌধই একদিন মিশে যাবে কালের গর্ভে।