গরু পারাপারের সেতু থেকে আজকের টালা ব্রিজ! যে ইতিহাস অনেকের অজানা
Tala Bridge: ২৪ সেপ্টেম্বর, আরেকবার খুলে যাচ্ছে টালা ব্রিজ।
উত্তর কলকাতার বাসিন্দাদের জন্য সুখবর। ২৪ সেপ্টেম্বর, আরেকবার খুলে যাচ্ছে টালা ব্রিজ। মহালয়ার আগেই সেতু উদ্বোধন করবেন মুখ্যমন্ত্রী।
কলকাতার ইতিহাসের প্রায় গত ন'টি দশকের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সেতুটি। কখনও গরু পারাপার প্রসঙ্গ, কখনও ডবল ডেকার বাস পড়ে যাওয়ার ঘটনা, আবার কখনও হেমন্তকুমার বসু হত্যা— বারে বারে কতকাতাবাসী বাঙালির ইতিহাসে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে সক্ষম হয়েছে সেতুটি। রাজনীতি থেকে শহর গড়ে ওঠার ইতিহাস এবং বিবর্তন, সেতুটির পরতে পরতে লেখা। কলকাতার ইতিহাস নিয়ে যাঁদের কারবার, সেই গবেষকরা জানাচ্ছেন, এক সময়ে লোকের মুখে মুখে এই সেতুর নাম হয়ে উঠেছিল, 'কাউ ক্রসিং ব্রিজ' বা গরু পারাপারের সেতু। হরিপদ ভৌমিকের মতে, গরু পারাপারের জন্য নাকি ওই সেতু ব্যবহার করা হতো। সেখান থেকেই অমন নাম হয়ে গিয়েছিল। কলকাতার ইতিহাস সংক্রান্ত নানা বইপত্রেও এ-বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্যাদি রয়েছে। এক অদ্ভুত নামের সাক্ষী ছিল কলকাতা। খাতায়-কলমে সেতুটি ১৯৩৬ নাগাদ চালু হয়েছিল বটে, কিন্তু যে কাঠামো দীর্ঘদিন ধরে দেখে এসেছেন নগরবাসী, তা অনেকটাই পরে হয়েছে। ১৯৬৪ নাগাদ রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের আমলে সেই কাঠামো তৈরি হয়েছিল।
তার আগে সেতুটির কাঠামো তেমন নিরাপদ ছিল না। কারণ কলকাতা-গবেষক দেবাশিস বসু জানাচ্ছেন, "এক সময়ে ওই সেতু থেকে একটি ডবল ডেকার বাস নিচে পড়ে গিয়েছিল। ছোটবেলায় যখন ওই সেতু দিয়ে বড়দের সঙ্গে যাতায়াত করতাম, তাঁরা বলতেন, 'এই যে এখান থেকে বাস পড়ে গিয়েছিল।'" কিন্তু সেই সময়ের নথি ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, ওই দুর্ঘটনায় মারা যাননি কেউ। অথবা মারা গেলেও সরকারি নথিতে তার উল্লেখ নেই। কেউ আহত হয়েছিলেন কি না, তথ্য নেই সেই সম্বন্ধেও।
আরও পড়ুন: জাপানি বোমা থেকে আমফান, কিছুই টলাতে পারেনি শতাব্দী পার করা টালা ট্যাঙ্ককে
ছিল গরু পারাপারের সেতু, সেখান থেকে হলো 'টালা সেতু'। কিন্তু নামের গল্প এখানেই শেষ না। ১৯৭৩ সালের ৫ অক্টোবর সেই নাম আবার বদলে গেল। এবার নাম 'হেমন্ত সেতু'। যাঁর নামে এই সেতুর নাম, সেই হেমন্তকুমার বসু ছিলেন খোদ সুভাষচন্দ্র বসুর সহকর্মী। সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের চেয়ারম্যান। ১৯৭১ সালের ঘটনা। সারা বাংলা সেই সময় আন্দোলনে উত্তাল। এপারে নকশাল আন্দোলন, ওপারে মুক্তিযুদ্ধ। এমন এক পরিবেশে শ্যামপুকুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে দলের হয়েই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন হেমন্তবাবু। তাঁর বয়স তখন প্রায় ৭৬। কিন্তু '৭১-এর ২০ ফেব্রুয়ারি টালা ব্রিজের কাছেই টাউন স্কুলের সামনে বৃদ্ধের ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালায় একদল আততায়ী। ভোজালির কোপে রক্তাক্ত শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত বলেঘোষণা করা হয়। এই ঘটনার বছরদুয়েক পরে হেমন্ত কুমার বসুর ৭৮তম জন্মদিনে সেতুর নাম বদলে হেমন্ত সেতু রাখা হয়। সেই নাম রেখেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সিদ্ধার্থশঙ্কর ভাষণ দিয়েছিলেন, "হেমন্তবাবুকে মানুষ কোনওদিনই ভুলবে না এবং এই সেতু তাঁর স্মৃতিতেই উৎসর্গ করা হল।" এই কথা বলে হেমন্ত বসুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য যুবসমাজকে আহ্বান জানান মুখ্যমন্ত্রী। তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী ভোলা সেন বলেছিলেন, "এই নামকরণের মাধ্যমে উত্তর কলকাতার দীর্ঘদিনের একটি ইচ্ছেকে মর্যাদা দেওয়া গেল।"
উত্তর কলকাতা এবং শহরতলির মধ্যে যোগাযোগের এটি ছিল অন্যতম মাধ্যম। ১৫০ টন ভার বহনে সক্ষম পুরনো ব্রিজটি। কিন্তু অধুনা যানবাহনের চাপ অনেকটাই বেড়েছে। ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মাঝেরহাট সেতু বিপর্যয় দেখল রাজ্য। কলকাতাবাসীর ত্রাস চারিয়ে গিয়েছিল রাজ্য সরকারের মধ্যেও। কাজেই রাজ্যের সমস্ত সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু হয়। সেই সময়েই স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছিল টালা সেতুরও। সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর বিশেষজ্ঞরা পূর্ত দফতরকে জানায়, সেতুটি অনেকটাই পুরনো হয়ে গিয়েছে।। সেতুর গায়ে একাধিক জায়গায় ফাটল। কাজেই এই ব্রিজ ভেঙে নতুন ব্রিজ তৈরির প্রস্তাব দেন তাঁরা। বিশেষত মুম্বইয়ের সেতু বিশেষজ্ঞ ভি কে রায়না পুরনো সেতু ভেঙে নতুন সেতু নির্মাণে জোর দেন। এরপরই ব্রিজ ভাঙার তোড়জোড় শুরু হয়। ২০১৯ সালের পুজোর আগেই পুরনো টালা ব্রিজের যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং ভারী যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০২০-র ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ব্রিজ ভাঙার কাজ শুরু হয়। কিন্তু ইতিমধ্যে করোনার প্রকোপ।
অতিমারীর প্রভাবে কাজ পিছিয়ে যায় বেশ কিছুদিন। যদিও লকডাউন পর্বেও ব্রিজ ভাঙার কাজ চলেছে। এতদিনে কাজ শেষ হয়ে উদ্বোধনের সময় এল। প্রায় ৮০০ মিটার সেতু নির্মাণে খরচ হয়েছে ৪৬৮ কোটি টাকা। থ্রি লেনের জায়গায় ফোর লেনের ব্রিজ হয়েছে। এই ব্রিজের ২৪০ মিটার পুরোপুরি রেলপথের ওপরে। তাই একে রেলওভার ব্রিজও বলা হচ্ছে। এই অংশে কোনও পিলার নেই। পুরোটাই কেবল স্টেড। অ্যাপ্রোচ রোডে মোট বারোটি পিলার রয়েছে। সিঁথি-বরানগর-সহ উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে ঢোকার পথ প্রশস্ত হবে। সেতুর দু'পাশে প্রশস্ত ফুটপাথ রয়েছে। ১৫০ টনের জায়গায় নতুন ব্রিজের ভারবহন ক্ষমতা ৩৫০ টন। ছয়ের দশকে তখনকার সম্ভাব্য ভারবহন ক্ষমতার হিসেব কষে টালা সেতুর নকশা তৈরি করা হয়েছিল। এবার অন্তত ১০০ বছরের সম্ভাব্য পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে সেতুর স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। নকশা তৈরি করা হয়েছিল ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেসের সাম্প্রতিকতম ‘কোড’ মেনে। ইন্ডিয়ান রোড কংগ্রেসের বিধি অনুযায়ী এমন সেতু তৈরি করা দরকার, যা অন্তত ৩৮৫ টনের চলমান গাড়ির ওজন বহনে সমর্থ হয়।
গত দু'বছর, উত্তর কলকাতার মানুষ এবং শহরতলি থেকে যাঁরা কলকাতা যাতায়াত করেন, প্রচণ্ড ভোগান্তি গিয়েছে তাঁদের। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে কাশীপুর লকগেট ব্রিজ হয়ে ডানলপের দিকে গাড়ি চলেছে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ থেকে শ্যামবাজার, আরজি কর রোড হয়ে পাইকপাড়া অবধি একটি বিকল্প রাস্তাও তৈরি হয়েছে। তবে তাঁদের যাবতীয় অপেক্ষার অবসান হল বলে। ১৯ মিটার চওড়া এই ফোর লেনের ব্রিজটি দিয়ে নির্বিঘ্নে যান চলাচল করতে পারবে। মানুষের সুবিধার কথা ভেবে শ্যামবাজার, চিৎপুর এবং সিঁথির দিকে ব্রিজ থেকে নামার জন্য রয়েছে সিঁড়ির ব্যবস্থাও। মহালয়ার আগেই নতুন সেতু উপহার পেতে চলেছে কলকাতাবাসী।
তথ্য ঋণ:
আনন্দবাজার আর্কাইভ