সিঙ্গুরের ভুলের খেসারত ১৩৫৫ কোটি! রতন টাটার ছোট্ট চালেই কিস্তিমাত?

Tata Motors: সোমবার আদালতের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ন্যানো কারখানার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৭৬০ কোটি টাকা টাটা মোটর্সকে মেটাতে হবে রাজ্য সরকারকে। আর সুদ-বাবদ দিতে হবে আরও ৬ কোটি টাকা।

সিঙ্গুর। তৎকালীন বাম সরকারের পতনের রাস্তাটুকু প্রশস্ত করে দিয়েছিল এই একটা নাম। সেই সিঙ্গুর, যেখানে ন্যানো গাড়ির কারখানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল টাটা গ্রুপ। আর তারপর জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে যুযুধান হয়ে উঠেছিল স্থানীয় কৃষক ও সরকার। যেখান থেকে একদিন বিরাট আকার ধারণ করেছিল বাংলায় জমি-আন্দোলন। সেই পথ ধরেই একদিন ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল। আর সেই মামলাতেই এবার বড়সড় ধাক্কা খেল এ রাজ্যের সরকার। টাটা মোটর্সকে বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।

তৎকালীন বিরোধী আসনে থাকা তৃণমূলের লাগাতার প্রতিবাদ যেমন এ রাজ্যে পাকা করেছে তাদের রাজ্যের শাসকদলের পদ, তেমনই পশ্চিমবঙ্গ-ছাড়া করেছিল টাটাকে। এ রাজ্যে টাটার ন্যানো কারখানা তৈরি হয়নি। সেই ঘটনার ১৫ বছর পর আরবিট্রেশনে বিরাট জয় পেল টাটা মোটরস। আর কপাল পুড়ল রাজ্য সরকারের। সোমবার আদালতের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ন্যানো কারখানার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৭৬০ কোটি টাকা টাটা মোটর্সকে মেটাতে হবে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমকে।  তাদের দাবি, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ১১ শতাংশ হারে রাজ্য সরকারকে সুদও দিতে হবে। যার ফলে অঙ্কটা দাঁড়াবে আরও ৭৬৬ কোটিতে ।

আরও পড়ুন: মমতা-মন্তব‍্যে ফের বিতর্কিত সিঙ্গুর! এক নজরে ফিরে দেখা সেই ইতিহাস

২০১৬ সাল থেকেই টাটা সংস্থার সঙ্গে এ নিয়ে মামলা চলছিল রাজ্য সরকারের। সোমবার স্টক এক্সচেঞ্জের তরফে জানানো হয়েছে, সেই মামলায় জয় হয়েছে শেষমেশ টাটা মোটর্সেরই। আরবিট্রাল ট্রাইবুনালে টাটা জানায়, সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা তৈরি না হওয়ায়, তাদের বিনিয়োগ করা মূলধন নষ্ট হয়েছে। আর বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছে টাটা। তিন সদস্যের বেঞ্চে দীর্ঘ সওয়াল-জবাবের পরে বেঞ্চের তরফে রায় দেওয়া হয় টাটা মোটরসের পক্ষে। রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে ওই মামলায় রতন টাটার শিল্পগোষ্ঠী টাটা মোটরসকে ৭৬৬ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ সুদ-সমেত মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে পুরো ক্ষতিপূরণ পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ১১ শতাংশ সুদ দিতে বলা হয়েছে।”

জমি দিয়েছিল বাম সরকার। অথচ সেই জমিতে কারখানা না হওয়ার মাশুল ভুগতে হচ্ছে তৃণমূল সরকারকে। এমনিতেই একাধিক দুর্নীতি মামলায় জড়িয়ে বিধ্বস্ত এ রাজ্যের সরকার। অর্থের অভাবে ডিএ দিতে পারছেন না মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি কর্মীদের আন্দোলন চলছে কবে থেকে। তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া যেন এই টাটা মামলার রায়। ২০০৬ সালে ক্ষমতায় এসে সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শুরু হয় জমি অধিগ্রহণও। অনিচ্ছুক কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে আন্দোলনে নামে বিরোধী দল তৃণমূল। সেই আন্দোলনের জেরে রাজ্য ছাড়ে টাটা গোষ্ঠী। উঠে যায় ন্যানো প্রকল্প। সেই আন্দোলনের রেশ ধরেই এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। মন্ত্রিসভা গঠন করেই অনিচ্ছুক চাষীদের জমি ফেরত দিতে আইন তৈরি করেন মুখ্যমন্ত্রী।

Tata Motors wins arbitral award of Rs 766 crore plus interest in Singur plant case

সেদিনের সেই জয়ই যেন আজ যন্ত্রণা হয়ে দেখা দিয়েছে তৃণমূল সরকারের সামনে। যদিও আরবিট্রাল ট্রাইবুনালের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে আবেদন করার জায়গা তাঁদের রয়েছে। তবে এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে চলেছে রাজ্য সরকারের, তা নিয়ে এখনও কিছু জানা যায়নি। এ নিয়ে মুখ খুলতে চাননি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের কর্পোরেট সংযোগের প্রধান সোমদত্তা বসুও।

যে সিঙ্গুর একদিন বামশাসনের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিল, সেই সিঙ্গুরের মাটি নিয়ে টাটার জয়ে খুশির ছোঁয়া সিপিএমের অন্দরেও। সিপিএমের রাজ্যসম্পাদক মহম্মদ সেলিমের দাবি, রাজ্যের বেকারদের স্বপ্ন ভাঙার মাশুল দিচ্ছে তৃণমূল। বিজেপির গলাতেও পরোক্ষ ভাবে শোনা গিয়েছে একই সুর। রাজ্য বিজেপির মুখ্য মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, তাঁরা বলপূর্বক জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু তারা কারখানার পক্ষে ছিলেন। কারণ সিঙ্গুরে চাষের জমির চরিত্র বদলে গিয়েছিল ততদিনে। তা আর চাষের যোগ্য ছিল না। ফলে সেখানে কারখানা হলে কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হত বলেই মত পদ্মশিবিরের। যেখানে আন্তর্জাতিক মানের অটোমোবাইল হাব হতে পারত, তা তৃণমূলের হঠকারী আন্দোলন আর সিপিএমের অদূরদর্শিতায় শ্মশানে পরিণত হয়েছিল বলেই দাবি তাঁর। পাশাপাশি শিল্পপতিদের কাছেও ভুল বার্তা গিয়েছিল এই ঘটনায়। ফলে আদালত এদিন যে রায় দিয়েছে, তার পক্ষেই দাঁড়িয়েছে রাজ্য বিজেপিও।

আরও পড়ুন: পথের কাঁটা চিনেই সিঙ্গুর অস্ত্রে শান মমতার

তবে সেদিন যে জয় আবির খেলে, মিছিল করে উদযাপন করেছিল তৃণমূল, তা যে বছর পনেরো পরে এই ভাবে কাঁটা হয়ে ফিরে আসবে, তা বোধহয় দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি তৃণমূল। টাটা মোটর্সের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ ও তার সুদ, সব মিলিয়ে এক হাজার কোটি টাকারও বেশি খয়রাতি দিতে হবে রতন টাটার সংস্থাকে। এই পরিস্থিতিতে কী করবে নবান্ন, আপাতত সেদিকেই তাকিয়ে গোটা বাংলা।

 

More Articles