অতিরিক্ত চাপে কাজ করলেই সেরা পারফর্ম্যান্স! কেন এমন ধারণা ভারতের চাকরির বাজারে?
Indian Work Culture: পরিসংখ্যান বলছে শতকরা ৫১ ভাগ ভারতীয় কর্মচারী সপ্তাহে ৪৯ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন, অর্থাৎ সোম থেকে শুক্র কর্ম দিবসের হিসাবে দিনে প্রায় ১০ ঘণ্টার চেয়েও বেশি!
“অতিরিক্ত কাজ করাকে মহিমান্বিত বলে মনে করা হয়, এমন কর্মসংস্কৃতিরই বলি আমার মেয়ে...” ২৬ বছরের তরুণী চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আন্না সেবাস্টিয়ান পেরিলের অকাল ও অস্বাভাবিক মৃত্যুতে তাঁর 'বস'-কে লিখেছিলেন আন্নার মা। ২০২৪ সালের ১৯ মার্চ কাজে যোগ দিয়ে ২০ জুলাই মৃত্যু! চার মাসের মধ্যে হারিয়ে যায় একটি তাজা প্রাণ, আগামী ভারতবর্ষের এক বুনিয়াদ। গত বছরে সামাজিক মাধ্যমে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল, যেখানে আঞ্চলিক প্রধান বিভিন্ন শাখার ম্যানেজারকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছিলেন কাজের খতিয়ান চেয়ে। ‘কারোশি’ নামক একটি জাপানি শব্দ খুবই প্রচলিত, যার অর্থ কাজের চাপে মৃত্যু। ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বা আমাদের মতো ছদ্ম সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ মুনাফা লাভের যুগে এই দৃশ্যগুলি কাকতালীয় নয়। দেশের আনাচে কানাচে হরদম এই উদাহরণগুলি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
বাড়তি কাজের চাপ এখন জেন–Z-এর কর্মীদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জরিয়ে আছে। ফলস্বরূপ তরুণদের মধ্যেও কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের প্রবণতা বাড়ছে। ২০২১ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও আন্তর্জাতিক শ্রমাধিকার সংস্থা (ILO) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। সেখানে দেখা গেছে, সারা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে সাত লক্ষ মানুষ কাজের মাত্রাতিরিক্ত চাপে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হয়ে মারা গেছেন। সেই গবেষণায় আরও উঠে এসেছে যে, সপ্তাহে ৩৫-৪০ ঘণ্টা কাজ করা কর্মীদের থেকে সপ্তাহে ৫৫ ঘণ্টা কাজ করা কর্মীদের স্ট্রোকের ঝুঁকি শতকরা ৩৫ ভাগ বেশি।
শুধু শারীরিক ধকল নয়, মানসিক ক্লান্তির পরিমাণ বহুগুণ বেশি। ব্যাপারটা অনেকটাই পদার্থবিদ্যার হুকের সূত্রের মতো। স্ট্রেস অর্থাৎ চাপ বাড়লে স্ট্রেন বা বিকৃতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। এইভাবে চাপ বাড়তে বাড়তে ব্রেকিং পয়েন্টে এসে পৌঁছলে মুখ থুবড়ে পড়ে গাড়ির চাকা। মনে পড়ে যায়, আত্মহত্যার আগে বাজাজ ফিনান্সে চাকরি করা ৪২ বছর বয়সি তরুণ সাক্সেনার সেই করুণ স্বীকারোক্তি, “আমি গত ৪৫ দিন প্রায় ঘুমাইনি…”।
আরও পড়ুন- আবার কাজের চাপে যুবতীর মৃত্যু! কীভাবে এত বিষিয়ে গেল ভারতে চাকরির পরিবেশ?
কেন এত চাপ কাজের জায়গায়? একটুও চাপ যদি না থাকে, তাহলে তো কর্মীদের ভেতরে আলস্য ক্রমশ বাড়বে, সর্বোপরি চাপের মাথায় তো সব থেকে সেরা কাজটি বেরিয়ে আসে যোগ্য কর্মীদের থেকে। বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার কর্ণধাররা তেমনটিই মনে করেন। যেমন ইনফোসিসের প্রাক্তন সিইও নারায়ণ মূর্তির মতামত, “সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করা উচিত কর্মীদের”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জার্মানি, জাপান প্রভৃতি উন্নত দেশগুলির কর্মীরা নাকি এমনটাই করে আসছেন কিন্তু তার ফল ওই ‘কারোশি’। আসলে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বাড়তি কাজ করাটা, আরও পরিষ্কার করে বললে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করাটা বেশি উৎপাদনশীল মনে করা হয়!
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রমাধিকার সংস্থার (ILO) তথ্য থেকে জানা গেছে, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা কর্মী সংখ্যার নিরিখে ভারতের স্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয়। পরিসংখ্যান বলছে শতকরা ৫১ ভাগ ভারতীয় কর্মচারী সপ্তাহে ৪৯ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন, অর্থাৎ সোম থেকে শুক্র কর্ম দিবসের হিসাবে দিনে প্রায় ১০ ঘণ্টার চেয়েও বেশি! হসপিটাল, থানা ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছাড়াও বিভিন্ন কোম্পানিতেই রাতদিন ২৪ ঘণ্টা- বিভিন্ন শিফটেই কাজ চালু রাখা হচ্ছে। সব জায়গায় পর্যাপ্ত কর্মী নেওয়া হচ্ছে না। রাম ছেড়ে দিলে তাঁর জায়গায় কোনও লোক নেওয়া হচ্ছে না, অগত্যা সেই কাজের ভার পড়ছে শ্যামের ঘাড়ে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ডেল কার্নেগী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের এক কর্ণধার পল্লবী ঝা-র কথা, “দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার অর্থই হলো কোম্পানি মানব সম্পদের বিকাশে গড়িমসি করছে, যার ফলে ক্রমশ বাড়ছে কর্মভার”।
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার, বর্তমানে কর্ম দিবসের নির্দিষ্ট শুরুর সময় থাকলেও শেষের কোনও সীমারেখা নেই। তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যাঙ্কিং, ইত্যাদি ক্ষেত্রে কর্মীরা তো রাত এগারোটার সময়ও লগ আউট করতে পারেন না অনেকদিন। হোয়াটসঅ্যাপের কল্যাণে তো এখন ২৪ ঘণ্টাই কর্মীদের নড়নচড়ন বসের আঁখিপটে। মেসেজ পাওয়ার মিনিট দশেক পরেও কেন 'রিপ্লাই' এল না, অথবা কালো টিক নীল হলো না কেন– এসবের কারণে মানসিক চাপ বাড়তে থাকে গুণোত্তর প্রগতিতে। এসবের নেপথ্যে আছে ‘ডেডলাইন’ নামক এক অলীক বস্তু। গ্রাহকদের অযৌক্তিক দাবি মেটাতে গিয়ে নিজের কর্মীদের বলি দিচ্ছে অনেক সংস্থাই। এর সঙ্গে উপরি পাওনা হিসাবে জুটেছে টার্গেট পূরণের গাজর।
কেবল ‘ডেডলাইন’ ও 'টার্গেট' পূরণ নয়, কোম্পানিগুলো এমনভাবে কাজ করছে যে, তারা যেন দু-তিন দশক প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে পারে। এসবের ফলে জেন–Z-র উপর চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। দমবন্ধ এই অবস্থায় টিকে থাকা কিছু জেন–Z কেবল উপরে ওঠার খিদেয় ভর করে হয়ে যাচ্ছেন টিম লিডার, বা দলনেতা। নেতা-কর্মীর সম্পর্কের উন্নতিতে মনোনিবেশ না করে, তাঁরা মেতে আছেন কাজে। এই তাড়নায় চাপা পড়ে যাচ্ছে মানব সম্পদের বিকাশ! ফলে উৎকণ্ঠা, হতাশা, স্মৃতিলোপ, মেজাজ বিভ্রাটের মতো মানসিক ব্যাধির স্বীকার হচ্ছে জেন–Z প্রজন্ম। সেই সঙ্গে পেশির ব্যথা, স্পন্ডোলাইসিস, মাইগ্রেন, নিদ্রাহীনতা গ্রাস করছে তরুণ প্রজন্মকে।
কলকাতা, পুনে, নয়ডা, বেঙ্গালুরু- গোটা ভারতেই দৃশ্যটা প্রায় একই রকম । কিন্ত কেন এত কাজের চাপ এখানে? কাজের সুনির্দিষ্ট সময় সীমা নেই, ২৪ ঘণ্টা নজরদারি তো আছেই, সেই সঙ্গে কর্মীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের দিকে নজর না দিয়ে বেশিরভাগ মুনাফা নিজের ঘরে তোলার মানসিকতাই নষ্ট করে দিচ্ছে সুস্থ কাজের পরিবেশকে। ছুটির দিনে কাজ না করলেও কাজের চাপের আবহ ব্যাস্ত করে রাখছে কর্মীদের মন ও মগজ। এ ব্যাপারে সেনানায়কের ভূমিকা পালন করছে মোবাইল ফোনগুলি। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী, জোনাথন হাইড তাঁর সদ্য প্রকাশিত 'The Anxious Generation' নামক বইটিতে জেন–Z-কে বোঝাতে ‘ফোন ভিত্তিক শৈশব' (Phone based childhood’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। ‘খেলাধুলা ভিত্তিক শৈশব' (Play based childhood)’ এই তরুণ প্রজন্মের অনেকেরই ভাগ্যে জোটেনি।
আরও পড়ুন- ৭০ ঘণ্টা কাজের দাবি সত্যিই ন্যায্য? কতক্ষণ কাজ করেন এলন মাস্ক, সুন্দর পিচাইরা?
সপ্তাহে সোম থেকে শুক্র কর্মীরা কাজ করবে, আর সপ্তাহান্তে বিশ্রাম নেবে, পুরনো এই ধারণা ত্রুটিপূর্ণ। আসলে কাজের পাশাপাশি ভালো থাকার উপাদানগুলোকে কোনও সময় ব্যবধানে ভাগ করা উচিত না। কোম্পানিগুলোকে অবশ্যই সপ্তাহের প্রতিদিনই কর্মীদের স্বল্প সময়ের অবসরের সুযোগ দিতে হবে, যাতে কর্মীদের মানসিক বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়। দিনের পর দিন লড়াই করতে থাকা শরীর ও মন নিয়ে কর্মীরা যখন কাজের জায়গায় বাড়তি চাপের সম্মুখীন হয়, তখন অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে, এমনকী সপ্তাহ শেষে নতুন সোমবারে কর্মীরা বিষণ্ণ চিত্তে অফিস যায়, যেটি সত্যিই হতাশাজনক।
তাহলে মুক্তির পথ? কোম্পানিগুলিতে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের তথ্য ভাণ্ডার রক্ষণাবেক্ষণ করা উচিত, যার কাজ হবে কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজখবর রাখা, প্রয়োজনে মাসে মাসে কাউন্সেলিংয়ের বন্দোবস্ত করা। পাশাপাশি কাজের ভার যথাযথভাবে বণ্টন হচ্ছে কিনা, কর্মীরা তাঁদের বরাদ্দ ছুটি নিতে পারছে কিনা, সেসব বিষয়ে খেয়াল রাখাও দরকার। অফিসে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করা, কর্মীদের ‘ওয়ার্ক-লাইফ’ ভারসাম্য ঠিক আছে কিনা খেয়াল রাখা, একই কোম্পানির বিভিন্ন শাখার মধ্যে পারস্পারিক দ্বেষ সরিয়ে কর্মীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা, এমন নানাবিধ কর্মচারী স্বার্থ সম্পর্কিত গঠনমূলক সিদ্ধান্ত প্রতিটি কোম্পানির নেওয়া উচিত। বিশ্বায়নের যুগে অনেক মেধাবী জেন-Z-ই কিন্ত মাস মাইনের তোয়াক্কা না করে ফ্রিল্যান্সিংয়ের দিকে ঝুঁকছে, এটাও বিভিন্ন কোম্পানির নীতি নির্ধারকদের মাথায় রাখা দরকার।
অজস্র আশঙ্কাজনক পরিসংখ্যানের মধ্যে আশার আলো এই যে, ইদানিং বড় বড় কোম্পানিগুলো মানব সম্পদ উন্নয়নে জোর দিচ্ছে। প্রত্যেক ইউনিট বা দলের নেতারা কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষ পারিবারিক সামস্যায় পাশে দাঁড়াচ্ছে। কিন্ত এখনও এই ধরনের কোম্পানির সংখ্যা নেহাতই সামান্য।