তিমির কৃত্রিম মল তৈরি করে সমুদ্রে ঢালছেন বিজ্ঞানীরা, নেপথ্যের কারণ শুনলে চমকে যাবেন

Climate Change: তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু। এই পরিস্থিতিতে নীলগ্রহকে ঠান্ডা করতে নাকি কৃত্রিম ভাবে তিমির বর্জ্য তৈরি করে সমুদ্রে ফেলছেন বিজ্ঞানীরা।

একসময় চূড়ান্ত অপচয়, প্রকৃতিকে নিয়ে যা খুশি করার মাশুল আজ মানুষ গুনছে হাতে হাতে। ভয়ঙ্কর ভাবে বাড়ছে পৃথিবীর উষ্ণতা। বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে আজ উদ্বেগে গোটা বিশ্বের আপামর পরিবেশবিজ্ঞানী মহল। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ু। এই পরিস্থিতিতে নীলগ্রহকে ঠান্ডা করতে নাকি কৃত্রিম ভাবে তিমির বর্জ্য তৈরি করে সমুদ্রে ফেলছেন বিজ্ঞানীরা। ঠিকই শুনছেন, সামুদ্রিক এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটির বিষ্ঠাই আপাতত হয়ে উঠেছে পৃথিবীকে ঠান্ডা করার মোক্ষম টোটকা।

তিমি নামক সামুদ্রিক এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটিকে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু সেই আগ্রহের নেশাই একদিন তিমি প্রজাতির জন্য ডেকে এনেছিল মহাসঙ্কট। ক্রমেই মানুষের দেদার হস্তক্ষেপে বিলুপ্তির মুখে এগিয়ে যায় সামুদ্রিক এই আশ্চর্য প্রাণীটি। বিংশ শতাব্দীর দিকে নাকি এই সামুদ্রিক প্রাণীটির শরীরের চর্বি ও হাড়ের চাহিদা ভয়ঙ্কর ভাবে বেড়ে যায়। জানা যায়, শিল্প বিপ্লবের সময় ক্রমশ জরুরি হয়ে পড়েছিল তিমি মাছের চর্বি দিয়ে প্রস্তুত করা এক ধরনের তেল। অবশ্য তার আগে থেকেই, প্রায় ৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদই তিমি শিকারকে ঘিরে একটি সংঘবদ্ধ শিল্প গড়ে উঠেছিল। সেই থেকেই বাড়তে শুরু করে নির্বিচারে তিমিনিধনের ধুম। বিশ শতকের দিকে যা মাত্রাছাড়া জায়গায় চলে যায়। কার্যত সে সময় প্রায় ৩০ লক্ষ তিমিকে হত্যা করা হয়েছিল। যা বিশ্বের বৃহৎ তিমি জনসংখ্যার প্রায় ৯৯ শতাংশ। আর এই ভয়াবহ নিধনযজ্ঞ তিমির মতো এক আশ্চর্য প্রাণীর অস্তিত্বকে তো বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েইছে, তেমনই ধ্বংস করেছে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রকে। কার্যত এই অপরিমেয় তিমি শিকারের কোপ পড়েছে প্রকৃতির উপরেও, যে দেনা শোধ করা আজও বাকি আমাদের।

আরও পড়ুন: তিমি মাছের শরীরে লুকোনো দুর্মূল্য সোনা! কীভাবে মানুষের লোভের শিকার হচ্ছে এই প্রাণী?

সর্বপ্রথম তিমি শিকার শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৩০০০ বছরের সময়ে। সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী শিকারের একটা দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন উপকূলীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই। সপ্তদশ শতাব্দীতে সংঘবদ্ধ ভাবে তিমি শিকার শুরু হয় শিল্পক্ষেত্রের প্রয়োজনে। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে তা পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করে। বিংশ শতকের প্রথম অর্ধাংশে তিমি শিকারি জাহাজের পাশাপাশি মৎস্য-প্রক্রিয়াজাতকরণ জাহাজেরও রমরমা হয়। ১৯৩০-এর কাছাকাছি সময়ে বছরে প্রায় ৫০ হাজার করে তিমিহত্যা করা হত। যার ফলে উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পেতে থাকে তিমির একাধিক প্রজাতি। যাতে টনক নড়ে আন্তর্জাতিক হোয়েলিং কমিশন, আই.ডব্লিউ.সি-র। এরপরেই ১৯৮৬ সালে নিয়ম করে বন্ধ করা হয় বাণিজ্যিক তিমি শিকার। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ব্যাপক তিমি শিকারের প্রভাবে তিমির পাড়া প্রায় ফাঁকা।

এখন সেই তিমিদের এলাকা তাদের ফিরিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছে এক দল গবেষক-বিজ্ঞানী। এই পৃথিবীর সমুদ্র থেকে যাতে চিরতরে হারিয়ে না যায় তিমিরা, তার জন্য চেষ্টার ত্রুটি নেই তাদের। পরীক্ষায় প্রমাণিত যে তিমি আসলে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিমির এমন বহু প্রজাতি রয়েছে, যারা একেবারে গভীর সমুদ্রে প্রবেশ করে শিকার ধরে। সমুদ্রের এমন জায়গায় পৌঁছে যায় তারা, যেখানে সাধারণত অন্য কোনও প্রাণী পৌঁছতে পারে জলের চাপ ব্যাপক হওয়ায়। এই সমুদ্রের তলদেশের এই গভীরে পৌঁছে বহু সময়েই তিমিরা অনুভব করে, সমুদ্রের জলস্তরের চাপে তাদের শরীরের ছিদ্রগুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সে সময় নিজেদের আরাম দিতেই তিমিরা চলে আসে সমুদ্রপৃষ্ঠির দিকে, যেখানে তাদের মলত্যাগের ফলে সমুদ্রের একটি বিশেষ জায়গায় লোহা, নাইট্রোজেন ও ফসফরাসের প্রবাহ বেড়ে যায়।

সেই বিষ্ঠা সূর্যের আলোর প্রভাবে এসে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন নামে এক ধরনের অনুজীবের বাড়বাড়ন্তে সাহায্য করে। যাকে আসলে সামুদ্রিক খাদ্যশৃঙ্খলের ভিত্তি বলে মনে করা হয়। এবং এই যে সমুদ্রের মধ্যে দুর্দান্ত একটি রাসায়নিক খেলা ঘটল, তার ফল কিন্তু দেখা যায় রাতারাতি। অচিরেই কয়েক বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেখা যায় সবুজের এক আশ্চর্য চাদর।

ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা সাউথইস্টের সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী হেইডি পিয়ারসন জানিয়েছেন, তিমির শরীরজাত বর্জ্যে আসলে সাধারণ সামুদ্রিক জলের তুলনায় অন্তত ৩-৭ গুণ বেশি পুষ্টি থাকে, যা সমুদ্রের তলদেশকে আরও বেশি উৎপাদনশীল করে তোলে। এই যে ফাইপ্ল্যাঙ্কটন, তা নাকি সালোকসংশ্লেষের মাধ্যমে বছরে প্রায় ২২ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাউডকে ব্যবহার করে। যা প্রায় ৪.৮ মিলিয়ন গাড়িঘোড়া দ্বারা সৃষ্টি করা কার্বন ডাই অক্সাইডের সমান। সমুদ্রের তলদেশে এই ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের মৃত্যু মানে ক্রমশ কার্বন ডাই অক্সাইডের এই ব্যবহার তলানিতে ঠেকা।

দীর্ঘদিন ধরে লাগাতার তিমি শিকারের এই প্রবাহের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছে তিমির যাতায়াত প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। যার ফলে এই প্রক্রিয়া আর সম্ভব হচ্ছে না তেমন করে। অগত্যা ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের জন্ম যেমন হচ্ছে না, তেমনই কার্বন ডাই অক্সাইডের এই সুব্যবহারের রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এই অবস্থায় সামুদ্রিক বিজ্ঞানী এডউইনা ট্যানার এবং হোয়েলএক্স ফাউন্ডেশনের কর্মীদের নিয়ে তৈরি একটি দল তৈরি করে ফেলেছেন কৃত্রিম বা সিন্থেটিক তিমির মল। আর সেই পদার্থ বানিয়ে তা ফেলা হচ্ছে সমুদ্রের অন্দরে।

আরও পড়ুন: Climate Change: বিকল স্বাস্থ্য, ভয়ঙ্কর রোগের মুখে দেশ! যে আশঙ্কার কথা শোনাল ল্যান্সেটের রিপোর্ট

সিলিকা, আয়রন, ফসফরাসের মতো উপাদান দিয়ে তৈরি কৃত্রিম এই রাসায়নিকটি তৈরি করা হয়েছে এমন ভাবে, যাতে তিমির মল বা বিষ্ঠাকে সঠিক ভাবে প্রতিস্থাপন করতে পারে এটি। যা বায়ুমণ্ডলে বেড়েই চলা কার্বন ডাই অক্সাইডের এই বিপজ্জনক ঘনত্বকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করবে। যার ফলে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য ফিরবে, বাড়বে মৎস্যসম্পদ এবং পৃথিবীর সাধারণ প্রাকৃতিক যে ছন্দ, তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। আপাতত পৃথিবীকে ভয়ঙ্কর এই উষ্ণায়নের হাত থেকে বাঁচাতে এমনই বিকল্প পন্থার কথা ভেবেছেন গবেষকেরা।

More Articles