বুদ্ধি ফুটুক নাই ফুটুক, AI জাগ্রত দ্বারে!
Artificial Intelligence: যদি প্রযুক্তির উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়, AI যদি নিজের মতো করে চিন্তা করতে শুরু করে, তখন কী হবে? আমরা AI-কে ঠিক কতটা বিশ্বাস করতে পারি?
বছর কুড়ি-পঁচিশ আগে মাধ্যমিকে একটা রচনা বেশ জনপ্রিয় ছিল— ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’? তাতে নিউক্লিয়ার এনার্জি , অস্ত্রশস্ত্র এসব নিয়ে কত কিছুই না পাখিপড়া করাতেন স্যারেরা। তারপর একটু বড় হয়ে জীবনে যখন সন্তর্পণ অনুপ্রবেশ হল সিনেমার, খুব স্বাভাবিক কারণেই পপুলার হলিউডের একের পর এক ছবি মনে অমোঘ দাগ কেটে গিয়েছিল। ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’, ‘টার্মিনেটর’ বা ‘ব্লেড রানার’ এর মতো ছবিগুলির কেন্দ্রীয় থিমই ছিল— ঠিক কিভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) মানবজাতির সর্বোত্তম আবিষ্কার হয়েও ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে তার ভয়াবহ শত্রু। এই ছবিগুলি এমন এক ভবিষ্যতের কল্পনা করে যেখানে AI এতটাই স্মার্ট হয়ে ওঠে যে মানুষের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এসব ছবি প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, যদি প্রযুক্তির উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায়, AI যদি নিজের মতো করে চিন্তা করতে শুরু করে, তখন কী হবে? আমরা AI-কে ঠিক কতটা বিশ্বাস করতে পারি? আমরা কি তবে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের পথ তৈরি করছি? নাকি এই সব কিছুই এক অলীক ভ্রম। ছবিগুলি এমন এক ভবিষ্যতের কথা তুলে ধরে, যেখানে মানবিকতা আর মেশিনের মধ্যে থাকা সীমারেখা ক্রমাগত ক্ষীণ হয়ে যায়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, শৈশবের সেই সব ছবি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আর মোটেই ভবিষ্যতের কল্পনা নয়; আমরা আজ এমন কিছু তৈরির প্রক্রিয়ায় আছি যা আমাদের এই অস্তিত্বের আধিপত্যকে অনায়াসে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, এমনকী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়ে উঠতে পারে মানবজাতির শেষ স্বাধীন আবিষ্কার। তবে এই লেখার উদ্দেশ্য মোটেই কোনও ক্লিকবেটীয় মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে পাঠককে লেখাটি পড়িয়ে নেওয়া নয়, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) সম্পর্কে একটি প্রাথমিক আলোচনা গড়ে তোলা। যা থেকে আমাদের জীবনযাপনের প্রায় সর্বকক্ষে ব্যবহৃত এমন একটি পরিবর্তনশীল শক্তিকে নিয়ে কথা বলা যায়, যা আমাদের অজান্তেই আজ ছাপ ফেলেছে জীবনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রতিটি ক্ষেত্রে, ত্বরান্বিত করছে আমাদের দৈনন্দিন উৎপাদনশীলতাকে।
এক্ষেত্রে প্রথমেই জেনে নিই, এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আসলে কী? এটি কীভাবে আমাদের বিশ্বকে পরিবর্তন করছে? ১৯৫৬ সালে ডার্টমাউথ সম্মেলনে জন ম্যাককার্থি প্রথম এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শব্দটিকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন, যার সংজ্ঞা হিসাবে বলা যায় যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) হল এমন একটি প্রযুক্তি যেখানে মানুষের বুদ্ধিমত্তা অনুকরণ করা হয়। এবং মেশিনকে এমন ভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে তারা চিন্তা করতে, শিখতে এবং এমন কাজ করতে পারে যেগুলিতে সাধারণত মানুষের বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। এই কাজগুলির মধ্যে রয়েছে ভাষা শনাক্তকরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যা সমাধান, ভাষা অনুবাদ, এবং দৃশ্যমান বিষয়কে বোঝা ইত্যাদি। যে প্রাথমিক মডেলের উপর এআই কাজ করে তার নাম মেশিন লার্নিং (ML), যেখানে মেশিন অ্যালগরিদম তাতে ব্যবহৃত ডেটা থেকে শিখে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও উন্নত হয়, কোনও অতিরিক্ত বাহ্যিক প্রোগ্রামিং ছাড়াই। এর পাশাপাশি ডিপ লার্নিং, যা এমএল-এরই একটি শাখা, নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে মানুষের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ অনুকরণ করে জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান করে। মূলত, AI ডেটা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে একটি প্যাটার্ন চিহ্নিত করে এবং সেই প্যাটার্নের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত বা পূর্বাভাস প্রদান করে। আর ফলতই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত বেশি ডেটা সংগ্রহ করে, ততই নিজের কর্মক্ষমতাকে আরও উন্নত করে তোলে।
আরও পড়ুন: AI-ই বিজ্ঞানীদের শেষ ভরসা? কী বলছেন রসায়নে নোবেলজয়ী হ্যাসাবিস?
প্রয়োগের তারতম্য অনুযায়ী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মূলত দু'টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়, ন্যারো AI (দুর্বল AI), যা একটি সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের জন্য ডিজাইন করা হয়। যেমন ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট (সিরি বা অ্যালেক্সা) অথবা সুপারিশ অ্যালগরিদম যা নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজন ব্যবহার করে। দ্বিতীয়টি জেনারেল AI (শক্তিশালী AI) যা আরও উন্নত AI মডেল, যেটি মানবীয় জ্ঞান ও দক্ষতার সমতুল্য। এআই-এর একটি বড় লক্ষ্য হল এই কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা (এজিআই) নির্মাণ। এটি এমন একটি যন্ত্র যা মানব মস্তিষ্কের মতো আচরণ করতে পারে, যেটা আমাদের মতোই শিখতে, যুক্তি তৈরি করতে, চিন্তা বা অনুভব করতে এবং সৃজনশীল হতেও সক্ষম। যদিও এজিআই-এর ধারণা এখনও তাত্বিক স্তরেই রয়েছে এবং এটি নিয়ে বিস্তর গবেষণাও চলছে। তবে একবার এজিআই সফলভাবে তৈরি হলে, এর ক্ষমতা এতটাই বেশি হতে পারে যে এটি সমগ্র মানবজাতির থেকেও বেশি কার্যক্ষম হতে পারে, যাকে আমরা সহজ কথায় 'সুপারইন্টেলিজেন্স'-ও বলতে পারি। আগামী দিনে যা আমাদের অর্থনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, রাজনীতি এবং জীবনযাত্রার সমস্ত দিক পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখবে।
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) আমাদের রোজের জীবনে এতটাই মিশে গিয়েছে যে এটি আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলিকে আরও সহজ, দ্রুত এবং দক্ষ করে তুলছে। এর অন্যতম ব্যবহার হল স্মার্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট যেমন সিরি, অ্যালেক্সা বা গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট, যেগুলি ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমে রিমাইন্ডার সেট করে, প্রশ্নের উত্তর দেয় এবং স্মার্ট হোম ডিভাইস নিয়ন্ত্রণ করে। এআই ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুপারিশও প্রদান করা যায়, যেমন নেটফ্লিক্স, ইউটিউব বা অ্যামাজন আমাদের পছন্দ এবং ব্রাউজিং ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে সিনেমা, ভিডিও বা পণ্য সুপারিশ করে। শুধু তাই নয় আইবিএম ওয়াটসন-এর মত এআই মডেলগুলি স্বাস্থ্যসেবায়, রোগ নির্ণয়,মেডিকেল ইমেজ বিশ্লেষণ এবং রোগের পূর্বাভাস দিতে সহায়তা করে। পরিবহন ক্ষেত্রে, এআই গুগল ম্যাপসের মতো নেভিগেশন অ্যাপগুলিকে চালিত করে, যা রিয়েল-টাইম ট্রাফিক আপডেট এবং রুট অপ্টিমাইজেশন প্রদান করে। টেসলা বা জাওমির মত স্বয়ংচালিত গাড়িগুলি, এআই ব্যবহার করে রাস্তায় তার গতির সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়া এআই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলিতেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে এটি কনটেন্ট কিউরেট করে, স্প্যাম সনাক্ত করে এবং অনুপযুক্ত কনটেন্ট চিহ্নিত করে নিরাপত্তা বাড়ায়। শুধু তাই নয় ফিনান্সের ক্ষেত্রেও এআই জালিয়াতি শনাক্তকরণ, বিনিয়োগ পরিচালনা এবং চ্যাটবটের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় গ্রাহকসেবা প্রদানে সাহায্য করে। অনলাইন শপিং থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যন্ত, এআই আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করছে, একঘেয়ে কাজ স্বয়ংক্রিয় করে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকেও উন্নত করে তুলছে।
তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিপুল সুযোগসুবিধা এবং উপকারিতা থাকলেও এটি অবসম্ভাবী ভাবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জও তৈরি করে। AI এর অন্যতম প্রধান উদ্বেগ হল কর্মসংস্থানের ক্ষতি; যখন AI দ্বারা স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি আরও উন্নত হবে, অনেক কাজ— বিশেষ করে যা পুনরাবৃত্তিমূলক, সেগুলিতে হয়তো মানুষের প্রয়োজন কমবে। যা কার্যত বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক অসমতার দিকে নিয়ে যায়। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল এআই অ্যালগরিদমে পক্ষপাত বা biasness। যদি AI সিস্টেমকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত তথ্য পক্ষপাতমূলক হয়, তবে এআই দ্বারা উৎপন্ন ফলাফলগুলিও এই পক্ষপাতদুষ্ট হবে, এবং সেই পক্ষপাতিত্বকে আরও শক্তিশালী কিংবা খারাপ করে তুলতে পারে, যা নিয়োগ, ঋণদান এবং আইনপ্রয়োগের মতো ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা সৃষ্টি করতে পারে। ফলে বলাই যায়, এটি AI সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্বশীলতা এবং ন্যায়বিচারের বিষয় নিয়ে নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপন করেই দেয়। এছাড়া গোপনীয়তার ক্ষতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ। AI সিস্টেমগুলি কার্যকর হওয়ার জন্য প্রায়শই বৃহৎ পরিমাণ ব্যক্তিগত তথ্যের উপর নির্ভর করে, যা অনুপ্রবেশমূলক নজরদারি এবং তথ্যের অপব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়ায়। এই গোপনীয়তার ক্ষতি ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের মধ্যবর্তী আস্থা নষ্ট করতে পারে। তাছাড়া আমরা যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ক্রমাগত ভাবে AI-এর উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠি, তা আমাদের বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতাও কমতে থাকবে ক্রমশ।
আরও পড়ুন: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: যন্ত্রের যন্ত্রণা নাকি আধুনিক যুগের শাণিত হাতিয়ার?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আজ যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, অর্থনীতি, পরিবহন সহ বিভিন্ন খাতে আমাদের ভবিষ্যৎ গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তাই এআই ও তার প্রয়োগকে অস্বীকার করলে তা আমাদেরই সামগ্রিক বিকাশের ক্ষেত্রেই বাধা হয়ে উঠতে পারে। যেহেতু এআই কেন্দ্রিক প্রযুক্তিগুলি ক্রমাগত উন্নয়নশীল এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একীভূত হচ্ছে, তাই ব্যক্তি হিসেবে আমাদের এআই এবং এর ব্যবহার শেখার প্রতি মনোযোগ দেওয়া আবশ্যক। এটি শুধুমাত্র দ্রুত পরিবর্তিত চাকরির বাজারে টিকে থাকা ও প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করার জন্যই নয়, বরং এআইয়ের উন্নয়ন ও এআই সম্পর্কে বোঝাপড়া আমাদের উদ্ভাবন এবং সমস্যার সমাধানের জন্য এক নতুন দরজা খুলে দিতে পারে। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলাই যায় যে এআই অভিযোজন এই ক্রমবর্ধমান স্বায়ত্তশাসিত বিশ্বে, আর একটি 'চয়েস' নয় বরং হয়ে উঠেছে 'ফিটেস্ট'-দের 'সার্ভাইভাল' মন্ত্র।