এক অনতিক্রম্য বনস্পতির ছায়া...

Teachers' Day 2023: একটি খদ্দরের পাঞ্জাবি, সাদা ধুতি, কালো ফ্রেমের চশমা আর পরিপাটি ক'রে আঁচড়ানো কেশদাম। স্যার পড়াতে এলেই দুরন্ত ছাত্ররাও শান্ত হয়ে যেত। শাস্তি তো দূরস্থান, স্যারকে কখনও বকতেও দেখিনি।

শ্রী কানাই কর্মকার।
নিবাস - বরাহনগর বাজারের গায়ে এক চিলতে টালির বসতি।
পেশা - শিক্ষকতা।
কর্মক্ষেত্র - দমদম বৈদ্যনাথ ইনস্টিটিউটশন।

হেন পরিচয় অনেক শিক্ষকমহাশয়ই বহন করে চলেন। কেবল স্থান-কাল-পাত্রের খানিক অদলবদল হয় মাত্র। কিন্তু আকাশের সকল জ্যোতিষ্কই যেমন ধ্রুবতারা হয় না, তেমনই সকল শিক্ষকমহাশয়ই কানাইবাবু হন না বা বলা ভালো, হয়ে উঠতে পারেন না। আজীবন এক সৎ নির্লোভ ঋষিতুল্য উৎসর্গপ্রাণ শিক্ষকতার সারস্বত সাধনায় আত্মস্থ না হলে, অভেদ প্রীতির বন্ধনে সকলের সঙ্গে একীভূত না হলে, প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী থেকে সহকর্মী - সকলের সাথে আমৃত্যু অক্ষুন্ন যোগ ও যোগাযোগ না রাখলে এমন অজাতশত্রু প্রাণের মানুষ হয়ে ওঠা যায় না। আমাদের স্কুলের আট দশকের ইতিহাসে বিরল জনপ্রিয়তা ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন স্যার। এ তাঁর জীবনের অনন্য অর্জন।

চিরকাল সারস্বত সাধনায় কাটিয়ে কোজাগরী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ভেসে চুরাশি বছর বয়সে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে স্যার চ'লে যান। নশ্বর দেহ অগোচরে দাহ হয়ে যায়, শরীর পঞ্চভূতে লীন হয়ে যায়, কিন্তু তিনি তো অমৃতধামের যাত্রী। সেখানেই তাঁর আসন। সেখানে সকলের ঠাঁই হয় না। অন্তত ঠাঁই হয় বলে বিশ্বাস হয় না।

আরও পড়ুন: ছাত্ররা টেনে নিয়ে গিয়েছিল শিক্ষকের জুড়িগাড়ি, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের যে কাহিনি জানে না অনেকেই

এ প্রয়াণ দুঃখের নয়। স্যার অকালে যাননি। এর কিছুদিন আগেই সহধর্মিনী প্রয়াত হয়েছিলেন। বার্ধক্যপীড়িত নিঃসঙ্গতায় শূন্যতার প্রহর গুণে চলছিলেন। অবশেষে প্রার্থিত ছুটি। একদিন যেতে হতোই। যেদিন যেতেন সেদিনই কান্না পেত। আবেগের মুহূর্তকে স্থৈর্য দিয়ে সংবরণ করার শক্তি অর্জন করতে পারিনি। তবু সত্যকে সহজ করেই নিতে হয়। সে পথ অশ্রুজলে পিচ্ছিল করার পথ নয়। সে পথ কুসুমাস্তীর্ণ। সে পথে স্যারের স্থিতি অখণ্ড ও পরিপূর্ণ শান্তিতে সমাহিত।

পিছিয়ে যাই তিন দশক। নবম শ্রেণির 'ক' বিভাগ। রাস্তার পাশে দোতলায় ঘর। কানাইবাবু বাংলা পড়াতে এলেন। সৌম্য দর্শন, স্নিগ্ধ মুখমণ্ডল, শান্ত উচ্চারণে নিবদ্ধ এক সুগভীর অথচ সুগম প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্যের সহাবস্থান। একটি খদ্দরের পাঞ্জাবি, সাদা ধুতি, কালো ফ্রেমের চশমা আর পরিপাটি ক'রে আঁচড়ানো কেশদাম। স্যার পড়াতে এলেই দুরন্ত ছাত্ররাও শান্ত হয়ে যেত। শাস্তি তো দূরস্থান, স্যারকে কখনও বকতেও দেখিনি। ছোটখাটো শীর্ণ চেহারায় এক মাধুর্যময় আভিজাত্যে সকলকে বশ ক'রে নিতে পারতেন।

কখনও পাঠসংকলন পড়াতেন, কখনও ব্যাকরণ। বোর্ডের ওপরে যখন লিখতেন, হস্তাক্ষরের এক ললিত স্থাপত্য খোদিত হত। কী অপূর্ব কলমসৌষ্ঠব! কত ছাত্রছাত্রী যে তাঁর হস্তাক্ষর অনুকরণ করার অক্ষম চেষ্টা করত, তা বলার নয়। স্যারের আরও একটি বিশেষত্ব ছিল এই যে, তিনি সচরাচর কালির পেনে লিখতেন এবং সবুজ, গোলাপী কালি ব্যবহার করতেন। সাদা কাগজে সে সব লেখা অপূর্ব সুষমায় ফুটে উঠত। শুধু সেইটুকু দেখার জন্যই যেন স্যারের ক্লাস করা যেত।

মনে আছে, একবার স্যারকে ব্যাসবাক্য-সহ একহাজার সমাস লিখে দেখতে দিয়েছিলাম। উনি দেখে দিয়েছিলেন। একবার ক্লাসে জিজ্ঞাসা করলাম, স্যার 'দর্ব' এর পদান্তর কী হতে পারে? স্যার পাল্টা জিজ্ঞাসা করলেন, 'দর্ব' অর্থ কী? বললাম, ‘রাক্ষস,। উনি বললেন, ‘কোথায় পাওয়া যায় এইসব কঠিন শব্দ’? আসলে তখন ঐ বয়সে কঠিন বাংলা শব্দ, বিশেষতঃ তৎসম শব্দ সংগ্রহ ও স্মৃতিবদ্ধ করার একটি প্রবণতা জুড়ে বসেছিল। চেষ্টা করেছিলাম, 'মেঘনাদ বধ' কাব্যের অনুসরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দে 'রাধেয় নিধন' লেখার। সে লেখা সম্পূর্ণ ক'রে স্যারকে দেখিয়েছিলাম কিনা বা দেখালেও স্যার কী মতামত দিয়েছিলেন, সে কথা আজ আর মনে নেই। তবে স্যার সর্বদাই সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় ও ভাবে লেখার ওপরই গুরুত্ব দিতেন। বয়সোচিত কারণেই হয়ত, একটু কঠিন ভাবে ও ভাষায় লিখে স্যারের বিরুদ্ধাচরণ করাই যেন রপ্ত ক'রে ফেলেছিলাম। পরবর্তীকালে বুঝেছি, সহজ লেখা মোটেই সহজ নয় এবং স্যার সেদিন সঠিক দিশাই দেখিয়েছিলেন।

বানানের বিষয়ে ভীষণ খুঁতখুঁতে ছিলেন স্যার। নিজে কখনও ভুল বানান লিখতেন না। কেউ লিখলে বেশ অখুশি হতেন। অবসর গ্রহণের পরেও আমৃত্যু অগণিত প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী, নিজের সহপাঠী, সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়মিত সক্রিয় যোগাযোগ রাখতেন। এমনকি অনেকদিন সংবাদ না পেলে অনেকের বাড়িতেও চলে যেতেন। প্রচুর চিঠিপত্র লিখতেন, ফোন করতেন। পরিবারের সকলের খবরাখবর নিতেন। আমাকেও বহুবার চিঠি লিখেছেন, কতবার ফোন করেছেন। আমিই বরং প্রতিবার উত্তর দিতে পারিনি বা দিইনি। গতবছর স্যার অসুস্থ হবার পরে করবো করবো করেও আর ফোন করা হয়নি। আর কখনও কথা হবে না। তাই নিয়ত অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছি।

স্যার স্কুলের সকল ধরনের কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকতেন। আমরা যখন নবম শ্রেণির ছাত্র তখন একবার সকলে মিলে দীঘা যাওয়া হয়েছিল। আমি না গেলেও আমার অনেক সহপাঠীরা গিয়েছিল। সেই ভ্রমণে বা তার আগে পরে নানা সময়ে হওয়া ভ্রমণে সঙ্গে থেকে স্যার সহযাত্রীদের পরম আপনজন হয়ে উঠতেন। স্কুলে সরস্বতী পুজোর সময়ে আমরা স্যারকে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে চাইতাম। উনি কোষাধ্যক্ষ হলে স্বেচ্ছাসেবক ছাত্রছাত্রীদের অকাতরে টিফিনের বাজেট বা অন্যান্য খরচ মঞ্জুর করতেন।

জীবনে কখনও প্রাইভেটে পড়াননি। কখনও কোনও ছাত্রছাত্রীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করেননি। প্রত্যেকের প্রতি সমান দরদ ও মমত্ববোধ ছিল। আমাদের পরের ব্যাচের ফার্স্ট বয় ছিল রাজীব। ওর পিতৃদেব প্রায় রোজই স্কুলে এসে ব'সে থাকতেন। মাস্টারমশাইদের গিয়ে ওনার পুত্রের ক্ষেত্রে একটু বিশেষ যত্ন নেওয়ার কথা বলতেন। শুনেছি, কানাইবাবু ওনাকে স্পষ্ট ও শান্তভাবে ব'লে দিয়েছিলেন যে, সকল ছাত্র-ছাত্রীই তাঁর কাছে সমান, তাই আলাদা ক'রে কারও প্রতি যত্ন নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

স্যারকে দায়সারাভাবে কখনও কিছু করতে দেখিনি। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর খাতায় প্রতিটি পঙক্তি খুঁটিয়ে পড়তেন ও নিজের ব্যাখ্যা ও মতামত লিখে দিতেন। প্রতিটি ভুল বানান সংশোধন ক'রে দিতেন। কোনও ছাত্রছাত্রীর অধঃপতন দেখলে কাছে ডেকে নানাভাবে বুঝিয়ে তাদের সঠিক পথে আনার চেষ্টা করতেন। স্কুলের পত্রপত্রিকার বিষয়েও তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিতেন। শেষবারও বললেন, একটি পৃষ্ঠায় দুটি কলম করে পত্রিকা ছাপানোর চেষ্টা করতে। এতে পড়া সহজ ও অক্লেশ হয়। মনে আছে স্যার শিখিয়েছিলেন, 'সপরিবারে' না লিখতে, শব্দটি হবে 'সপরিবার', অর্থাৎ পরিবারের সঙ্গে সুতরাং ‘সপরিবারে’ শব্দটি সঠিক নয়। 'বিনয়াবনত' শব্দটির ব্যবহারও ওনার কাছেই শেখা।

আমার ঠাকুরদা ইন্দুভূষণ সাহা কানাইবাবু স্যারের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী ছিলেন। স্যার একবার লিখেছিলেন, এই স্কুলে পড়লে ইন্দুবাবু আমার মাস্টারমশাই হতেন। ঠাকুরদার বিদায়ী মানপত্রটি স্যার স্বহস্তে লিখেছিলেন। স্যার আমাকে এতটাই স্নেহ-সান্নিধ্যে রেখেছিলেন যে, বিদ্যালয়ের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক শ্যামাপদবাবুকে বিদ্যালয়ের তরফ থেকে দেওয়া বিদায়ী মানপত্রটি তিনি নিজে না লিখে আমার মতন একজন অর্বাচীন নবম শ্রেণির ছাত্রকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন। এ আমার ছাত্রজীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি, সঞ্চয় ও গৌরব। পরে প্রয়াত শ্যামাপদবাবুর বাড়িতে গিয়ে সে লেখা আমি সংগ্রহ ক'রে এনেছি। ঐ বয়সে এইটি ছাড়া নিজের আর কোনও লেখাই আমার কাছে নেই। স্যারের স্নেহাশীর্ব্বাদ ছাড়া এ জিনিস সম্ভব হতো না।

স্যার পড়ানোর সময়ে নানা গল্প বলতেন। নিউ এম্পায়ার -এ শম্ভু মিত্রের একটিও নাটক বাদ দিতেন না। তাঁর মুখে শোনা রাজা অউদিপাউসের গল্প এতটাই বিহ্বল করেছিল যে তখনই ঐ ক্যাসেটটি কিনে শুনেও ফেলেছিলাম। দেবব্রত বিশ্বাসের গান পছন্দ করতেন। সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ ছিলেন। সর্বক্ষণ বই পড়তেন। ওনার কাছ থেকে বই উপহার পাননি এমন মানুষ বিরল। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে আছেন ভারতীয় ফুটবল দলের প্রাক্তন অধিনায়ক ভাস্কর গাঙ্গুলি, বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক শেখর দাস ও সঙ্গীতশিল্পী শান্তনু রায়চৌধুরী প্রমুখ।

অশক্ত দেহেও প্রতিবছর স্কুলের প্রাক্তনী সংসদের অনুষ্ঠানে আসতেন। রিক্সায় চড়া পছন্দ করতেন না। তিরাশি বছর বয়সেও বাসে, ট্রেনে করেই আসতেন। বেশ কিছুটা পথ হাঁটতেও হত। স্কুলের গেট দিয়ে প্রবেশমাত্র সকল প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা প্রণাম ও কুশল বিনিময়ের জন্য স্যারকে ঘিরে ধরত। রীতিমত লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হতো সকলকে। সেই ভিড় কাটিয়ে বসতে বসতেই স্যারের ঘন্টাখানেক কেটে যেত। অবসর গ্রহণের এত বছর পরেও এই ধরনের জনপ্রিয়তা, এত শ্রদ্ধা, এত সম্মান খুব খুব খুব কম মানুষই পেয়ে থাকেন। এর পর থেকে প্রাক্তনী সংসদের পরবর্তী অনুষ্ঠানগুলি অনেকখানি ফিকে হয়ে যাবে। একজন মাস্টারমশাই সহস্র ছাত্রের অধিক - সে বটবৃক্ষ হারিয়ে বড়ো অনাথবৎ অনুভব উপলব্ধ হচ্ছে।

বছর কয়েক আগে একবারই স্যারের বাড়িতে গিয়েছিলাম। রাস্তায় এগিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে ক'রে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। টালির চাল। একটি চৌকির ওপর টেলিফোন ও অগণিত বই। দৃষ্টি কমজোর হলেও পাঠাভ্যাসে ক্লান্তি নেই। স্যার ও জেঠিমা আপ্যায়ন করলেন। কথায় কথায় বললেন, ‘আজ এত এত নম্বর দেওয়া হয় অথচ আমার শিক্ষকজীবনে একটি ছাত্রকে অসাধারণ লেখার জন্য দশ-এ আট দিতে চেয়েছিলাম বলে হেড এক্জামিনার-কে ছাত্রটির লেখা পড়িয়ে তাঁর অনুমতি নিতে হয়েছিল’। স্যারের একমাত্র পুত্র সুমনও অসাধারণ মেধাবী। ইউপিএপসি - র মেন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও ইন্টারভিউ -তে আটকে গিয়েছিল। শুনেছি, ও যেবার মাধ্যমিক (উচ্চমাধ্যমিকও হতে পারে, সঠিক মনে পড়ছে না) পাশ করে, সেইবার সারা রাজ্যে মাত্র চারজন ছাত্র বাংলায় লেটার মার্কস পেয়েছিল। সুমন ছিল তাদের অন্যতম। এখন ও কলকাতা পৌরনিগমের উদ্ভিদবিদ্যা বিশারদ। পরপর মা ও বাবাকে হারিয়ে সুমন আজ বড়োই নিঃসঙ্গ।

নিজেই ভালো করে চলতে পারেন না তবুও সেইদিন ফেরার সময়ে স্যার কার্যত আমাকে বগলদাবা ক'রে বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে এলেন। কিছুতেই একা আসতে দিলেন না। একের পরে এক বাস চলে গেল সামনে দিয়ে। যতক্ষণ না ফাঁকা সিট পাওয়া গেল ততক্ষণ ছাড়লেন না। অতঃপর একটি ফাঁকা বাস এলে, কন্ডাক্টরকে ঠিক জায়গায় নামিয়ে দিতে বলে তবে বাসে উঠতে দিলেন। সেই মুহূর্তে আমি চোখের জল আটকে রাখতে পারিনি। ভালোবাসার বন্যা, কোন বাঁধ তাকে রুখতে পারে। বাড়ি পৌঁছানোর আগেই ফোন ক'রে খোঁজ নিলেন ঠিকমতো পৌঁছেছি কিনা। এবং কেবল আমি নই, সকলের সঙ্গেই তিনি এমনই করতেন। কানাইবাবুর মতন ছাত্রদরদী মাস্টারমশাইরা দিনে দিনে বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় হয়ে পড়ছেন। ইঁদুরের মতোন দৌড়তে গিয়ে আমরা মানুষের মতোন হাঁটতে ভুলে যাচ্ছি।

এমন মানুষকেও তাঁর কর্মজীবনে প্রারম্ভে প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। সম্ভবতঃ ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উনি চাকরিতে যোগদান করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তাঁর এই স্কুলের চাকরি ছাড়ার জন্য অনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। তাঁকে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া থেকে স্কুলের ক্লাসে এসে ছাত্রদের সামনেই আগ্নেয়াস্ত্রসহ ভয় দেখানোর ঘটনাও ঘটেছে। ছাত্ররা প্রতিবাদ করলেও স্যার নিরাপত্তার কারণেই ছাত্রদের নিবৃত্ত করেছেন। কোনও চাপের সামনে নতি স্বীকার করেননি। দুর্বৃত্তরা পিছু হটেছে।

স্যার যখন স্কুলে যোগদান করেন তখন প্রধান শিক্ষক মহাশয় ছিলেন প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র প্রয়াত শ্যামল চক্রবর্তী মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হ'লে তাঁকে স্কুলের পক্ষ থেকে যে সংবর্ধনা দেওয়া হয় সেই অনুষ্ঠানে একবারই আমি প্রমথবাবুকে দেখেছি। উনি ছিলেন শিক্ষকমহাশয়দেরও শিক্ষকমহাশয়। সকল শিক্ষক মহাশয়রাই ওনাকে ভীষন সমীহ করতেন, এমনকি ভয়ও পেতেন। কানাইবাবু লিখেছেন, একবার কয়েকজন সহকর্মী মিলে হাতিবাগানে সিনেমা দেখতে গিয়ে প্রমথবাবুকে দেখে কার্যত দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এ জিনিস আজকের দিনে ভাবাই যায় না। একবার আগাম না জানিয়ে 'ক্যাজুয়াল লিভ' নেওয়ায় প্রমথবাবু কানাইবাবুকে ডেকে বলেছিলেন, 'স্কুলে শিক্ষকতা কোনও চাকরি নয়, তাই একান্ত প্রয়োজন না হলে আপনার ছাত্রছাত্রীদের আগাম না জানিয়ে ছুটি নেবেন না। হয়ত ওরা নিজেদের অসুবিধা সত্ত্বেও আপনার ক্লাস করার জন্যেই সেদিন এলো অথচ আপনিই এলেন না। তাই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এ কাজ করবেন না।' কানাইবাবু আজীবন এই পরামর্শ শিরোধার্য ক'রে নিয়ে চলেছিলেন।

স্যারকে শেষবার দেখেছিলাম স্কুলের আরও একজন শিক্ষকের অবসর গ্রহণের অনুষ্ঠানে। হাতে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে অজস্র স্মৃতিচারণ করলেন। দেখা হল, কিন্তু কথা বলার সুযোগ হল না। সে-ই দেখাই শেষ দেখা।যারা আমাদের প্রজন্মের বা আরও একটু আগের বা পরের তাদের অনেকেরই সৌভাগ্য হয়েছে কানাইবাবুদের মতন মাস্টারমশাইদের কাছে পাঠ নেওয়ার এবং সান্নিধ্যে আসার। কানাইবাবু স্যার সেই সকল মাস্টারমশাইদেরই একজন আদর্শস্থানীয় প্রতিনিধি। আমাদের সৌভাগ্য হয়েছে সেই বনস্পতির ছায়ায় নিজেদের শৈশব ও কৈশোরের ডালি ফুলে ফুলে ভ'রে নেওয়ার। যার যতটুকু মালা গাঁথা, তা ওই আশীর্বাদধন্য সঞ্চয়কে সম্বল করেই।

আরও পড়ুন: ছাত্র বলছে, ‘শিক্ষকের কলার ধরতে পারি’, কে এই যাদবপুরের ছাত্রনেতা সঞ্জীব?

স্যারের অকৃপণ স্নেহ পেয়েছি সর্বত্র। শুনেছি, দিনলিপির পৃষ্ঠায় কিছুটা অংশ লিখেছিলেন এই অধমকে নিয়ে। এ আমার এক অপূর্ব প্রাপ্তি। বেশ কিছু চিঠিও লিখেছিলেন আমাকে। ৩০ এপ্রিল, ২০০৭ এ লেখা একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, 'চাকরি পাওয়া এবং সাহিত্যচর্চার খবর পেয়ে খুব ভালো লাগল। সম্ভব হলে অন্যান্য খবর অবশ্যই জানাবে। তোমার দাদু ইন্দুবাবু দেখা হলেই বলতেন - জয়ন্ত আপনার কথা শুনবে। সাহিত্যচর্চা ত্যাগ করে চাকরির সন্ধান করতে বলুন। আমি হাসতাম - মনে মনে ভাবতাম, সাহিত্যচর্চার সঙ্গে চাকরির সন্ধানের কোনও বিরোধ নেই। শ্রীমান একদিন চাকরি সংগ্রহ করে নেবেই। আসলে স্নেহশীল মানুষ। পুরনো ধ্যানধারণা অনুসারে তাঁর মনে হত কবিতা লিখলে ছেলেরা হয়ত গোল্লায় যায়। কবিতা লেখাও যে একটি সৃজনশীল কর্ম - কেবলমাত্র বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের পক্ষে এ ধারণা পোষণ করা সম্ভব ছিল না। বেঁচে থাকলে আজ তিনি সকলের চেয়ে খুশি হতেন। '

প্রাক্তনী সংসদের অনুষ্ঠানে আর স্যারকে পাব না। বুকটা ভেঙে যায়। ওই আশ্রয়মুখ, ওই শ্রীচরণ - খুব 'মিস' করবো স্যার। এত স্নেহ, এত ভালোবাসা আর কে দেবেন? যখনই যা কিছু লিখেছি, আপনাকে দেখাতে চেয়েছি। যোগাযোগের অভাবে তা হয়ে ওঠেনি। আর হওয়ারও নয়। স্যার, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। পরম শান্তিতে থাকুন। স্যার, 'উদাসী হাওয়ার পথে পথে ঝরে পড়া মুকুলগুলিকে বুকে ধরে ফুল ফুটিয়েছেন আপনি। আপনার কথা মনে পড়লেই রবিঠাকুরের সেই কয়টি পঙক্তিই খুব করে বাজে,

'যখন যাব চলে
ওরা ফুটবে তোমার কোলে,
তোমার মালা গাঁথার আঙুলগুলি
মধুর বেদনভরে
যেন আমায় স্মরণ করে ...'

আচার্য, স্মৃতিপাত্র ছাপিয়ে আজ কেবলই আপনি এক অনতিক্রম্য বনস্পতির ছায়া।

More Articles