সম্প্রচারে তুমুল বেনিয়ম! ফুটবল বিশ্বকাপের শুরুতেই কেন আশাহত ভারতীয় দর্শকরা
World Cup 2022: শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের ভাবনাচিন্তাহীন সিদ্ধান্তের জন্যই গতকাল আশাহত হলেন কয়েক লক্ষ যুবক।
ক্রিকেটপাগল ভারতে এখন শুধুই ফুটবল উন্মাদনা। কারণ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আবারও শুরু হয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপ। আর এবারের আয়োজক দেশ কাতার। বহু দিক থেকে কাতার বিশ্বকাপ অন্যান্য বিশ্বকাপের থেকে আলাদা হলেও বিশ্বকাপ ফুটবলের সেই উন্মাদনা গ্রাস করেছে গোটা বিশ্বকে। আর তা থেকে বাদ যায়নি ভারত। প্রথম বিশ্বকাপ, যেখানে মারাদোনা নেই। ভারতকে এখন মাতিয়ে রেখেছেন রোনাল্ডো, মেসি এবং নেইমার জুনিয়ররা। যেন বিভাজিত হয়ে গিয়েছে দেশ। একদিকে রয়েছে ব্রাজিল, অন্যদিকে আর্জেন্টিনা। কিন্তু, ক্রিকেট-আসক্ত এই দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা কি এই দেশের যুবসমাজের ফুটবলের প্রতি আসক্তি ঠিকভাবে বুঝতে পারেন? হয়তো না, নতুবা ফুটবল বিশ্বকাপ টেলিকাস্টের সময় এতগুলো সমস্যা হয়তো হতো না।
গতকাল ফুটবল বিশ্বকাপের অভিষেক ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল আয়োজক দেশ কাতার এবং দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ তারকা ইকুয়েডর। এই দু'টি দলের ভক্ত হয়তো ভারতে নেই, কিন্তু যাঁরা ক্লাব ফুটবল দেখতে ভালবাসেন, এবং বিশেষ করে যাঁরা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভক্ত, তাঁদের জন্য ভ্যালেন্সিয়ার কয়েকটা ঝলকই যথেষ্ট। সেই ভ্যালেন্সিয়ার করা দুই গোলেই গতকাল জয় পেয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার দলটি। বিগত ৯২ বছরের ইতিহাস ভেঙে প্রথম ম্যাচে আয়োজক দেশকে হারিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করেছে ইকুয়েডর। কিন্তু, ভারতের মানুষ সে ম্যাচ দেখবেন, তার সাধ্য কই!
ভারতে এ-বছরের বিশ্বকাপের টেলিকাস্ট রাইট কিনেছে মুকেশ আম্বানির অধীনস্থ ভায়াকম 18 নেটওয়ার্ক। তার দরুন, ভারতে এই কোম্পানির চ্যানেলগুলিতে টেলিকাস্ট করা হবে ফুটবল বিশ্বকাপ। বর্তমানে টেলিভিশনের Sports 18 ও Sports 18 HD চ্যানেলে সম্পূর্ণভাবে লাইভ টেলিকাস্ট করা হচ্ছে ফুটবল বিশ্বকাপ। এছাড়াও ম্যাচ চলাকালীন সময় আপনারা MTV ও MTV HD-এর মতো চ্যানেলেও দেখতে পারেন ফুটবল বিশ্বকাপ। এমটিভি-তে হিন্দি ধারাভাষ্যের সঙ্গে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে, স্পোর্টস 18 চ্যানেলে আপনারা হিন্দি এবং ইংরেজি দুই ভাষার ধারাভাষ্য পেয়ে যাবেন।
আরও পড়ুন: হেলায় মৃত্যু বহু ভারতীয় শ্রমিকের! শুরুতেই যেভাবে কলঙ্কিত কাতার বিশ্বকাপ
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। যাঁদের বাড়িতে টিভি নেই, তাঁরা কী করবেন! যাঁরা বাড়িতে শুধুমাত্র অ্যানড্রয়েড টিভি চালিয়ে থাকেন, কিংবা যাঁরা ওটিটি সাবস্ক্রিপশন ব্যবহার করে থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপ দেখাটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। কারণ, এ-বছরের ফুটবল বিশ্বকাপের ডিজিটাল রাইট রয়েছে মুকেশ আম্বানির সংস্থা রিলায়েন্স জিও-র কাছে। আর সেই জিও নেটওয়ার্কের জিও সিনেমাতে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন ফুটবল বিশ্বকাপ। তবে দেখতে পাচ্ছেন, কথাটা বলা হয়তো ভুল হবে। কারণ গতকালের ম্যাচের সময় জিও সিনেমা-তে যা বিপর্যয় নেমে এসেছিল, তা বলে বোঝানোর নয়।
টুইটার ভরে গিয়েছে মিম এবং ট্রোল ভিডিওতে। বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হতেই জিও সিনেমা নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। জিও সিনেমার পারফরম্যান্স নিয়ে একেবারেই খুশি নন ভারতের ফুটবলপ্রেমীরা। প্রথম ম্যাচেই বারবার লাইভ স্ট্রিমিং আটকে যাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন ভারতীয় ভক্তরা। রবিবার দুর্দান্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর শুরু হয়েছিল ম্যাচ। তখন থেকেই শুরু হয় সমস্যা। বিশ্বকাপের সময় ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই বারবার সম্প্রচারের বিঘ্ন ঘটতে শুরু করে। বিষয়টা হয়ে ওঠে চূড়ান্ত বিরক্তিকর। এরকম হতে থাকলে কীভাবে বিশ্বকাপ দেখা সম্ভব? সেই প্রশ্ন ঘুরতে থাকে সকলের মাথায়। আর মোবাইল কিংবা ল্যাপটপে বসে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখার আর কোনও রাস্তা নেই। একমাত্র ভরসা এই জিও সিনেমা। ভুট অ্যাপেও দেখা যাবে না ফুটবল বিশ্বকাপ। তাই সমস্যা রয়েছে সর্বত্র।
কিন্তু যদি এটা আইপিএল হতো কিংবা পুরুষ ক্রিকেট দলের কোনও ম্যাচ হতো, তখন এই ব্যবসায়ীদের আগ্রহ হতো একেবারে আলাদা রকমের। অধিকাংশ মানুষ, যাঁরা বাড়িতে টেলিভিশনে খেলা দেখেন, তাঁদের বাড়িতে হয় স্টারের স্পোর্টস চ্যানেল রয়েছে, নতুবা রয়েছে সনি স্পোর্টস চ্যানেল। ভায়াকম 18 নেটওয়ার্কের এই স্পোর্টস চ্যানেলটি সকলের বাড়িতে থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে, MTV নামক চ্যানেলটিও খুব একটা বেশি মানুষের বাড়িতে দেখা যায় না। ডিজিটাল রাইট শুধুমাত্র রয়েছে জিও সিনেমা-র কাছে। কিন্তু আইপিএল হলে ব্যাপারটা হয়ে যায় পুরো আলাদা। তখন স্টার নেটওয়ার্কের অধিকাংশ চ্যানেলে টেলিকাস্ট করা হয় আইপিএল। স্টার গোল্ড থেকে শুরু করে জলসা মুভিজ প্রত্যেকটি চ্যানেলেই দেখা যায় ক্রিকেটের মহারণ। এমনকী, ডিজনি প্লাস হটস্টার ডাউনলোড করেও আপনারা দেখতে পারেন আইপিএল।
রিলায়েন্সের এই নেটওয়ার্কের কাছেও কিন্তু হিন্দি সিনেমার চ্যানেল ছিল। কালার্স সিনেপ্লেক্স থেকে শুরু করে রিশ্তে, সবই এই ভায়াকম 18 নেটওয়ার্কের অন্তর্গত। এমনকী, কালার্স বাংলারও একটি সিনেমার চ্যানেল রয়েছে। সেখানে খুব সহজেই ফুটবল বিশ্বকাপ টেলিকাস্ট করা যেত। Voot অ্যাপের মাধ্যমেও দেখানো যেত ফুটবল বিশ্বকাপ। কিন্তু সেসবের রাস্তায় হাঁটেনি রিলায়েন্স। নিলামের ডিলের সময়ও ভারতের উপর বাজি ধরতে রাজি হয়নি স্টার কিংবা সনি। ফলে সহজেই বাজি জিতে নিয়েছে রিলায়েন্স। যদিও এই প্রথম নয়। এর আগেও ভায়াকম 18 নেটওয়ার্কের এই সমস্যা হয়েছিল।
কিন্তু, ভারতে কি ফুটবলপ্রেমী এতটাই কম? বিষয়টা কখনওই সেরকম নয়। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা শহর থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্রের কোলহাঁপুর জেলা, ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনা সর্বত্র একই রকম। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ ভারত। ফুটবল খেলার ক্ষেত্রে ভারত অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও, ভক্তের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। ১৯৫০ সালে তারা বিশ্বকাপের জন্য কোয়ালিফাই করলেও তারা কখনওই বিশ্বকাপ পর্যন্ত যেতে পারেনি। কারণ ভারতের ফুটবল খেলোয়াড়রা সাধারণত খালি পায় খেলতেন সেই সময়। আর বিশ্বকাপ খেলতে হলে তাদেরকে বুট পরতে হবে। বলে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ প্রত্যাখ্যান করে ভারত।
কিন্তু প্রতিবারই যখন বিশ্বকাপ ফুটবল হয়েছে, তখনই ভারতের ফুটবলপাগল ভক্তরা এই খেলার প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করেছেন এবং তাঁদের প্রিয় দলকে সমর্থন করেছেন। রাত জেগে টিভি এবং মোবাইলের সামনে বসে থেকেছেন দর্শকরা। মাসের পর মাস কিছু কিছু অর্থ জমা করে প্রিয় দলের জার্সি কিনেছেন। পূর্বাভাস দিয়েছেন, কে চ্যাম্পিয়ন হবেন। তাঁদের দলের বিজয় মিছিল বের করেছেন। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি তাঁরা কেরলের কোঝিকোরে একটি নদীর মাঝে আর্জেন্টিনা সুপারস্টার লিওনেল মেসির ৩০ ফুট লম্বা একটি কাটআউট ছবি দাঁড় করিয়েছেন। আবার কোন ভক্ত টাঙিয়েছেন, ব্রাজিলের সুপারস্টার নেইমার জুনিয়রের ছবি। আর কেউ একজন পর্তুগালের সুপারস্টার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো-র ছবি টাঙিয়েছেন। এমনকী, এই দৃশ্য নিয়ে টুইট করেছে স্বয়ং ফিফা।
কেরলের মানুষের জন্য কাতার দ্বিতীয় বাড়ি। সেখানে হাজার হাজার নাগরিক কাজের সূত্রে গিয়ে থাকেন। কেউ সেখানে ব্যবসা করেন আবার, কেউ যেসব ফার্ম বিশ্বকাপের স্টেডিয়াম নির্মাণ করেছে তাদের হয়ে কাজ করেন। এরকমই একজন ভারতীয় শাহির আলি-র কথায় উঠে গেল ভারতের ফুটবলপ্রীতির কিছু নিদর্শন। ফ্লাইটের জন্য যখন তল্পিতল্পা গুটোচ্ছিলেন, তিনি তখন তিনি মিডিয়াকে বলেছিলেন, প্রিয় খেলোয়াড়কে ফুটবল মাঠে খেলতে দেখব, তাদের জীবনের সর্বোচ্চ দিয়ে খেলবেন- সেই দৃশ্য, সেই স্বপ্ন সত্যি করতেই কাতারের উদ্দেশ্যে যাওয়া। সফরের সঙ্গে নিয়েছেন কিছু শুকনো খাবার আর প্রিয় তারকাদের জন্য বহন করছেন ছোট আকারের পালতোলা নৌকা, যাকে কেরলে বলা হয় 'উরু'।
বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজকদের জন্য একটি উপহারও নিয়েছেন তিনি। ফুলসমেত একটি বোট সেটি। আর এই পুরো আর্টওয়ার্ক করেছেন মেঘনা উনিকৃষ্ণনান। লিওনেল মেসির এককাট্টা ভক্ত হলেও, ফুটবল খেলা যেন শাহিরের রক্তে। এরকমই বহু শাহির হয়তো গতকাল অপেক্ষা করেছিল টিভি কিংবা মোবাইল স্ক্রিনের সামনে। পরনে ছিল তাদের প্রিয় তারকার জার্সি, আর মনে ছিল নিজেদের প্রিয় তারকাকে নিজের দেশের হয়ে দৌড়োতে দেখার স্বপ্ন।
কিন্তু, শুধুমাত্র ব্যবসায়ীদের ভাবনাচিন্তাহীন সিদ্ধান্তের জন্যই গতকাল আশাহত হলেন কয়েক লক্ষ যুবক। এঁদের মধ্যে কেউ হয়তো ছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-এর ভক্ত। কিন্তু তাদের প্রিয় ভ্যালেন্সিয়া যখন গোল করছেন, তখন তাঁদের জিও সিনেমা দেখাচ্ছে বাফারিং! জিও টিভিও কাজ করছে না কোনভাবেই। হয়তো, ক্রিকেটপ্রেমী মুকেশ আম্বানি নিজেও ভাবতে পারেননি এত মানুষ একসঙ্গে ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে আসবেন। তাই হয়তো সার্ভারের জন্য খরচটা কমই করেছিলেন। নিজেদের টেলিকাস্টের সমস্যার জন্য ক্ষমা চাইলেও, সেই মুহূর্তগুলো তো আর ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই, অভিষেক ম্যাচের দুঃখ ভুলে অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী ম্যাচের জন্য। যাতে ক্রিকেটনির্ভর ভারতে শুভবুদ্ধির উদয় হয়।