নোটবন্দির মতোই ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিলের প্রচার! অপরাধমুক্ত রাজনীতিই লক্ষ্য?
Bill to remove Prime Minister and Chief Minister: অনেকে বলছেন এই ধরনের সংবিধান সংশোধনীর জন্য লোকসভা এবং রাজ্যসভা মিলিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাঁর প্রয়োজন, যা এই মুহূর্তে বিজেপি এবং এনডিএ’র নেই।
দেশের প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় এসে বাংলার আগামী বিধানসভা ভোটের জন্য সুর বেঁধে দিলেন। স্পষ্ট বললেন, ‘জেলে থেকে মন্ত্রিত্ব মানব না’। গ্রেফতার হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে জামিন না হলে, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য যে কোনো মন্ত্রীদের তাঁদের পদ থেকে সরানোর লক্ষ্যে যে ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল সাম্প্রতিক বাদল অধিবেশনে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পেশ করেছেন, কার্যত তাকেই সমর্থন করলেন তিনি। এই বিষয়ে প্রথমবার মুখ খুলে বুঝিয়ে দিলেন বিরোধীরাই এই নতুন বিলের প্রধান লক্ষ্য। পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য অবিজেপি রাজ্যের মন্ত্রীরা যাঁরা বিভিন্ন দুর্নীতি করে জামিন না পেয়ে আপাতত জেলে আছেন তাঁরাই যে এই নতুন বিলের লক্ষ্যবস্তু হতে চলেছেন, তা প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন। নির্দিষ্টভাবে অবিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিকে চাপে রাখার জন্যেই যে এই বিল আনা তাও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
যে সংবিধান বাবাসাহেব আম্বেদকর রচনা করেছিলেন, সেই সংবিধানের ৭৫, ১৬৪ এবং ২৩৯ এএ (75, 164 & 239AA) ধারাগুলোর সংশোধনের প্রস্তাব নিয়েই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই বিল পেশ করেছেন। অনেকে বলছেন এই ধরনের সংবিধান সংশোধনীর জন্য লোকসভা এবং রাজ্যসভা মিলিয়ে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাঁর প্রয়োজন, যা এই মুহূর্তে বিজেপি এবং এনডিএ’র নেই। এখন প্রশ্ন হল, কেন তা সত্ত্বেও তাঁরা এই বিল পেশ করলেন? আসলে সংসদে এমন অনেক বিল পেশ করা হয়, যা পাশ করানোর থেকেও অনেক বেশি তা নিয়ে রাজনীতি করার প্রয়োজন হয়। ঠিক সেই কাজটি এখন প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করবেন, তার আভাসও প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। এই বিল যে পাশ করা হবে না, তাও খুব জোর দিয়ে বলা যায় না। আপাতত এই বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়েছে আলোচনার জন্য। এই ১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিলটি সম্পর্কে জানা বোঝা থাকাটা খুব জরুরি।
এই বিলে বলা হয়েছে, যদি কোনও মন্ত্রী, বা মুখ্যমন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রীও অপরাধ করেন তাহলে তাঁর পাঁচ বা তার বেশিদিন কারাবাসে থাকার কথা, কিন্তু যদি টানা ৩০ দিন জেলে থাকেন এবং জামিন না পান, তাহলে তাঁর সেই পদ চলে যেতে পারে এবং তাঁকে ইস্তফা দিতে হতে পারে। শুনতে এই বিলটি যথেষ্ট ভালো। মনে হতেই পারে এটাই তো হওয়ার কথা। কেন একজন অপরাধী জেলে বসে মন্ত্রিত্ব চালাবেন, ঠিকই তো। এটাই তো সাংবিধানিক নৈতিকতা। একজন সরকারি কর্মচারী কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টা জেলে থাকলে তাঁর চাকরি চলে যায়, তেমনই নেতাদের ক্ষেত্রেও একই হওয়ার কথা। কেন একজন মন্ত্রী এই রক্ষাকবচ পাবেন? তাঁর কেন মন্ত্রিত্ব যাবে না?
প্রধানমন্ত্রীও একই যুক্তি দিয়েছেন তাঁর বক্তব্যে। কারণ, এই কথাই মানুষ শুনতে ভালবাসেন এবং বিশ্বাস করেন। সেই জন্যেই প্রধানমন্ত্রীও তাঁদের মতো করে কথা বলেন, যাতে মানুষ তাঁর কথায় বিশ্বাস করেন এবং তা নিয়ে কথা বলে। এতে উদ্দেশ্য সহজেই সফলতা পায়। ঠিক যেভাবে নোটবন্দির সময়ে বলা হয়েছিল, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সমস্ত কালো টাকা উদ্ধার হয়ে যাবে। তারপর আধারের সঙ্গে সমস্ত নথির সংযোগ করানোর সময়ে বলা হয়েছিল, সমস্ত অনৈতিক লেনদেন এবং সন্ত্রাসবাদ এবার ধ্বংস হবে। নাগরিকত্ব আইন পাশ করিয়ে বলা হয়েছিল, এইবার মুসলমানদের শায়েস্তা করা হবে, আসামে নাগরিক পঞ্জীকরণ করে বলা হয়েছিল, এবার দেশ থেকে এভাবেই মুসলমানদের সরানো হবে- ঠিক তেমন ভাবেই বললেন এবারের সংবিধান সংশোধনী আনার ক্ষেত্রে। কিন্তু মনে রাখতে হবে বর্তমান কেন্দ্র সরকার এখনও যে ক’টি প্রক্রিয়া এনেছে তার কোনোটিতেই কিন্তু শুধু দুর্নীতিগ্রস্তরা বা শুধু সংখ্যালঘুরা অসুবিধায় পড়েছেন এমনটা নয়, অশান্তি ভোগ করতেহয়েছে সাধারণ মানুষকে।
আরও পড়ুন- অনৈতিক মন্ত্রীদের সরাতে বিল! বিজেপির এই নেতারা নৈতিকতার পথে হেঁটেছেন?
আসামের নাগরিকপঞ্জীকরণে যেমন হিন্দুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ( ১৩ লক্ষ হিন্দুদের নাম বাদ গেছে), তেমনই নোটবন্দীতেও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকেই এটিএমে দাঁড়াতে হয়েছে বেশি। আজকে যে বিহারে কিংবা পরবর্তীতে সারা দেশে নির্বাচন কমিশন বিশেষ ভোটার তালিকা সংশোধন করার কথা বলচ্ছে, তাতে কিন্তু মূলত হিন্দুদেরই নাম বাদ যাচ্ছে।
স্বচ্ছ রাজনীতি এবং নৈতিকতা
একজন সাধারণ নাগরিকের কাছে বিজেপির আনা এই নতুন সংশোধনী সত্যিই আকর্ষণীয় মনে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা কি তাই বলে? আজকের সময়ে ভারতবর্ষের মতো দেশে পুলিশ, ইডি, সিবিআই কিংবা যে কোনো তদন্তকারী সংস্থা কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত? এই তদন্তকারী সংস্থাগুলির নিরপেক্ষতা নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতও নানা প্রশ্ন তুলেছে এবং তাদের যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত করা হয়, তা এখন দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার। এই নতুন সংবিধান সংশোধনী তাই শুনতে যতই লোভনীয় মনে হোক না কেন আসল অপরাধীরা কিন্তু কোনোদিনই শাস্তি পাবে না। তাঁদের কিন্তু কোনোদিনই মন্ত্রিত্ব যাবে না, তাঁরা কিন্তু খুব সহজেই দল বদল করে বিজেপিতে যোগ দেবেন। তাঁদের কোনোদিনই এই আইন শাস্তি দিতে পারবে না। নতুন সংশোধনীতে শুধু আরও কিছু উদ্দেশ্য প্রণোদিত গ্রেফতারি বাড়বে আর কিছুই হবে না। যদি গ্রেফতারি এড়ানোর জন্য কেউ অজিত পাওয়ার, শুভেন্দু অধিকারী, নারায়ণ রানে বা হেমন্ত বিশ্বশর্মা হয়ে যান, তাহলে তো কথাই নেই। তাঁরাই বিজেপির নেতা হয়ে উঠবেন বিভিন্ন রাজ্যে এবং মানুষ সহজেই পুরনো দুর্নীতি বা অন্য কোনো অভিযোগের কথা ভুলে গিয়ে তাঁদেরকেই মাথায় তুলে নাচবেন, তার উদাহরণ দিতে গেলে বেশী কষ্ট করতে হবে না। তাই নৈতিকতা নিয়ে বিজেপি কিংবা প্রধানমন্ত্রী যত কম বলেন তত ভালো।
কেন ৩০ দিনের কারাবাসের কথা বলা হয়েছে?
যে কোনও অবিজেপি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাই হয়তো সেই দলের চালিকাশক্তি। সেই জন্যেই যদি অবিজেপি শাসিত রাজ্যের কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে শুধুমাত্র অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হয়, তাহলে সেই রাজ্যের শাসকদল যে সাংঠনিক অসুবিধাতে পড়বে এটা যে কোনো শিশুও বোঝে। তাই নির্বাচনের কয়েকমাস আগে যদি সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ৩০ দিন জেলে আটকে রাখা যায়, তাহলে সেই রাজ্যে এই নতুন সংশোধনী যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণেই ব্যবহিত হবে তা এখনই বলে দেওয়া যায়। এই সংশোধনীর পিছনে তাই কতটা আন্তরিকতা আছে আর কতটা রাজনীতি আছে তা না বললেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
পুলিশ, বিচারপতি এবং আইনজীবীদের ভূমিকা
এমনিতেই আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে, আইনজীবীরা এবং অবশ্যই
পুলিস প্রশাসনের মধ্যে একটা রাজনীতি আছে। তাঁরা প্রায় খোলাখুলিই কেন্দ্রের শাসকদলের
সমর্থন করছেন, তার অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। আর এই রকম একটি আইন আনা হলে তো এই সমস্ত সংস্থাগুলির পক্ষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করা আরও সহজ হবে। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে কোনো সিবিআই, ইডি বা অন্য কোনো সংস্থার পুলিস আধিকারিক যদি কোনো একটি অবিজেপি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করেন, আইনজীবিরা যদি জামিনের আবেদন করেন এবং সেই আবেদন যদি তদন্তের খাতিরে বিচারক নাকচ করে দেন তাহলে সেই মুখ্যমন্ত্রীকে ৩০ দিন জেল খাটানো এমন কিছু কঠিন বিষয় নয়। যদি খেয়াল করা যায় ঠিক এইভাবেই ঝাড়খন্ড কিংবা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু পরে প্রমাণের অভাবে চার্জশিট না দেওয়ায় জামিন হয় তাঁদের। এখন নতুন আইনে এই ৩০ দিন গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো রকমভাবে ৩০ দিন কাটিয়ে দেওয়া গেলেই সেই মন্ত্রী বা নির্দিষ্ট মুখ্যমন্ত্রীকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হবে। সেই জন্যেই এই আইনটিকে বিরোধীরা 'দানবীয়' বলছেন।
আরও পড়ুন- বিহারের ‘বিশেষ নিবিড় সংশোধনী’! কাদের বাদ দিতে এই প্রক্রিয়া?
সহযোগী দলের জন্যেও এই আইন বিপজ্জনক
যদি সরকার আন্দাজ করে যে তার কোনো একটি সহযোগী দল একটু বেসুরো গাইছে, তাহলে তাদের ঠান্ডা করার জন্যেও এই আইন যে লাগু হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সুতরাং যে সহযোগী দলেরা আজ ভাবছেন যে তাঁরা খুব বিপদমুক্ত থাকবেন, তাঁরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। বিজেপির রাজনৈতিক ইতিহাস বলে যারাই তাদের জোটসঙ্গী হয়, তাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে তারা। এমনকি যাঁরা নরমভাবেও তাদের রাজনীতিকে কোনো না কোনো দিন সমর্থন করেন তাঁদের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হয়। তামিলনাডুর এআইএডিম-কে দলটির অস্তিত্ব প্রায় মুছে ফেলা হয়েছে। অরবিন্দ কেজরিওয়াল নানান বিষয়ে বিজেপিকে সমর্থন করা সত্ত্বেও তাঁকে জেলে ঢোকাতে দ্বিধা করেনি বিজেপি। উড়িষ্যার নবীন পট্টনায়ক এবং তাঁর বিজু জনতা দল বিভিন্ন সময়ে বিজেপিকে সমর্থন করেছে। তাঁদেরকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিন্দুমাত্র ভাবেনি বিজেপি। আসলে বিজেপি চায় নিরঙ্কুশ আধিপত্য। নীতিশকুমারের কাঁধে বন্দুক রেখে যদি বিহারে বিজেপি জিতেও যায়, তবুও তাঁকে ছুঁড়ে ফেলতে দু’বার ভাববে না তারা। মহারাষ্টের একনাথ শিন্ডেকে তাঁরা ততদিনই মুখ্যমন্ত্রী রেখেছে, যতদিন তাঁদের প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন মিটে যেতেই তখন তাঁকে সরাতে একবারও দ্বিধা করেনি বিজেপি।
উপসংহারের পরিবর্তে
দেশের সংবিধান তৈরি হয়েছিল, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। সেই সংবিধানের যা যা সংশোধনী এতদিন করা হয়েছে, তাও হয়েছে গণতন্ত্রের স্বার্থেই। যদি এই নতুন সংশোধনী গায়ের জোরে বা অর্ডিন্যান্স জারি করে পাশ হয়ে আইন হয়ে যায়, তাহলে বিচারবিভাগে আরও রাজনীতিকরণ করা হবে তা বোঝাই যাচ্ছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নির্বাচকেরা। তাঁদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই এই আইন দিয়ে তাঁদের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে যদি গ্রেফতার করে ৩০ দিন জেলবন্দি করে পদত্যাগ করানো হয়, তাহলে তা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।
আমরা তো কথায় কথায় পাকিস্তানের বিরোধিতা করি। সেই পাকিস্তানের থেকে একটা বিষয় তো আমরা শিখতে পারি, যদি কোনো নেতা বা মন্ত্রী অপরাধ করেও গদি আঁকড়ে বসে তখন যত না ক্ষতি হয়, তার থেকে অনেক বেশি গণতন্ত্র ধ্বংস হয়। পাকিস্তানের ইমরান খানের উদাহরণ বোধহয় আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। গণতন্ত্রে আসল শাসক হওয়ার কথা তো মানুষের, একমাত্র তিনিই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কে থাকবেন আর কে থাকবেন না।
বিহারে বিশেষ নির্বাচনী সংশোধনের বিরুদ্ধে যেমন সমস্ত বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমেছেন। এই আইনের ক্ষেত্রেও বিরোধিতা করতে হবে। কারণ, শেষ বিচারে রাস্তার লড়াই গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করতে পারে। প্রশ্ন করতে হবে অপরাধমুক্ত রাজনীতিই লক্ষ্য না অন্য কিছু?

Whatsapp
