মেঘলা দিনের রথের মেলা আজও রঙিন মাটির পুতুলে

Clay Doll : বলাই চিত্রকরের তৈরি পুতুলের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো ঘাড়-নাড়া বুড়ো পুতুল। দুই খোল ছাঁচের এই পুতুলের শরীরের ভেতরটা ফাঁপা।

শান্ত অপরাহ্ন। উন্মুক্ত প্রান্তরে ঘেরা এক গ্রাম। বসেছে রথের মেলা। হালকা বৃষ্টি হচ্ছে সকাল থেকে। তখনও রথের রশিতে টান পড়েনি। শুধু সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বনেদি বাড়িগুলোর থেকে কিছুটা তফাতে থাকা মাটির বাড়ির বাসিন্দাদের মনেও সমান আনন্দ। কাদামাখা রাস্তার দুই ধারে জিলিপির প্যাঁচ তৈরি হচ্ছে। ব্যাবসায়ীরা প্লাস্টিকের চাদরের আচ্ছাদনের তলায় বসে নিজেদের পসরা সাজাচ্ছে। এরই মাঝে নিজের তৈরি ঘাড়নাড়া বুড়ো পুতুলের মধ্যে শেষ তুলির টান দিচ্ছেন ঈষৎ খর্বকায় এক শিল্পী। প্লাস্টিকের ভিড়ে সে একাই মাটির পুতুলের বিপুল সম্ভার নিয়ে বসে রয়েছে। প্লাস্টিকের চাদরে মোড়া তাঁর লোকজ শিল্পসম্ভার। বলাই চিত্রকরের কপালে চিন্তার ভাঁজ।

মধ্যপঞ্চাশের এই শিল্পী মাটির পুতুলের ঐতিহ্যকে বহন করে নিয়ে চলেছে বেলমুড়ির মাকালপুরের রথের মেলায়। সারা বছরে শুধুমাত্র রথের আগেই পুতুল তৈরি করেন তিনি। আর সেই পুতুল নিয়ে রথের মেলায় পসরা সাজিয়ে বসেন। তাঁর তৈরি কাঁচা মাটির রঙিন দুই খোল ছাঁচের পুতুলগুলির মধ্যে গ্রাম্য সারল্য রয়েছে। ফেলে আসা অতীতের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে তাঁর তৈরি মাটির পুতুল। মুদ্রাস্ফীতির এই বাজারে প্রান্তিক শিশুরা যাতে মনের আনন্দে মাটির পুতুল নিয়ে খেলতে পারেন সেই দিকে নজর রেখেই শিল্পী পুতুলের দাম বাড়াননি।

বলাই চিত্রকরের মাটির পুতুল

বলাই চিত্রকরের তৈরি পুতুলের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো ঘাড়-নাড়া বুড়ো পুতুল। দুই খোল ছাঁচের এই পুতুলের শরীরের ভেতরটা ফাঁপা। আলাদা করে তৈরি করা মাথাটা এই ফাঁপা অংশের মধ্যে সুতো দিয়ে বেঁধে জোড়া হয়েছে। ফলে মাথায় আলতো টোকা মারলেই পুতুলটির ঘাড় নেড়ে ওঠে। বয়সের ভারে নীল-সবুজ জোব্বা পরা ঘাড়-নাড়া বুড়ো পুতুল ন্যুব্জ হয়ে গিয়েছে। মাথা নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে রয়েছে তাঁর পুতুল। টানা চোখ, লাল ঠোঁট, কপালে লাল টিকা, মুখে অভয়সুলভ হাসির মিষ্টতা। সাদা দাড়ির মধ্যে প্রজ্ঞার ছোঁয়া। চোঙার মতো দেখতে লাল সবুজ রঙের কাগজের টুপি পরে ঘাড়-নাড়া বুড়ো পুতুল আজও গ্রাম্য জীবনের অংশ।

আরও পড়ুন-বাবার কাছে হাতেখড়ি! ৯০ বছর ধরে মাটির পুতুল গড়ছে কালো সূত্রধররা

দেশী ঘাড়-নাড়া বুড়ো পুতুলের আবার একটি সাহেব সংস্করণও রয়েছে। সেখানে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোট পরা পুতুলটি। শরীরী ভাষায় কর্তৃত্ব করার অভিব্যক্তি। অন্যদিকে, কাঁখে কলসি হাতে বালটি নিয়ে এগিয়ে চলা লাল-নীল রঙা শাড়ি পরিহিতা ঘোমটা দেওয়া দুই খোল ছাঁচের তৈরি বউ পুতুল, নারী জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রামের কথা বলে চলে। বহু সংগ্রাম শেষে গ্রাম্য নারীরা মুখের সরল অনাবিল হাসিটা ঠিক বজায় রাখতে পারে। এই ভাবটা তাঁর তৈরি পুতুলকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

ছাঁচের তৈরি বউপুতুল

প্রশ্ন আসে, পরবর্তী প্রজন্ম কি শিখছে? প্রতিবেদকের এই প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী আক্ষেপ করে জানান , তিনিই এই শিল্পের শেষ প্রতিনিধি। তাঁর ছেলেরা এই কাজ শেখেনি। তাঁরা কলকাতায় বড়ো কাঠামোর প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত। আগে তালচিনান থেকে দাদা গৌড় চিত্রকরের সঙ্গে এই মেলায় পুতুল নিয়ে আসতেন তিনি। এখন গৌড় চিত্রকর পুতুল তৈরি করা ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে মাকালপুরের মেলায় বাংলার লোকসংস্কৃতির ধারাকে একা হাতে আগলে রেখেছেন তিনি।

আরও পড়ুন-   এক বৃদ্ধের হাতে জীবিত নাড়াজোলের কাঠের পুতুল শিল্প

রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর ভোলগা থেকে গঙ্গা গ্রন্থে প্রাগৈতিহাসিক সমাজে ক্ষমতার কেন্দ্রে মাতৃত্বের জয়জয়কারকে দেখিয়েছিলেন। গোষ্ঠীবদ্ধ পরিবারে মা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে। এমনই চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। হুগলির শিয়াখালার রামপাড়া ৯৬ বছরের পুরনো রথের মেলায় মৃৎশিল্পী মিতালী চিত্রকরকে দেখে প্রতিবেদকের সেই কথাই মনে পড়ে গেল। পুতুল নিয়ে বসে রয়েছেন শিল্পী। আর তার পাশে রয়েছেন স্বামী, পুত্র, পুত্রবধূ ও নাতি-নাতনি। তাঁরাও ক্রেতাদের সামলাচ্ছেন। মিতালী চিত্রকরের বাড়ি বারুইপাড়ায়। গোয়ালিনী, খুঁকি, ময়ূর, পাখি এবং ঘাড়-নাড়া বুড়ো পুতুলের সম্ভার নিয়ে শিল্পী বসেছেন। তাঁর প্রতিটা পুতুলই দুই খোল ছাঁচের কাঁচা মাটির তৈরি। তার ঘাড়-নাড়া বুড়ো পুতুলকে শিল্পী জরির কাপড় পরিয়েছেন। মাথায় দিয়েছেন সোনালী রঙের মুকুট। টানা চোখ। কপালে বৈষ্ণবী তিলক। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও রাজকীয় ভাব অটুট রয়েছে। দুই খোল ছাঁচের ফাঁপা শরীরের সঙ্গে সুতো দিয়ে গলা পর্যন্ত মাথার দিকটা জোড়া হয়েছে। তাঁর তৈরি গোয়ালিনী পুতুলের মধ্যে উত্তর ভারতীয় শৈলীর ছাপ স্পষ্ট। শিশুদের ভিড় জমেছে তাঁর পসরার সামনে।

বেলমুড়ির মাকালপুরের রথের মেলায়

নিস্তরঙ্গ পরিবেশে ক্রমেই ভিড় বাড়তে থাকে। শহুরে ক্রমাগত ছুটে চলার উত্তেজনা এখানে নেই। মিতালী চিত্রকর-এর উল্টো দিকে চাকা লাগানো পোড়ামাটির নৌকো ও খেলনা বাটি নিয়ে বসেছেন ফ্যালাপাল। নিরুত্তাপ থেকে ধৈর্য সহকারে গ্রামীণ শৈশবের মুখোমুখি বসে রয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে নগর পরিক্রমা করে মেলার মধ্যে  কাঠের তৈরি পঞ্চরত্নের রথ প্রবেশ করল।

বাঙালির কাছে রথযাত্রা নিছক ধর্মীয় পরম্পরা নয় তা আদতে শিল্পচেতনার এক অনুপম নিদর্শন। তার স্বতঃস্ফূর্ততা আজও গ্রামীণ বাংলাকে মোহিত করে রেখেছে। এই মেলাখেলার সঙ্গে কলকাতা শহরের তেমন যোগ নেই। আর শহুরে সংস্কৃতি যেভাবে দ্রুত গ্রাস করছে গ্রাম বাংলার চিহ্নগুলিকে, এইসব বিশ্বায়নের চটকদারি বিজ্ঞাপনের ভিড়ে ফুরিয়ে যাবে। ফলে ভয় এইসব লোকজ শিল্প আর প্রান্তিক শিল্পীদের নিয়েও, প্রচারের আলো থেকে আজও যাঁরা দূরে, নিরালায়।

কৃতজ্ঞতা: আকাশ বিশ্বাস 

More Articles