আমি বস্তুত এক দাঁড়কাক : কাফকা ও গুস্তভের অসম বন্ধুত্বের দিনগুলি

Franz Kafka: ১৯২৪ সালের মে মাসে জানুসের বাবার মৃত্যু হয়। তার ঠিক একুশ দিন বাদে ফ্রানৎস কাফকা ভিয়েনার অদূরবর্তী এক অতি সাধারণ যক্ষ্মা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

"সব রূপকথাই আসলে রক্তস্নাত"— বললেন ফ্রানৎস কাফকা। শ্রোতার নাম গুস্তভ জানুস। গুস্তভ এক উজ্জ্বল কিশোর — দু'চোখে অনেক স্বপ্ন ও জিজ্ঞাসা। বাড়িতে মধ্যরাতের পরেও তার ঘরে আলো জ্বলে। সে কিছু পড়ে বা লেখে। একদিন তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর অনুসন্ধিৎসু বাবা ঘরে ঢুকে দেখতে পেলেন স্বরচিত কবিতার খাতা। ছেলেকে না জানিয়েই কবিতার নোটবই নিয়ে গিয়ে দেখালেন অফিসের সমঝদার সহকর্মীকে। জানতে চাইলেন, ওগুলো আদৌ কিছু হয়েছে কিনা। সহকর্মীর নাম ফ্রানৎস কাফকা। তিনি বললেন, সেই কিশোরকে একদিন অফিসে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দিতে। দু-এক দিন বাদেই ওয়ার্কমেন্স অ্যাক্সিডেন্ট ইনসিওরেন্স ইনস্টিটিউশন অফিসের দোতলায় দেখা গেল, সতেরো বছরের স্বপ্নালু গুস্তভ জানুস মুখোমুখি বসে আছে 'মেটামরফসিস'-এর লেখকের সামনে। মাঝখানে টেবিলে রাখা গুস্তভের নিদ্রাহারা রাতের ফাইলবন্দি যাপনলিপি।

রোগাটে দীর্ঘদেহী কাফকা। ঘন কালো ভ্রুর নীচে নীল-ধূসর দু'চোখ, ঠোঁটে মৃদু হাসি, লম্বা চুল ব্যাকব্রাশ করা। কথা বলার সময় মুখের সমস্ত মাংসপেশি ও দু'চোখের তারা সচেতনভাবে ব্যবহৃত হয় — গুস্তভ লক্ষ্য করে। কিশোরটিকে একটু অপ্রস্তুত দেখে কাফকার সহজাত প্রশ্রয়ের স্বর— "না না, তুমি শুধু একা নও। আমাদের বাড়িতেও মোটা অঙ্কের ইলেকট্রিসিটি বিল আসে।" এই একটি উচ্চারণেই কেটে গেল দ্বিধা জড়তা।

বাবা তাঁর কাজের টেবিলে চলে গেলে, কাফকা উৎসুক গুস্তভকে বলেন,

- তোমার কবিতায় অনেক কোলাহল। যা অবশ্যই তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, আর সে কারণেই সুন্দর। যদিও, তার সঙ্গে শিল্পের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং এই অল্প বয়সজনিত কোলাহল প্রকৃত গভীর উচ্চারণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু, আমি কোনও শিল্প সমালোচক নই। আমি খুব দ্রুত নিজেকে অন্য রোলে রূপান্তরিত করে আবার নিজের মধ্যে ত্বরিতে ফিরে এসে এই দুই অবস্থানের মধ্যে দূরত্ব মাপতে পারি না। ওই যে বলেছি, আমি কোনও শিল্প নিয়ামক নই। আমি এক সাধারণ মানুষ — একই সঙ্গে বিচারাধীন ও দর্শক।

- এবং বিচারকও?

- (কাফকার অপ্রস্তুত হাসি) না, বিচারাধীন দর্শক তথা বিচারালয়ের এক অতি সাধারণ দ্বাররক্ষী। বিচারক কে তা আমি জানি না। মনে হয়, আমি এক বিনীত সহকারী দ্বার-রক্ষক। আসলে, আমার কোনও নির্দিষ্ট পদ নেই।

কাফকা হাসতে থাকেন। সেই হাসিতে গুস্তভও না বুঝে যোগ দেয়। প্রথম দিনের বোঝা-না-বোঝার এই পরিচয় পর্বের সমাপ্তি হয় যখন গুস্তভের বাবা কাফকার অফিস ঘরে প্রবেশ করেন। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।

আরও পড়ুন- শেষ পর্যন্ত বাঁচার গল্প বলে রুশদির ‘নাইফ’

একই অফিসে সহকর্মী হওয়ার সুবাদে কাফকা ও জানুসের বাবার মধ্যে পারস্পরিক প্রশ্রয় ও ভালোলাগার সম্পর্ক। বাবার সূত্রে গুস্তভ জানতে পারে, কাফকা আগে এক ছুতার মিস্ত্রির কারখানায় কাজ করে সারাদিন কাটিয়ে দিতেন। দ্বিতীয় দিনের সাক্ষাতে সেই প্রসঙ্গ তুলে জানুস জানতে চায়—

- আপনি কি এখনও কারোলিনেনথালের কারখানায় যান?

- ও, তুমি জানো দেখছি।

- হ্যাঁ, বাবার মুখে শোনা।

- না, শরীরের কারণে এখন আর গিয়ে উঠতে পারি না। রাজাধিরাজ শরীর!

- বুঝতে পারি। ধুলোয় ঢাকা কারখানার মধ্যে কাজ করাটা কখনই আরামের হতে পারে না।

- সেটা ঠিক নয়। আমি তো কারখানাতেই কাজ করাটা বেশি পছন্দ করি। কাঠ গুঁড়োর গন্ধ, চালু করাতের গুঞ্জন, হাতুড়ির ঠং ঠং — এ সবকিছু আমাকে প্রাণিত করে। দুপুর এত দ্রুত গড়িয়ে সহসা সন্ধে আসে — আমি অবাক না হয়ে পারি না।

- আপনি নিশ্চয়ই দিনান্তে খুব ক্লান্ত বোধ করতেন।

- হ্যাঁ, ক্লান্ত — কিন্তু খুশি। খুব সহজ বাস্তব ও সরাসরি জীবন যাপনের উপযোগী কোনও কাজের থেকে সুন্দর আর কিছু হতে পারে না। অতীতে আমি চাষের এবং বাগান পরিচর্যার কাজ করেও অনেক আনন্দ পেয়েছি। অফিসে বসে ফোর্সড লেবারের এই কাজের থেকে সেসব ছিল অনেক ভালো। সম্পূর্ণ বৌদ্ধিক কাজ মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। আর কায়িক শ্রম তাকে করে মানবমুখী। খুবই অনুশোচনার যে আমি আর কারখানায় বা বাগানে কাজ করতে পারি না।

- তাই বলে আপনি নিশ্চয়ই আপনার এই আধিকারিকের পদ ছেড়ে দিতে চাইবেন না?

- কেন নয়! আমি তো এক ক্ষেত মজুর বা মিস্ত্রি হয়ে প্যালেস্টাইন চলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি।

- পারবেন আপনি সব কিছু পেছনে ফেলে চলে যেতে?

- পারব, যদি দেখি তা করে আমি এক অর্থপূর্ণ স্থায়ী ও সুন্দর জীবনকে ছুঁতে পারছি। তুমি কি লেখক পল অ্যাডলারকে জানো?

- আমি কেবল তাঁর লেখা The Magic Flute-এর কথা জানি।

- পল তাঁর স্ত্রী ও বাচ্চাদের সঙ্গে এখন এই প্রাগে।

- পলের পেশা কী?

- কিছুই না। পলের কোনও পেশা নেই, শুধু নেশা আছে। পল পরিবারকে নিয়ে এক বন্ধুর আশ্রয় থেকে অন্য বন্ধুর আশ্রয়ে বেশ ঘুরে বেড়ায়। পল মুক্ত মানুষ এবং কবি। ওর সঙ্গে থাকলে আমার খুব মানসিক দংশন হয় এই ভেবে যে, আমি জীবনটা অফিসে দাসত্ব করে অপচয় করে দিলাম।

কাফকা

এরপর ১৯২১সালের মে মাসে লুডউইগ উইন্ডারের বোহেমিয়া কাগজের রবিবাসরীয়তে জানুসের একটি সনেট ছাপা হয়।

পরবর্তী সাক্ষাতে কাফকা বলছেন—

- তোমার বর্ণনায় কবি এক সুমহান চমকপ্রদ মানুষ, যাঁর পা আছে মাটিতে, আর মাথা হারিয়ে গেছে মেঘের মধ্যে। এই হলো নিম্ন মধ্যবিত্তের বৌদ্ধিক ঘরানায় অঙ্কিত কবির এক সম্পূর্ণ আটপৌরে ছবি। এই ছবি দাঁড়িয়ে আছে ইচ্ছাপূরণের বিভ্রান্তির উপর, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনও সম্পর্ক নেই। আসলে, কবি সামাজিক মধ্যমানের মানুষের থেকে অনেক দুর্বল ও হীন। আর তাই সে অপরাপর মানুষের থেকে অস্তিত্বের ভার অনেক গভীর ও তীব্রভাবে উপলব্ধি করতে পারে। তার কাছে, তার গান এক ব্যক্তিগত আর্তনাদ। শিল্পীর কাছে শিল্প কেবল তার বেদনার রূপকল্প, যার ভেতর দিয়ে সে নিজেকে আরও গভীরতর বেদনায় উন্মোচিত করে। কবি কোনও বড়সড় মানুষ নয়। কবি আসলে উজ্জ্বল পালকে সুসজ্জিত অস্তিত্বের খাঁচায় বন্দি এক পাখি।

- আপনিও কি তাই-ই?

- আমি এক অসম্ভব পাখি। আমি বস্তুত এক দাঁড়কাক। টেইন ক্যাথেড্রালের পাশের কয়লার দোকানির যেমন একটা আছে। তুমি দেখেছ?

- হ্যাঁ, দেখেছি। দোকানকে কেন্দ্র করে কাকটা উড়ে বেড়ায়।

জানুসের এক স্কুলের বন্ধু একদিন তাঁর হাতে একটা ইংরেজি উপন্যাস 'Lady into Fox' তুলে দিয়ে বলল, "দ্যাখো, তোমার প্রিয় কাফকা পৃথিবী বিখ্যাত হতে চলেছে। এই লেখক, ডেভিড গার্নেট, মেটামরফসিস থেকে নকল করেছেন।"

উত্তেজিত জানুস প্রমাণসহ চলে গেল সোজা কাফকার বাড়ি। কাফকা তখন খুবই অসুস্থ। বিছানার পাশের চেয়ারে বসা গুস্তভের কাছে ব্যাপারটা শুনে শায়িত কাফকা খুব ক্লান্ত হেসে বললেন, "না, গার্নেট আমার থেকে নেয়নি। উৎসটা আসলে আমাদের এই সময়। আমি ও গার্নেট - আমরা দু'জনেই বস্তুত ওখান থেকেই কপি মেরেছি। মানুষ আজ মানুষের যতটা কাছে, তার থেকে বেশি কাছে বাকি প্রাণী জগতের। ওদের মধ্যেই দেখতে পাই আমাদের অন্তর্গত জেলখানার গরাদ। তাই পশু-পাখি-পতঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সহজতর মনে হয় মানুষের।

এর ক'দিন বাদে মোটামুটি সুস্থ কাফকার সঙ্গে অফিস ফেরত হাঁটতে হাঁটতে ওই প্রসঙ্গ ফিরে আসে।

- আসলে, প্রতিটি মানুষ নিজেকে এক স্বসৃষ্ট জেলখানার মধ্যে আবদ্ধ করে বসে আছে। এই অন্তর্গত জেলের সেলটিকে সে নিজের মধ্যে অনবরত বয়ে নিয়ে  চলেছে। সেই জন্যই, মানুষ আজকাল পশু পাখি নিয়ে বেশি লিখছে। এটা মানুষের এক অন্তর্বাসনা — প্রকৃতির কোলে মুক্ত অকৃত্রিম জীবনের। কিন্তু, মুক্তির সঙ্গে অবধারিতভাবে চলে আসে দায়িত্ব। মানুষ এই যুগপৎ মুক্তি ও দায়িত্ব থেকে ভয়ে পালাতে চায়। আর তাই তখন নিজের তৈরি করা কারাগারে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে।

এরও ক'দিন পর — কাফকা তখনও পুরোপুরি সুস্থ নয় — কথামতো দু'জনের দেখা হলো কাফকার বাবার ব্যবসা সম্পর্কিত পণ্যাগারের দরজায়। হাঁটতে হাঁটতে তারা এসে পড়ল একটা বইয়ের দোকানের সামনে। ওমনি শুরু হলো গুস্তভের অতিউৎসাহী ডাঁয়ে বাঁয়ে মাথা নাড়া — বইয়ের নামগুলো দ্রুত পড়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায়।

মৃদু আমোদিত কাফকা বললেন — ও, তুমিও দেখছি আরেক বইপাগল! তোমারও মাথা অতিরিক্ত পড়াশোনার কারণে পশুপুচ্ছের মতো সদা-চঞ্চল!

- ঠিকই। বই ছাড়া আমি থাকতে পারি না। আমার কাছে বই-ই একটা আস্ত পৃথিবী।

কাফকার ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হলো — সেটা একদমই ঠিক নয়। একটা বই কখনও একটা পৃথিবীর জায়গা নিতে পারে না। অসম্ভব। জীবনে ঘটমান সবকিছুর আলাদা আলাদা অর্থ ও উদ্দেশ্য থাকে, যার কোনও স্থায়ী বিকল্প হতে পারে না। কোনও একজন মানুষের জীবন-অভিজ্ঞতা প্রাপ্তি আরেকজন মানুষের মাধ্যমে হতে পারে না। বস্তুত, একজন লেখক জীবনকে বইয়ের গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করে, ঠিক যেমন আর একজন আকাশের কোনও গায়ক-পাখিকে খাঁচায় বন্দি করে রাখে। কোনওটাই কোনও কাজের নয়। দার্শনিকেরা আসলে উজ্জ্বল পালকে ঢাকা তোতাপাখি, যাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা খাঁচা।

কথা উঠল তরুণ কবিদের নিয়ে।

কাফকা - তারুণ্য আমার কাছে জীবনের এক ঈর্ষণীয় সময়।

গুস্তভ - আপনাকেও তো তেমন বয়স্ক বলা যায় না।

কাফকা - আমি এক পরিব্রাজক ইহুদি। ইহুদিরা জন্ম থেকেই বুড়ো।

কিছুটা অবাক গুস্তভ আড়চোখে কাফকার দিকে তাকায়। কাফকা গুস্তভের কাঁধে সস্নেহ হাত রেখে বলেন—

- রসিকতা করার অপচেষ্টা তোমাকে চমকে দিয়েছে, তাই না? তবে তারুণ্য সত্যিই এক ঈর্ষণীয় সময়। বয়স যত বাড়ে, অভিজ্ঞতার দিগন্ত তত প্রসারিত হয় ঠিকই। কিন্তু তার সঙ্গে জীবনের সম্ভাবনা কমে যেতে থাকে। একদিন অবশেষে, মানুষ শেষবারের মতো একবার উপরে তাকায়, একটা শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ে। আর তখনই  তার সারাটা জীবন উন্মোচিত হয় একটা ফ্রেমে। সেই প্রথম, আর সেই শেষ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জানুসের এক উঠতি সিনেমা পরিচালক বন্ধু চ্যাপলিনের ছবিগুলোর স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা করেছিল প্রাগ শহরে। গুস্তভ তাঁর কিছু বিজ্ঞাপক  স্থির চিত্রের  প্রতি কাফকার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কাফকা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে সাগ্রহী হাসি হাসেন।

গুস্তভ - আপনি কি চ্যাপলিনের কাজের সঙ্গে পরিচিত?

- খুবই সামান্য। ওঁর ক্যারিক্যাচারের একটা দুটো ছবি দেখেছি মাত্র। এক অতি-মেধাবী কাজ-পাগল মানুষ। ওঁর দু'চোখে শোষিত মানুষের জীবনের অবস্থার অপরিবর্তনীয়তাজনিত আপোসহীন হতাশার শিখা। একজন প্রকৃত কমেডিয়ানের যেমন থাকা উচিত, ওঁর ধারালো দংশন ওঁর শিকারের উদ্দেশে। যা দিয়ে আক্রমণ শানান নিজের এক মৌলিক পথে উৎপীড়ক পৃথিবীর উপর। চ্যাপলিন বস্তুত একজন টেকনিশিয়ান — এই যন্ত্র নির্ভর পৃথিবীর। যেখানে বেশিরভাগ মানুষ তার  মনের আবেগচালিত পথে জীবন নির্বাহ করার ক্ষমতা হারিয়েছে। দন্তচিকিৎসকের থেকে পাওয়া নকল দাঁতের মতো চ্যাপলিনের ছবি অবদমিত মানুষের কল্পনা শক্তির সহায়িকা যন্ত্র অঙ্গ।  শুধু চ্যাপলিনের ছবি নয়, সেই অর্থে সব সিনেমাই।

- তাহলে কি আপনি যাবেন? আমার বন্ধু খুব খুশি হবে।

- না গো, আমার ইচ্ছে না-যাওয়া। রসিকতা আমার কাছে এক অত্যন্ত গভীর বিষয়। আমি গিয়ে দেখব নিজে হয়তো একজন উৎকট রংচং মাখা ক্লাউনের মতো দৃশ্যপটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি।

গুস্তভ জানুস

আরও পড়ুন- জীবনানন্দ তৃতীয় নয়নে দেখেন বিশ্বযুদ্ধোত্তর কলকাতা

১৯২২ সালে কাফকা অ্যাক্সিডেন্ট ইনসিওরেন্স ইনস্টিটিউশনের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির পদ থেকে স্বাস্থ্যের কারণে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে নেন। ফ্রাউ স্ভাটেক — যাঁর উপর ছিল কাফকার অফিস পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব — একইসঙ্গে ছিলেন গুস্তভের বাড়ির গৃহকর্ম-সহায়িকাও। তাঁর মুখেই শোনা যায়—

- যেমন নিঃশব্দে ঢুকেছিল একদিন, তেমনই নিঃশব্দে — প্রায় ইঁদুরের মতো — একদিন ছেড়েছিল অফিস।

সব অফিসে যেমন থাকে, কাফকার অফিসেও ছিল এক অসূয়াপূর্ণ ঘোরতর কাফকা বিদ্বেষী সহকর্মী। নাম , ট্রেম্ল। সে স্ভাটেককে আদেশ দেয়, কাফকার ছেড়ে যাওয়া টেবিল ও আলমারি থেকে সব জঞ্জাল দ্রুত সরিয়ে ফেলতে। কাফকার টেবিলে ছিল নীল-সোনালি রঙের এক সেট কাপ প্লেট, যা থেকে কাফকা দুধ কিংবা চা পান করতেন। সযত্নে নিয়ে এসে ফ্রাউ স্ভাটেক সেটিকে জানুসের হাতে তুলে দেন, এই বলে যে— আমি জানি তিনি তোমার কাছে কত প্রিয়। তুমিও তাঁর খুব কাছের একজন। তাঁর ওষ্ঠের ছোঁয়া লাগা এই পেয়ালার যোগ্য রক্ষক একমাত্র তুমিই।

ঘর ছাড়া গুস্তভ তারপর যেখানে যেখানে গেছে, নীল-সোনালি কাপ প্লেট কোনওদিন তাঁর কাছ ছাড়া হয়নি। কিন্তু যে কাপের রিম একদা উঠে স্পর্শ করতো ফ্রানৎস কাফকার ওষ্ঠ, কী এক অমল শ্রদ্ধায় ও আনুগত্যে তাকে কোনওদিন নিজের ওষ্ঠাধারে ছোঁয়ানোর ধৃষ্টতা দেখাতে পারেনি গুস্তভ জানুস! গুস্তভের মা-বাবার দাম্পত্য বিবাদ চরমে পৌঁছলে সে একদিন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কিছুদিন পর আইনানুগ বিচ্ছেদ ও তার কিছু পরে ১৯২৪ সালের মে মাসে জানুসের বাবার মৃত্যু হয়। তার ঠিক একুশ দিন বাদে ফ্রানৎস কাফকা ভিয়েনার অদূরবর্তী এক অতি সাধারণ যক্ষ্মা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গুস্তভ জানুসের বয়স তখন ঠিক একুশ। ওই বয়সেই প্রথমে তাঁর শরীর ও মনের আশ্রয় এবং পরে তার বৌদ্ধিক দিগন্ত চিরতরে দূরে সরে গিয়েছিল।

প্রায় চার বছর ব্যাপী নিয়মিত সাক্ষাৎ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো অফিস ফেরত পাশাপাশি পদচারণার একদম শেষ পর্যায়ে কাফকার মুখে শোনা যে অমোঘ উচ্চারণ গুস্তভের বাকি জীবনের পথ নির্দেশিকা, তা ছিল খানিক এইরকম—

"জীবনও হতে পারে মাথার উপরের তারাভরা আকাশের মতো বিশাল ও গভীর। আমাদের অস্তিত্ব-তালাটির ক্ষুদ্র চাবি-রন্ধ্র দিয়ে যতটুকু দেখা যায় সেই আকাশের অসীমতা। যতটা না দেখা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি অনুভব করা যায়। তবে তার জন্য প্রয়োজন সেই চাবি-রন্ধ্রটিকে সতত পরিচ্ছন্ন রাখা।"

More Articles