বন্ধুহীনতা আর ভুল লাইন, ভারতে মাওবাদী আন্দোলনের সংকট

Maoist Movement: গেরুয়া ফ্যাসিবাদী আক্রমণ যখন উত্তুঙ্গ, তখন দেশের জনগণকে রক্ষা করতে এই সর্বহারা আধারকে দায়িত্ব নিয়ে গড়ে তুলতে হবে এক গণতান্ত্রিক জোট— যেখানে প্রাথমিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে এক যৌথ নেতৃত্ব।

BA

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)-র অধুনা দলত্যাগী, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কমিটি-সদস্য মাল্লোজুলা বেণুগোপাল ওরফে সোনু বা ভূপতি, কেন্দ্রীয় কমিটিতে যিনি অভয় নামে পরিচিত, ঘোষণা করেছেন, তাঁদের পার্টি নেতৃত্বের তরফে অনুশীলিত লাইন "সম্পূর্ণ ভ্রান্ত" (ডেকান ক্রনিকল, ৬ অক্টোবর, ২৫) এবং সেই কারণে যখন রাষ্ট্র তাঁদের উপর এক ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে এনেছে, তখন তার প্রতিরোধ না করে, আবেগে আত্মঘাতী না হয়ে, মাওবাদী গেরিলারা বরং নিজের নিজের জীবন রক্ষা করুন, আত্মসুরক্ষার দিকে নজর দিন। তাঁর মতে এটাই তাঁদের এই মুহূর্তের একমাত্র কর্তব্য। অভয়ের এই বক্তব্যের সমর্থনে ইতোমধ্যেই উত্তর বস্তার, গার্চিরোলি এবং অবুঝমাড়ের সশস্ত্র ডিভিশনগুলো বিবৃতি দিয়েছে। সাময়িক যুদ্ধ বিরতি তথা অস্ত্র সংবরণের সিদ্ধান্তও নাকি জানিয়েছে তারা। তেলেঙ্গানার সিঙ্গারিলি কয়লা খনির গোপন সংগঠনও এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে বলে খবর। তবে ব্যাপারটা সর্বাত্মক নয়। এখনও পূর্ব বস্তার, পশ্চিম বস্তার, দক্ষিণ বস্তার এবং দারভা ডিভিশন অভয়ের বক্তব্যের সমর্থনে কিছু লিখেছে বলে জানা যায়নি। যদিও, সংবাদপত্রের রিপোর্ট (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৯ অক্টোবর, ২৫) থেকে এটা কিছুটা হলেও স্পষ্ট যে, বর্তমানে পূর্ব বস্তার এবং দারভা ডিভিশন সামরিক ভাবে অকেজো হয়ে পড়েছে।

যাই হোক, অভয়ের এই বক্তব্যকে কোনোভাবেই সমর্থন করতে রাজি হননি সিপিআই (মাওবাদী)-র সদ্য নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক কমরেড দেবুজি। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, অভয় পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই তাঁর ব্যক্তিগত মতামত জনসমক্ষে রেখেছেন, এবং শত্রুর হাতে অস্ত্র সমর্পণ করে তথাকথিত মূলস্রোতে মিশে যাওয়া যে আদতে জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা— এটাও বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন। (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৯ অক্টোবর, ২৫) এর উত্তরে অভয় অবশ্য দু'দিন আগেই নতুন এক চিঠিতে লিখেছেন, "গত ১৫ তারিখ আমি যে বিবৃতি দিয়েছিলাম তা পার্টি সংগঠনের বিভন্ন স্তরে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচিত হয়েছিল, এবং আলোচনা শেষ হলে তবেই তা ১২ সেপ্টেম্বর জারি করা হয়।” সেই চিঠিতে কোনো পরিবর্তন যে করা হয়নি একথাও জানিয়েছেন তিনি। কেন্দ্রীয় সম্পাদক এবং সদ্য-প্রাক্তন কেন্দ্রীয় কমিটি-সদস্যের মধ্যে এই তরজা থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ব্যাপক আক্রমণের মুখে সিপিআই (মাওবাদী)-র গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাও ভেঙে পড়েছে, যা অবশ্য খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার অনুশীলনে পার্টির অভ্যন্তরে নানান ঘাটতির কথা শোনা যাচ্ছিল। রাষ্ট্রীয় আক্রমণের মুখে সেই ঘাটতির ফাকফোঁকরগুলো একেবারেই উন্মুক্ত হয়ে গেছে।

অভয়ের এই আহ্বান এবং তার পক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়া বিভিন্ন ডিভিশনের সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণার ফলে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের পর্যবেক্ষকদের মধ্যে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে— সশস্ত্র সংগ্রাম কি তাহলে আদৌ সম্ভব? এসব করে কি কোনো লাভ আছে? এরই মধ্যে মূলস্রোত বলে পরিচিত সংসদপন্থী কমিউনিস্টদের একাংশের তরফে শান্তিপূর্ণ পার্লামেন্টারি পথের স্বপক্ষে যুক্তি দেওয়াও শুরু হয়েছে। ভারতের মতো দেশে, যেখানে একটা সংসদীয় ব্যবস্থা রয়েছে, এবং সেই সঙ্গে যে দেশ তথ্যযুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে, নিজের সামরিক বাহিনীকে, প্রযুক্তিগত ভাবে প্রচণ্ড শক্তিশালী করে তুলেছে, সে দেশে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিপ্লব সফল করা যে আদতে একটা নৈরাজ্যবাদী বিচ্যুতি— এটাই বুঝিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন- উই দ্য পিপল: পাতা উল্টে ভারত ভ্রমণ করায় যে বই

মুশকিল হলো, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের তথাকথিত উগ্রবাদী অংশ এবং তথাকথিত শান্তিকামী অংশ— কেউই একটা মৌলিক বিষয় অনুধাবন করছেন না। কমিউনিস্ট পার্টি অস্ত্র তুলে নেয় এই কারণে নয় যে সে বন্দুক চালাতে খুব ভালোবাসে। সে অস্ত্র তোলে, বা বলা ভালো, তুলতে বাধ্য হয়, কারণ শাসকশ্রেণি তার লুঠের সাম্রাজ্য বজায় রাখতে শুধু মতাদর্শগত প্রচার চালায় না, পেশীশক্তিরও ব্যবহার করে, এবং চূড়ান্ত পর্বে অস্ত্রটাই সেই দমনপীড়নে মুখ্য ভূমিকা নেয়। যতক্ষণ শাসক রক্তের বন্যায় সমস্ত প্রতিরোধ ভাসিয়ে দেয় না, ততক্ষণ কমিউনিস্ট পার্টিও অস্ত্র তোলে না। কিন্তু শাসকের যেহেতু বিভিন্ন ধরনের সামরিক, আধাসামরিক বাহিনী থাকে, থাকে নানান ধরনের ঠ্যাঙাড়ে ইউনিট, সেই একই ভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সমাজবদলে বিশ্বাসী কমিউনিস্ট পার্টিকেও তার বাহিনী এবং বিভিন্ন "শক ইউনিট" তৈরি রাখতে হয়। এর ভ্রূণকে সাধারণ ভাবে সিক্রেট ডিটাচমেন্ট বা গোপন বাহিনী বলে। শাসক নিপীড়িত গতরখাটিয়ে মানুষের উপর সশস্ত্র আক্রমণ বাড়াতে আরম্ভ করলে ক্রমশ কমিউনিস্ট পার্টিকেও এই ডিটাচমেন্টগুলোকে সার্বিকভাবে গণাবাহিনীর রূপ দিতে হয়। এটাই মৌলিক সত্য— সে ভারতেই হোক বা মার্কিন দেশে।

যে কোনো আন্দোলন কখনও জোয়ারে এগোয়, কখনও তীব্র ভাটার টানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়— মনে হয় যেন ধ্বংস হয়ে গেল সব। আবার অনেক সময়, ভাটার টানেও ছোটো ছোটো তরঙ্গ আঁকড়ে "কিছুই হয়নি" এরকম মানসিকতাও দেখা দেয় অনেকের মধ্যে। কিন্তু তাই বলে এই মৌলিক সত্যটা তো উবে যায় না! মনে রাখা দরকার, কোনো লড়াই-ই শুধুমাত্র সশস্ত্র হতে পারে না, আবার সার্বিকভাবে শান্তিপূর্ণও হতে পারে না। ভারতে শান্তিপূর্ণ উত্তরণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি যে দল কাজ করেছে তার নাম সিপিআই। এমনকি দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের শরিকী সংঘর্ষের আবহে তাঁদের নেতা-কর্মীরা কমিউনিস্ট নামধারী এক বড়ো শরিকের হাতে খুন হয়ে গেলেও তাঁরা আত্মরক্ষার বাইরে অস্ত্র তোলেননি। সেই সিপিআই-ও ১৯৭৮ সালে এসে, কমরেড রাজেশ্বর রাওয়ের নেতৃত্বে, ঘোষণা করেছিল—

"What needs to be made clear at the outset however is that the possibility of a peaceful transition in India (and it is a possibility and not inevitability) is not to be confused either with the reformist idea that piecemeal changes and piecemeal advances on their own way will obviate the need for a revolutionary leap or with the revisionist concept that the ballot box will be the main arena of the national-democratic revolutionary struggle. [...] It is also to be borne in mind that peaceful transition in India at any rate is not likely to be free of armed clashes. It is, finally, to be borne in mind that the non-peaceful path of the revolution is an equal possibility in India. While working for the peaceful path one has always to be ready for the other alternative." (Revolution in India: Path and Problems, Mohit Sen)

আসলে, মাওবাদী আন্দোলন কানাগলিতে ঢুকে গেছে সশস্ত্র লড়াইয়ের জন্য নয়। এটা হয়েছে প্রাথমিক ভাবে উৎপাদন-সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে পার্টি নেতৃত্বের ধারণাগত সীমাবদ্ধতা এবং তার থেকে উদ্ভূত ভুল রণনীতি ও কৌশলের কারণে। চারু মজুমদারের নেতৃত্বে ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়িতে যে কৃষক অভ্যুত্থান হয়, এবং তার প্রভাবে যেভাবে প্রথমে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সর্বভারতীয় সমন্বয় কমিটি এবং তারপর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-র মাধ্যমে সারা দেশে কৃষকের সশস্ত্র আন্দোলন ও সংগ্রাম পরিচালিত হতে থাকে, তা শাসকশ্রেণীর ভিত কাঁপিয়ে দেয়। তীব্র রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, পার্টিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং কিছু বাম ও দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতির পরিণামে এই সম্ভাব্য কৃষি বিপ্লব ব্যর্থ হলে ভারত রাষ্ট্র কমিউনিস্ট বিপ্লবী সম্ভাবনাকে সমূলে উৎপাটিত করার প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রথমে তারা জোর খাটায়, কিন্তু তাতে খুব কিছু লাভ হয়নি। এর ফলে শুরু হয় মধ্যবিত্তের তথাকথিত উন্নতি সাধন। রাষ্ট্র নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছিল যে, সরকারি কর্মচারীদের একটা বিরাট অংশ সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিল নকশালপন্থী আন্দোলনে। শিক্ষক-অধ্যাপক-সরকারি করণিকরা হয়ে উঠেছিল এই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ফলে, বিপ্লবী সংগ্রাম রুখে দিতে প্রয়োজন ছিল এই বাহিনীকে অকেজো করার। কিন্তু শুধু মাত্র জোর খাটিয়ে সেটা সম্ভব ছিল না। দরকার ছিল অন্য এক পদ্ধতির। 

আরও পড়ুন- আজও দগদগে কমিউনিস্ট চিনের নারকীয় গণহত্যার ইতিহাস

ব্যাংক-বীমা-কয়লাখনি জাতীয়করণ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছিল। এবার, নতুন পরিস্থিতিতে শুরু হয় সরকারি কর্মচারীদের নতুন পে কমিশন বসিয়ে বিপুল হারে মাইনে বাড়ানো, তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি। ১৯৭৫-এর মধ্যে সরকার প্রথম ধাপটা পূরণ করে। কিন্তু সোভিয়েত-মার্কিন দ্বন্দ্বের আবহে ইমার্জেন্সি ঘোষিত হলে সেখানে কংগ্রেস সরকারের কুড়ি দফা কর্মসূচীর পাশাপাশি যুক্ত হয় সঞ্জয় গান্ধীর পাঁচ দফা। ভারতের মতো কৃষিভিত্তিক সমাজে যে জোর-জবরদস্তি সঞ্জয় গান্ধী করতে শুরু করেন তাতে মধ্যকৃষক সম্প্রদায় কংগ্রেসের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে।

ওদিকে, মধ্যকৃষকদের যে অংশ রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের অভাবে আঞ্চলিক নেতৃত্বের জায়গা থেকে ব্যাপক ভাবে যোগ দিয়েছিল নকশালদের সঙ্গে, তা আন্দোলনে ধ্বস-ভাঙনের কারণে ইন্দিরা-বিরোধী শক্তির হাতে জড়ো হয়। ১৯৭৭ সালে জনতা সরকার এই মধ্যকৃষকবর্গকে সরাসরি পার্লামেন্টের অংশীদারিত্ব দেয়। এর প্রভাব এমনই হয়ে দাঁড়ায় যে তারপর থেনকে এই ধারা চলতে শুরু করে গড়গড়িয়ে। স্বভাবতই, সমতলের মধ্যকৃষক সরে যেতে থাকে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের পথ থেকে। তার উপর গ্রামাঞ্চলে পুঁজি ও বাজারের অনুপ্রবেশ ভেঙে দেয় ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির এতদিনকার স্বাভাবিক ব্যবস্থা। নব্বই-পরবর্তী সময়ে এর মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সমতলে গেরিলা শক্তির গতিময়তা ভেঙে পড়ে। ফলে, যে সমস্ত কমিউনিস্ট বিপ্লবী শক্তি সরাসরি চেষ্টা করেছিল দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধ গড়ে তুলতে, তারা পিছিয়ে পড়া অর্থাৎ ভারতের কুড়ি শতাংশ এলাকা, যা বন এবং পাহাড়ে ঘেরা, তাতে ঢুকে যেতে শুরু করে। শ্রেণিপ্রশ্ন ক্রমশ আদিবাসীদের পরিচিতি সত্তার প্রশ্নের সঙ্গে মিশে যেতে শুরু করে, এবং জল-জঙ্গল-জমির উপর কর্পোরেট হামলাদারির প্রেক্ষাপটে এই পরিচিতি সত্তার প্রশ্নটাই মাওবাদী বিপ্লবীদের কাছে প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়।

এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন যে, বিপ্লব-পূর্ববর্তী চিনের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ফলে লাল ক্ষমতা দীর্ঘ সময় সেখানে আঞ্চলিক স্তরে টিকে থাকতে এবং তার থেকে বিকশিত হতে পেরেছিল। কিন্তু নব্বই-পরবর্তী ভারতে সেই পরিস্থিতি, বিশেষ করে সামন্ত শ্রেণির মধ্যে যুদ্ধাবস্তা (সাধারণ দ্বন্দ্ব নয়, যুদ্ধ) এবং গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাভাবিক অর্থনীতির প্রাধান্য, দ্রুত মুছে যেতে থাকায় নীতিগত লাইনের ব্যাপক মূল্যায়ন এবং তার ভিত্তিতে নতুন রণকৌশল গড়ে তোলা মাওবাদীদের কাছে হয়ে পড়েছিল এক অত্যন্ত জরুরি বিষয়। কিন্তু পার্টির ভিতরে নানা সময়ে বিতর্ক উঠলেও নেতৃত্ব উটপাখির মতোই সেসব থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিলেন, আমলাতান্ত্রিক ঢঙে সমস্ত বিরোধ মুছে ফেলার চেষ্টাও যে করেননি এমন নয়। এর যা পরিণতি হওয়ার, তাইই হয়েছে।

আরও পড়ুন- ভারতে কি জনগণের ভোটে সরকার গড়া হয়?

ভারতের আজকের বাস্তবতা এই যে, এখানে সোভিয়েত প্রভাবযুক্ত জনকল্যাণমূলক অর্থনীতির অবশেষরূপে সর্বজনীন ভোটাধিকারের উপর প্রতিষ্ঠিত একটা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক পার্লামেন্ট ব্যবস্থা আছে, যা নানা সমস্যা এবং সঙ্কীর্ণতা সত্ত্বেও, অত্যন্ত দৃঢ় ভাবে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে, এবং 'জরুরি অবস্থা'-পরবর্তী সময়ে ইন্দিরা গান্ধীকে মসনদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে গণমানসে ব্যাপক প্রভাব বজায় রেখেছে। এই সংসদীয় ব্যবস্থা শাসক-বিরোধী গণরোষ সামাল দেওয়ার পাশাপাশি আধা-ঔপনিবেশিক দেশের অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল বিবিধ পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থ সংক্রান্ত যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, তা প্রশমনে সাহায্য করেছে, এবং তার ফলেই, বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ ফ্যাসিবাদী ঝোঁক দেখা দেওয়া সত্ত্বেও, দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম হতে দেয়নি। মোদী এবং আরএসএস এই প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থাটাকেই সমূলে উৎপাটিত করার চেষ্টা করছে, যা তারা করতে সক্ষম হলে ফ্যাসিবাদ পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হবে।

ভারতীয় সমাজকে একটা সরীসৃপের দেহাকারের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে তার লেজ-সহ বৃহৎ অংশ পড়ে আছে কৃষি সমাজে, মধ্যাংশ অবস্থান করছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল জমানায়, এবং মাথা ও তৎসংলগ্ন অংশ রয়েছে তথ্যপ্রধান যুগে। এহেন অবস্থায় শুধুমাত্র কৃষি বিপ্লবী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে কোনো স্থায়ী বৈপ্লবিক বিকাশ ঘটতে পারে না। গ্রামাঞ্চলের পূর্বোক্ত পরিস্থিতি তাকে বিকশিত হতেই দেবে না। দেশে অসম বিকাশ থাকার ফলে তা কিছু পরিমাণে বিপ্লবী আগুনের জন্ম দেবে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাবে। আবার একই ভাবে মানুষের মধ্যে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার যে মোহ রয়েছে, তা গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলোকে নিছক অর্থনীতিবাদী পাঁকে ডুবিয়ে মারবে। ফলে আজকের ভারতে বিপ্লব সংঘটিত করতে হলে তথ্যযুগে অবস্থানকারী নাগরিক সমাজের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মধ্যে দ্বন্দ্বের মীমাংসা ঘটিয়ে শহরজোড়া অভ্যুত্থান এবং গ্রামীণ কৃষকের পার্টিজান যুদ্ধের সম্মিলিত ঢেউ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর মারফত আঞ্চলিক ক্ষমতা দখলের ভিতর দিয়েই ভারতীয় বিপ্লব এগিয়ে যাবে। এই কাজ দেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো থেকেই শুরু হওয়া বাঞ্ছনীয়।

মাওবাদীরা যদি ২০১১ সালে লালগড় আন্দোলনের পরপরই ক্রমশ সশস্ত্র সংগ্রামের বিষয়টাকে একমাত্র কর্তব্য না ভেবে, কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় সশস্ত্র প্রতিরোধের রাস্তাটুকু খোলা রেখে, সর্বাত্মক সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে সাময়িক বিরতি নিয়ে বামশক্তির মধ্যে বন্ধু খুঁজে প্রকাশ্য গণআন্দোলন, গোপন গণসংগ্রাম ইত্যাদির উপর জোর দিতেন, তাহলে এই অবস্থাটা হতো না। দু'পক্ষই উপকৃত হতো। আজকের দিনে এটাই প্রকৃত প্রস্তাবে 'ভারতীয় পথ'। অনুশীলনে এই ভারতীয় পথ বাস্তবায়িত হতে পারে প্রাথমিক ভাবে একটা সর্বহারা আধার তৈরির মধ্য দিয়ে। কিন্তু গেরুয়া ফ্যাসিবাদী আক্রমণ যখন উত্তুঙ্গ, তখন দেশের জনগণকে রক্ষা করতে এই সর্বহারা আধারকে দায়িত্ব নিয়ে গড়ে তুলতে হবে এক গণতান্ত্রিক জোট— যেখানে প্রাথমিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে এক যৌথ নেতৃত্ব। ভারতের শ্রমিক আন্দোলন নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে যাওয়ার ফলেই যৌথ নেতৃত্বের প্রশ্নটা এখানে গুরুতর ভাবে উঠে আসছে। তবে সে নিয়ে না হয় আলোচনা অন্য কোনো সময়ে হবে।

More Articles