রোবট প্রথম খুন করে আস্ত মানুষকে! কী ঘটেছিল ৪৫ বছর আগের সেই দিনে?
Robot Killed Human: উইলিয়ামসকে মেরে ফেলার পরেও রোবটটি কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। উইলিয়ামস ওই অবস্থাতেই প্রায় ৩০ মিনিট পড়েছিল।
রোবট বিষয়টি যখন প্রথম আবিষ্কৃত হয়, অবাক হওয়ার সীমা ছিল না। বহু যুগ অতিক্রান্ত। আমরা এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জমানায়। এখন রোবট চিকিৎসা করে, পরিবেশন করে, দোকান সামলায়, হিসাব সামলায়— আমাদের আর অবাক লাগে না। তবে রোবট শুধুই এসব করে না, খুন-ডাকাতিও করে। আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগে রোবটের হাতে প্রথম খুন হয় এক মানুষ। ১৯৭৯ সালের ২৫ জানুয়ারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রবার্ট উইলিয়ামস নামে এক ব্যক্তি একটি রোবটের হাতে নিহত হন।
উইলিয়ামসের বয়স তখন মাত্র ২৫। মিশিগানের ফ্ল্যাট রকের ফোর্ড মোটর কোম্পানির কাস্টিং প্ল্যান্টের কর্মচারী ছিলেন উইলিয়ামস। ১৯৭৯ সালের সেই দিন তিনি কারখানাতেই কাজ করছিলেন। কারখানার এক অংশ থেকে অন্য অংশে কাস্টিং এবং অন্যান্য উপকরণ নিয়ে যাওয়ার একটি যন্ত্র মেরামতির কাজ করছিলেন মন দিয়ে। আসলে ওই মেশিনটি খুব ধীরে ধীরে কাজ করছিল। সন্দেহ হয়, কোনও গোলযোগ বেঁধেছে ভেতরে নির্ঘাত। তাই উইলিয়ামস বিষয়টি দেখতে একটি শেভিং ইউনিটের তিনতলায় চাপেন। আইনি নথি বলছে, সেখানে একটি যান্ত্রিক হাত উইলিয়ামসকে "পিছন থেকে ধরে পিষে ফেলে"।
জানা যায়, উইলিয়ামসকে মেরে ফেলার পরেও রোবটটি কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। উইলিয়ামস ওই অবস্থাতেই প্রায় ৩০ মিনিট পড়েছিল। তাঁর সহকর্মীরা বুঝতেও পারেনি কী ঘটে গিয়েছে। মনে করা হয়, কোনওভাবে ওই রোবোটিক সিস্টেম আস্ত একজন মানুষকে ভুল করে নির্জীব বস্তু হিসাবে শনাক্ত করে। ফলে স্টোরেজ ইউনিট থেকে সরানো দরকার ভেবে ওই রোবট আস্ত একজন মানুষকে চেপে পিষে সরিয়ে ফেলে।
আরও পড়ুন- প্রজননে সক্ষম হবে রোবট, অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালেন বিজ্ঞানীরা
১৯৮৩ সালে উইলিয়ামসের পরিবার মেশিন প্রস্তুতকারক লিটন ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে মামলা করে। পরিবারের যুক্তি ছিল, যেখানে রোবটিক হাতগুলি পুরোদমে কাজ করছে সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাই ছিল না। এই মামলায় শেষ পর্যন্ত উইলিয়ামসের পরিবারকে ১০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়ে আমেরিকার ইতিহাসে সেটিই ছিল সবচেয়ে বড় ক্ষতিপূরণ। তবে উইলিয়ামের পরিবার এখানেই থেমে যায়নি। মামলা আরও এগোয়, অবশেষে ১৯৮৪ সালে ১৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় তাঁদের।
১৯৮০-র ওই দশকে বিভিন্ন ভারী শিল্পগুলি তাদের কারখানায় স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা এবং রোবোটিক্সের ব্যবহার শুরু করে। নতুন এই ব্যবস্থায় উৎপাদন বাড়ে ঠিকই কিন্তু কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।
উইলিয়ামসের মৃত্যুর ঠিক দুই বছর পর জাপানে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। ১৯৮১ সালে, আকাশির কাওয়াসাকি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ প্ল্যান্টের একজন কর্মীর মৃত্যু ঘটে রোবটের হাতে। ৩৭ বছর বয়সি ওই কর্মীর নাম কেনজি উরাদা। একটি ত্রুটিপূর্ণ রোবট পরীক্ষা করছিলেন তিনি। এমন সময় একটি যান্ত্রিক হাত তাঁকে মেরে ফেলে। গ্যাব্রিয়েল হ্যালেভি তাঁর বই হোয়েন রোবট কিল: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আন্ডার ক্রিমিনাল ল-এ ব্যাখ্যা করেছেন: “রোবটটি ভুল করে ভেবেছিল যে ওই কর্মচারী তার কাছে একটি 'থ্রেট' এবং সে ভাবে এই 'থ্রেট' সরানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় ওই কর্মীকে ধাক্কা দেওয়া।" তিনি লিখছেন, "খুব শক্তিশালী হাইড্রোলিক বাহু ব্যবহার করে রোবটটি ওই কর্মীকে ভেঙে দেয়, তাকে, সঙ্গে সঙ্গে সে মারা যায়, তারপর আবার রোবট নিজের কাজ শুরু করে।"
আরও পড়ুন- দেবতার সেবা করবে রোবট হাতি! ভারতের এই মন্দিরে হইচই ফেলেছে ৮০০ কেজির রোবট
পরবর্তী দশকগুলিতে এই ধরনের আরও অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের একটি গবেষণা বলছে, ১৯৯২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোবটের হাতে মৃত্যুর কমপক্ষে ৪১টি ঘটনা ঘটেছে, যার প্রায় অর্ধেক ঘটনাই ঘটেছে মধ্য-পশ্চিম অংশে। উল্লেখ্য, এই অংশেই ভারী শিল্পের কারখানাগুলি রয়েছে।
রোবটের হাতে এই একাধিক মৃত্যুর বহু আইনি এবং নৈতিক সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অর্থাৎ AI-বিশ্বে এসব সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠছে। বেশিরভাগ বিজ্ঞানীরাই যুক্তি দেন যে, মানুষরাই তাদের তৈরি মেশিন এবং এআই সিস্টেমের জন্য নৈতিকভাবে দায়ী; রোবটরা নয়। তবে, এই AI-বিশ্বে শারীরিক মৃত্যুর পাশাপাশি মানুষের মানসিক মৃত্যুর জটিল তত্ত্বও উঠে আসছে। রোবোটিক্স আর এআইয়ের ব্যবহার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠলে মানুষের সম্প্রদায় কতটা নিরাপদ থাকবে? উত্তর এখনও অস্পষ্ট।