পাখির সঙ্গে যুদ্ধ! মেশিনগান ধরা মানুষকে নাকানিচোবানি খাইয়েছিল সেই বিশাল বাহিনী
The Great Emu War: কখনও মানুষে-পাখিতে যুদ্ধের কথা শুনেছেন? অস্ট্রেলিয়ার ‘ইমু যুদ্ধ’ ছিল এমনই এক যুদ্ধ।
মানবসভ্যতার শুরু থেকে মানুষে মানুষে বিভিন্ন কারণে যুদ্ধ লেগেই চলেছে; এর পিছনে কখনও ছিল লোভ, কখনও ঘৃণা, কখনও কট্টর দেশপ্রেমও ছিল যুদ্ধের কারণ। তবে কারণ যাই হোক না কেন, যুদ্ধের ফলে বারংবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে মানবতা। আজকে এমনই এক যুদ্ধের কথা বলব। এই যুদ্ধকে ইতিহাসের সবচেয়ে অদ্ভুতুড়ে যুদ্ধ বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। কেননা, এই যুদ্ধ হয়েছিল মানুষ এবং ইমু পাখিদের মধ্যে। কোনও প্রাগৈতিহাসিক কালের ঘটনা নয়। আজ থেকে মাত্র ৯০ বছর আগে, ১৯৩২ হয়েছিল এই অদ্ভুতুড়ে যুদ্ধ। কখনও মানুষে-পাখিতে যুদ্ধের কথা শুনেছেন? অস্ট্রেলিয়ার ‘ইমু যুদ্ধ’ ছিল এমনই এক যুদ্ধ। রীতিমতো দিনক্ষণ ঘোষণা করে হয়েছিল যুদ্ধ, একদিকে মেশিনগান-সহ অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনী, অন্যদিকে কুড়ি হাজার ইমু। তিনের দশকের অস্ট্রেলিয়ায় এই যুদ্ধকে ‘দ্য গ্রেট ইমু ওয়ার’-এর তকমা দেওয়া হয়। অন্য পাখিদের মতো উড়তে পারে না ইমু। অস্ট্রিচ বা কিউয়ি পাখির মতো হেঁটেই খাবার সংগ্রহ করে। এক জায়গা থেকে অন্যত্র পাড়ি দেয় হেঁটেই। উড়ানে অক্ষম ইমু পাখিরা কীভাবে অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে জয় পেয়েছিল? অস্ট্রেলীয় সরকারই বা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে গেল কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে ফিরে তাকাতেই হবে তিনের দশকে।
ইমু পাখি সম্বন্ধে কিছু কথা
ইমুদের অনেকেই উটপাখির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন অনেক সময়, এবং তাতে অল্পবিস্তর সত্যতা রয়েছে। ইমু উটপাখিদেরই দূরসম্পর্কের আত্মীয়, এর বৈজ্ঞানিক নাম Dromaius novaehollandiae । এরা সাধারণত চল্লিশ কেজির কাছাকাছি ওজনের হয়ে থাকে, এবং উচ্চতায় এরা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পাখি। এরা উড়তে পারে না, তবে দৌড়তে পারে খুব ভালো। হঠাৎ করে কাছে ছুটে আসতে দেখলে ভয় লাগারই কথা। অস্ট্রেলিয়ার সর্ববৃহৎ পাখি ইমু। তাদের পাওয়া যায় দেশের প্রায় সবখানেই, তবে আজকের গল্প পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার ইমুদের নিয়ে। তাদের প্রজননের মূল সময় মে ও জুন মাসে। প্রজননের পর পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার শুকনো জায়গা থেকে আরও পশ্চিমে চলে যায় ইমু-রা, কারণ শীতে খাবার ও জল কমে যায়। ১৯২২ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত প্রজাতি হিসাবে মর্যাদা পেত অস্ট্রেলিয়ার ইমু। তবে ১৯২২ থেকেই আবাদি জমিতে তাদের উৎপাত শুরু হওয়ায় সরকার তাদের শস্য-ক্ষতিকারক প্রাণীরূপে চিহ্নিত করে, এবং এই আইনে শস্যরক্ষায় তাদের শিকার বৈধ হয়ে যায়।
যুদ্ধের পটভূমি
ঘটনার সূত্রপাত প্রথম বিশ্বযুদ্ধর পরে। তখন হাজার হাজার যুদ্ধফেরত সৈনিক চারদিকে ভর্তি, যাদের যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনও দক্ষতা নেই। তাদের কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তা নিয়ে মহা সমস্যায় পড়ে অস্ট্রেলিয়ার সরকার। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় সরকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়, ‘সৈনিক পুনর্বাসন প্রকল্প’, যার ফলে প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক সৈন্য, যাদের অনেকেই ছিল ব্রিটিশ, কৃষিকাজ শুরু করে। তবে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার আবাদি জমির পরিমাণ অনেক কম হওয়ায় জমির বণ্টন হয়েছিল অনেকটাই অসম। এর বিকল্প হিসেবে পশ্চিমের চাষিরা উল এবং আটার চাষ শুরু করে, অনেকেই প্রচণ্ড লাভবান হন। তবে বেশিরভাগ সৈনিকেরই অবস্থা হয় শোচনীয়। এরপর গ্রেট ডিপ্রেশন এসে অবস্থার আরও অবনতি ঘটল। এরই মধ্যে আটার দাম পড়ে যাচ্ছিল আশঙ্কাজনকভাবে, যা নব-নির্বাচিত সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে অক্ষম ছিল। তাই চাষিরা সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় সরকার-বিরোধিতার। তারা ঠিক করে, তারা তাদের শস্য বেচবে না। তখন ছিল ১৯৩২ সালের অক্টোবর মাস। এই টালমাটাল সময়েই পশ্চিমের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে এক অকস্মাৎ ঝড় আসে।
আরও পড়ুন: জঘন্য ক্রীতদাস প্রথা না থাকলে বিজ্ঞানের এই যুগান্তকারী আবিষ্কার হতোই না! লজ্জার সেই ইতিহাস
সাধারণত বাঁশ ও তারকাঁটার বেড়া দিয়ে আটকে রাখা যায় ইমুদের। তবে এরকম মন্দার সময় চাষিরা বেড়ার বন্দোবস্তও করতে পারছিল না, ফলে সমগ্ৰ পশ্চিমের প্রান্তিক এলাকাগুলো হয়ে উঠছিল বিশাল ইমু-বাহিনীর জন্য একটি উন্মুক্ত প্রান্তর। এই সময় অস্ট্রেলিয় কৃষকদের ক্ষেতে হানা দিয়েছিল ইমু পাখিরা। একটি দু'টি নয়, ঝাঁকে ঝাঁকে প্রায় ২০ হাজার ইমুর হানায় ক্ষেতের ফসল নষ্ট হতে বসেছিল। তাদের রুখতে অস্ত্র তুলে নেন কৃষকরা। সরকারের কাছে সেই কৃষকদের আর্জি ছিল, ইমু পাখিদের হঠাতে আবারও অস্ত্র তুলে নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হোক তাঁদের। কৃষকদের আর্জিতে সাড়া দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া সরকার। ফের মনে করিয়ে দেওয়া যাক, কৃষকরা কিন্তু আদতে ছিলেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাকর্মী। যথারীতি নিজেদের বাঁচাতে ফের অস্ত্র হাতে তুলে নেন প্রাক্তন সেপাইরা।
কিন্তু কোন অস্ত্র তুলবেন? ঘরে রাখা গাদাবন্দুক দিয়ে ইমুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ তো করা যাবেই না, উল্টে রেগেমেগে ঘরবাড়ি তছনছ করে দিয়ে যেতে পারে এই বিশাল পক্ষীবাহিনী। এদের জন্য দরকার কামান, ভালো বন্দুক। যথারীতি প্রাক্তন সেনাকর্মী এবং অধুনা কৃষকদের একটি দল শরণাপন্ন হলো তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ পিয়ার্সের। তারা তখনকার নতুন প্রযুক্তির অটোমেটিক বন্দুক, যাকে আমরা মেশিনগান বলে চিনি, তা দাবি করে বসল। এই মন্দার সময়ে মেশিনগান ‘ম্যানেজ’ করা যথেষ্ট কঠিন, পিয়ার্স জানতেন। অবশেষে, তিনি নিজের কানেকশন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে মাত্র দু'টি মেশিনগানের ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু পরিণতি কী হতে পারে, তা জানলে আরও বেশি বন্দুকের ব্যবস্থা করতেন পিয়ার্স। কয়েকটি কামান, গাদাবন্দুক, দু'টি মেশিনগান এবং দশ হাজার রাউন্ড গুলি নিয়ে প্রায় কুড়ি হাজার ইমুর সামনে দাঁড়াল কৃষকরা। অবশেষে, ১৯৩২ সালের ২ নভেম্বর শুরু হলো, ‘দ্য গ্রেট ইমু ওয়ার’।
শুরুতেই ধুন্ধুমার
১৯৩২-এর ২ নভেম্বরে শুরু হয় যুদ্ধ। ক্যাম্পিয়ন থেকে সৈন্যরা ফেরত আসে। তাদের নজরে পড়ে প্রায় ৫০টি ইমু। তারা বন্দুকের রেঞ্জ থেকে অনেক দূরে থাকায় তাদের মারার প্রায় সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়, ইমুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় চারদিকে। প্রথম দিনেই সৈন্যদের অনেক গুলি অযথা খরচ হয়, একগাদা হতাশা নিয়ে তাদের ফেরত যেতে হয়। দ্বিতীয় দিনে সৈন্যরা গোপনে হামলার পরিকল্পনা করে একটি গুদামের পিছন থেকে। তাতেও খুব একটা লাভ হয়নি। ইমুদের গতির কারণে ও মাঝপথে বন্দুক জ্যাম হয়ে যাওয়ায় প্রায় ১,০০০ ইমুর ভিড় থেকেও খুব অল্পই মারা যায়। দ্বিতীয় দিনেও প্রায় কয়েকশো রাউন্ড গুলি খরচ করে শুধু ডজনখানেক ইমু হত্যা করা যায়। ৮ নভেম্বরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সংসদ বা হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস, যারা এতদিন চাষিদের পক্ষেই ছিল, এই অভিযান নিয়ে আলোচনা শুরু করে। মিডিয়াও সরকারের তুমুল সমালোচনা শুরু করে সর্বত্র। অবশেষে বহুমুখী চাপের সামনে পরে পিয়ার্স ৮ নভেম্বর সৈন্য ও বন্দুক সরিয়ে নেন ক্যাম্পিয়ন থেকে।
পিকচার অভি বাকি হ্যায়
প্রথম রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ান সেনা জিতলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে প্রত্যাঘাত করে ইমুরা। প্রায় দ্বিগুণ গতিতে তারা ধ্বংস করে দিতে লাগল কৃষকদের ক্ষেত-খামার। বাধ্য হয়ে ১২ নভেম্বর সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগ আবারও মঞ্জুর করল ওই অঞ্চলে সেনা ও অস্ত্র সাহায্য। ১৩ নভেম্বর থেকে প্রথম দু'দিনের অভিযান এবার বেশ ভালোই হলো, প্রায় ৪০টির মতো ইমু হত্যা করা হলো। এরপর ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০০ ইমু মারা হচ্ছিল। ১০ ডিসেম্বর একটি সরকারি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যা দেখে তাজ্জব হয়ে যায় গোটা বিশ্ব। তাতে গুলি ও হত্যার হিসেব দেওয়া ছিল। ৯,৮৬০ রাউন্ডে ৯৮৬টি ইমুর মৃত্যু, অর্থাৎ, প্রতিটি ইমুর জন্য গড়ে ১০টি করে বুলেট খরচ হয়েছিল! যুদ্ধের পর এক সাক্ষাৎকারে অস্ট্রেলিয়ান সেনাবাহিনীর মেজর জে পি মেরেডিথ বলেছিলেন, “আমাদের যদি এই ইমুবাহিনীর একটি আলাদা দল থাকত এবং বন্দুকধারী ইমুসওয়ার দিয়ে আমরা ওই বাহিনী সজ্জিত করতে পারতাম, তাহলে আমরা পৃথিবীর যে-কোনও বাহিনীর সম্মুখে দাঁড়াতে পারতাম। মেশিনগানের বিপক্ষে এই বাহিনী হতো ট্যাঙ্কের মতো।"
যুদ্ধের শেষ পর্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে অস্ট্রেলীয় পক্ষিবিদ ডিএল সার্ভেন্টি লিখেছিলেন, "পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলিচালনার স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছিল মেশিনগানারদের।"
যুদ্ধের শেষ পরিণতি
তখনকার মতো ফসলগুলো কোনওমতে বাঁচাতে পারলেও বছরের পর বছর ধরে ইমুদের অত্যাচার মেনেই নিতে হয় চাষিদের। সেনাবাহিনী দিয়েও প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত তাদের আটকে রাখা যায়নি। অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধর কৌশল নিয়েছিল ইমু পাখিরা। অস্ট্রেলীয় পক্ষীবিদ আরও লিখেছেন, "ইমুদের নেতৃত্ব গেরিলাযুদ্ধর পথে এগোনোর নির্দেশ দিয়েছিল। নড়াচড়ায় অসুবিধা হলেও ইমু আর্মি ছোট ছোট ইউনিটে বিভক্ত হয়ে যায়। এইভাবে তারা অস্ত্রধারীদের আক্রমণকে অর্থহীন করে দেয়। মাসখানেকের মধ্যে ক্ষেতের সেনাবাহিনী হতাশ হয়ে পড়ে যুদ্ধ প্রত্যাহার করে নেয়।" তবে এরপর ইমুর জন্য বিশেষভাবে তৈরি বেড়ার ব্যবহার অনেক বেড়ে যাওয়ায় চাষিরা সম্ভাব্য ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ‘নৈতিক জয়’ কিন্তু ইমুদেরই হয়েছিল।

Whatsapp
