ইরান থেকে পালিয়ে এদেশে! ভারতীয় খাবারের সংস্কৃতিতে যেভাবে মিশে গেলেন পার্সিরা
Parsi cuisine: পার্সি পরিবারে নতুন কোনও সদস্যের জন্ম হলে জন্মদিনে সুজি, গোলাপজল দুধ আর শুকনো ফল দিয়ে তৈরি হয় রাভা বা সুজির পুডিং। বাড়ির অন্য কেউ খাওয়ার আগে এই পুডিং পড়শিদের বাড়ি বাড়ি বিলি করা হয়।
বিকেলের আলো পড়ে আসছে। মুম্বইয়ের দাদরের পার্সি কলোনির হলদেটে রঙের বাড়ির দীর্ঘ ছায়া এসে পড়েছে রাস্তায়। এই পাড়ার বেশিরভাগ বাড়িই দোতলা থেকে তিনতলা। গাছের ছায়া ভরা রাস্তায় বল দিয়ে দৌড়চ্ছে ছেলের দল। সাদা ফতুয়া, মাথায় টুপি পরিহিত এক বয়স্ক মানুষ হাঁটছেন রাস্তা দিয়ে। তাঁর গতি শ্লথ। বৃদ্ধ হয়েছেন তিনি। এই কলোনিটার মতোই তাঁর গায়ে লেগেছে বয়সের ছাপ। ধীরে হেঁটে বাড়ি ফিরলেন তিনি। ভিক্টোরিয়ান স্টাইলে বানানো তাঁর বাড়ির বারান্দায় বৈকালিক চায়ের আসর বসিয়েছেন মেয়েরা। লেসের কাজ করা পর্দা উড়ছে দখিনা হাওয়ায়। টিপটের কড়া চা ছোট-ছোট কাপে ঢেলে দিচ্ছেন একজন। এই চা বানানোর প্রণালী এঁদের আদি বাড়ি ইরানের মতো। প্লেটে সাজানো মাখনের স্বাদের বিস্কুট, বড় বড় বাতাসা আর নানখাটাই। আর একটা প্লেটে রাখা রয়েছে কুমাস। কেশর আর আমন্ড দিয়ে তৈরি এই কেক স্বাদে অনন্য। পার্সিদের নিজস্ব রন্ধনপ্রণালীর ছাপ প্রতিটি খাদ্যেই। এগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হলেন প্রৌঢ়। এই দেশ আদতে তাঁদের নিজেদের দেশ ছিল না। কিন্তু বহুযুগ আগে প্রাণ বাঁচাতে যখন তাঁদের পূর্বপুরুষরা ইরান থেকে পালিয়ে ভারতে এসে উপস্থিত হন, তখন থেকে এদেশ তাঁদেরই। এতটাই তাঁদের যে অনেকে মনে করেন, সেদিনের বম্বে গড়ে উঠেছিল পার্সিদেরই অবদানে। ১৫৯৯ খ্রিস্টাব্দে লেখা পার্সি পুরোহিত বাহমান কাইকোবাদের ‘কিসসা-ই-সঞ্জন’ বইটা পড়েছিল চায়ের টেবিলের পাশে। এই কবিতাটিতে আরবের ইরান আক্রমণের পরে জরাথ্রুস্ট ধর্মাবলম্বীদের আতঙ্ক, ভয় তাঁদের নিজের দেশ পারস্য থেকে কোনওক্রমে পালিয়ে আসার কাহিনি বিধৃত আছে। বইটা খুললেন প্রৌঢ়।
এই বই অনুসারে মুসলমানদের ইরান অভিযানের সময় পশ্চিম ইরানের অধিবাসী পার্সিরা প্রাণ এবং ধর্ম বাঁচাতে দলে দলে দেশ ছেড়ে ভারতের গুজরাতে এসে উপস্থিত হন। এই অবস্থা চলে অষ্টম শতক থেকে দশম শতক পর্যন্ত। কিছু সূত্র অনুযায়ী, পার্সিরা প্রথমে দিউতে এসে উপস্থিত হন। সেখানে বেশ কয়েকবছর বসবাসের পরে গুজরাতের রাজা যাদব রানার কাছে আশ্রয় চান তাঁরা। যাদব রানা দুধের এক ভর্তি পাত্র নিয়ে এসে পারসিদের বোঝান যে তাঁর রাজ্যে স্থান সংকুলান। অবস্থা দেখে এক পার্সি পুরোহিত এগিয়ে এসে দুধের মধ্যে এক মুঠো চিনি ফেলে দেন। বাধ্য হয়ে রাজা নিজের রাজ্যে আশ্রয় দেন শরণাগতদের। দুধে চিনি ঢেলে পুরোহিত যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তা কিন্তু সত্যি হলো একেবারেই। আক্ষরিক অর্থে দুধের মধ্যে চিনির মতো নিজেদের সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্মাচারণ নিয়ে পার্সিরা মিশে গেলেন এদেশের জনস্রোতে। পার্সি এবং ইরানিদের খাদ্যাভ্যাসও মিশে গেল ভারতের বিপুল খাদ্যসম্ভারে। মুম্বই, পুণে, কলকাতা এবং গুজরাতে পার্সিরা নিজেদের বসতি স্থাপন করেন। বিশেষত মুম্বই সমৃদ্ধ হয় পার্সিদের অবদানে। সেই সঙ্গে ‘খাট্টো-মিঠো' অর্থাৎ টক-মিষ্টি খাবার নিয়ে এখানে চালু হয় পার্সি রেস্তোরাঁ।
আরও পড়ুন- কোলে মার্কেটের ‘কোলে’ কারা, সুকিয়া স্ট্রিট, পার্সি বাগানের নেপথ্যে রয়েছে কোন ইতিহাস?
ইরানি এবং তাদের পশ্চিম প্রান্তের বাসিন্দা পার্সিরা ছিলেন রীতিমতো খাদ্যরসিক। জমকালো আর মনোহর খাদ্য এদের টেবিলে শোভা পেত নিত্য। তবে এদেশে আসার আগে পার্সিদের খাবারের ধরন ছিল আলাদা। সস, গ্রেভি — এগুলি তাদের রান্নায় ছিল না। রান্না হতো শুকনো। চাল, শিম, মাংস আর বিভিন্ন মশলা দিয়ে তৈরি ‘ওস-এ-ব্রেনঞ্জ’, বিভিন্ন ডাল, পালং শাক, বিট, মাংস দিয়ে তৈরি, টক-মিষ্টি ‘ওস-এ-মীর’ যেটা আবার গমের নুডলস দিয়ে সাজানো হতো, তেমন কিছু কম চেনা খাবারের সঙ্গে চালু ছিল শিস কাবাব, বাখতারি কাবাব, জুজেহ কাবাব। এগুলি পরিবেশিত হতো তাফতান বা তাফতুন নামের রুটি বা পোলাওয়ের সঙ্গে। সবজি হিসাবে ব্যবহৃত হতো ঢ্যাঁড়শ, লাউ, সবুজ বিন বা শুকনো বিন। সাধারণ মানুষ থেকে রাজা-রাজড়া সবাই খেত এইসবই। কিন্তু শুধু রাজাদের টেবিল বিভিন্ন উৎসবে কীভাবে সেজে উঠত তার বর্ণনা দিয়েছে গ্রিকরা। যারা রাজার সঙ্গে আহারে বসবে, তারা স্নান করে সারা দিন নিত তৈরি হতে। বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে, প্রসাধন করে, সুগন্ধী মেখে তবেই তারা আসতে পারত। খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকে পারস্য এসে পলিনিয়াস বলেছেন, রাজপ্রাসাদের খাবারের মেনুতে থাকত মিষ্টি আঙুরের জেলি, বিভিন্ন ধরনের মশলা দিয়ে তৈরি শালগম এবং মূলো যেগুলির মধ্যে পেস্তার তেল, ইথিওপিয়ান জিরে, কেশর ইত্যাদির পুর ভরা থাকত। এছাড়াও থাকত খেজুর, বেদানা, আপেল, কিশমিশ, আমন্ড। রাঁধুনিরা বিভিন্ন ধরনের পদ রান্না করে সোনা, রুপোর পাত্রে সাজিয়ে দিতেন থরে থরে। এই পাত্রগুলি তৈরি করতেন মিশর এবং ভারতের কারিগররা। এক প্রস্থ খাবার সাজিয়ে দিয়ে সারিবদ্ধ দাসরা দাঁড়িয়ে থাকতেন পরবর্তী খাবার টেবিলে সাজিয়ে দেওয়ার অপেক্ষায়। সাসানিয়ান আমলে লেখা বই ‘কিং হুসরভ অ্যান্ড হিজ বয়’-এ এই সময়ের রন্ধনপ্রণালী লেখা রয়েছে। এই সময়ের সবচেয়ে সুস্বাদু পদ ছিল বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করা ভেড়ার মাংস। গরুর দুধ খাইয়ে বড় করা ভেড়াটির বয়স হতে হতো দুই মাস। এর গায়ে ভালো করে জলপাইয়ের তেল মাখিয়ে ম্যারিনেট করা হতো বিভিন্ন মশলা দিয়ে। নরম, তুলতুলে এই মাংস রান্না করা হতো গরুর মাংস সেদ্ধ জল দিয়ে। এর ওপর ছিটিয়ে দেওয়া হতো ছানার জল। এই সময়ের বিখ্যাত মিষ্টি ছিল আখরোটের পেস্ট্রি, আখরোটের বান, আখরোটের মাখনে ভাজা আমন্ড পেস্ট্রি। তবে সবথেকে সুস্বাদু ছিল আপেল আর নাশপাতি জাতীয় এক রকম ফল থেকে রস বের করে তৈরা করা জেলি।

মুম্বইয়ের পার্সি ক্যাফে
তবে কেক, পেস্ট্রি বা জেলি যেমনটাই থাকুক না কেন অনেক পরের বাকলাভা ছিল স্বাদে অনন্য। কোথা থেকে বাকলাভা এসেছিল সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। অনেকেই মনে করেন, চিজ আর মধু দিয়ে বানানো গ্রিক প্লাসেন্টা কেক বাকলাভার জনক। অনেকের মতে, ইরানের লাউজিনাজ থেকেই বাকলাভার উৎপত্তি। আরবের বাসিন্দারা একে সমস্ত মিষ্টির সেরা বলে মনে করত। আবার অনেকের মতে, এর উৎপত্তি আসিরিয়ায়। সেই সময় এই মিষ্টি বানানো হতো ময়দার তাল দিয়ে। পরের দিকের মতো ফিনফিনে পাতলা ময়দার পরত দিয়ে নয়। এতে দেওয়া থাকত প্রচুর খেজুর আর শুকনো ফল। ইরানিরা এই পদ্ধতিতেই মিষ্টিটি বানাতে থাকে। বলা হয়, এক শেফ তাঁর শাসককে খুশি করার জন্য বাকলাভা বানান। অসাধারণ এই মিষ্টি খেয়ে সন্তুষ্ট শাসক তাঁকে ডেকে পাঠান। সেখানে শেফ বলেন কীভাবে ‘১০০পাতা’-র মতো অজস্র পাতলা ময়দার পরতে মধু আর রাজার প্রিয় ফল দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। পরে যখন সারা পৃথিবীতে বাকলাভা জনপ্রিয় হয় তখন অঞ্চল বিশেষে এতে দেওয়া হয় চিনির রস, লেবু, গোলাপ জল কমলালেবুর তেল গরম মশলা আর কেশর।
ইরানের ওয়াইন ছিল বিখ্যাত। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রাচীন ওয়াইনের সন্ধান পাওয়া যায় এইদেশেই। পশ্চিম পারস্যের গডইন টেপেতে খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর আগেকার বেশ কিছু পাত্রে আর্কিওলজিস্টরা ওয়াইনের অবশেষ পেয়েছেন। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ বছর আগে হেরোডেটাস সেই দেশে ভ্রমণ করতে এসে লেখেন যে ইরানিরা ওয়াইন খেতে খেতে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিত। আবার কখনও অভিযুক্তকে অপরিমিত ওয়াইন খাইয়ে দেওয়া হতো যাতে অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় সে অপরাধ স্বীকার করে। তবে এই পানীয় ছিল সমাজের উঁচু স্তরের মানুষের জন্য। সাধারণ লোকেরা গম, বার্লি আর মিলেটের পানীয় পান করত। মুসলিম অভিযানের পর ইরানে ওয়াইনের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়ভাবে কমে যায়।
এদেশে আসার পর পার্সি খাবারে মূলত দুই ধরনের প্রভাব দেখা যায়। নিজেদের যে খাদ্যাভ্যাস পারস্য থেকে তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন তার সঙ্গে মিলে যায় এদেশের রন্ধনপ্রনালীর প্রভাব। তাদের বাদাম, শুকনো ফল, মিষ্টি শিরনির সঙ্গে মিশে যায় আদা, রাসুন, কাঁচা লঙ্কা, দারচিনি, ভিনিগার, গুড়। ভারতে বসবাসকারী পার্সিদের রান্নায় ‘তিখু-খাটু-মিঠু’ অর্থাৎ টক-ঝাল-মিষ্টি যে স্বাদ পাওয়া যায় তা গুজরাতিদের থেকে রান্নায় গুড়ের ব্যবহার শেখার ফলেই। ভিনিগার রান্নায় যে টক স্বাদ দেয় তাও পার্সিদের এদেশে এসেই শেখা। আচার পার্সিদের মূল খাদ্যের সঙ্গী চিরকালই। ‘ঘারাব নু আচার’ অর্থাৎ বিভিন্ন মশলায় জারিত মাছের ডিম এবং ‘গাজর মেয়ানু’ আচার যেটি বিভিন্ন মশলায় গাজর এবং কাঁচা আম জারিয়ে তৈরি করা হয় — পার্সিদের পছন্দের খাদ্য। পার্সি মিষ্টিতে জায়ফল, এলাচ বিভিন্ন বাদাম গোলাপজলের ব্যবহার খুব বেশি।
পার্সিদের এদেশে আসার পর থেকে সময় কাটতে লাগল। ভারতে বিদেশি বণিকদের আনাগোনা ছিলই। এল পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ইংরেজরা। পার্সি খাবার এবং সংস্কৃতিতে এর প্রভাব পড়ল রীতিমতো। গুজরাতের সুরাটে ডাচদের জাহাজ ভেরায় এখানে ছোটখাটো ডাচ কলোলি তৈরি হলো। বলা হয়, পাঁচজন পার্সি রাঁধুনী গেলেন এই কলোনিতে কাজ করতে। পাম ওয়াইন দিয়ে ময়দা গেঁজিয়ে নরম রুটি বানাতে শিখলেন এঁরা। নাবিকদের প্রিয় ডিমছাড়া স্কটিশ শর্টব্রেডও বানানো আয়ত্ত করলেন তাঁরা। লম্বা সমুদ্র যাত্রায় এই রুটি খুব কাজে দিত। নাবিকদের ভিড় লেগে গেল পার্সিদের কাছে। সুরাতে তৈরি হতে লাগল পার্সি বেকারি। তাঁরা তৈরি করতে শিখলেন নানখাটাই। গুজরাতিরা ডিম খেত না। তাই কাজু, আমন্ড পেস্তা আর এলাচ দিয়ে তৈরি হতো এই মিষ্টি। ইংরেজরা আসার পর পার্সিদের সঙ্গে তাদের সখ্য হলো রীতিমতো। ইংরেজ আদবকায়দা শিখল পার্সিরা। ইংরেজি হয়ে দাঁড়াল তাদের প্রধান ভাষা। পরিজ, স্কচ এগ, ট্রিফল ঢুকে গেল পার্সিদের খাদ্যতালিকায়। ক্যারামেল কাস্টার্ড আর পাউন্ড কেক জনপ্রিয় হলো সবথেকে বেশি। পার্সিরা এদেশে এসে দুধ দিয়ে যে মিষ্টিগুলি বানানো যায় সেগুলি শিখে নিয়েছিল দ্রুত। বাংলার রসগোল্লা, মোগলাই শির কোর্মা বা গুজরাতি শ্রীখণ্ড তাদের জিভে ভালো লাগত বলেই ক্যারামেল কাস্টার্ড যার প্রধান উপকরণ দুধ আর ডিম দ্রুত মনোহরণ করল তাদের। আর পাউন্ড কেকে দুধ, ডিম, ময়দা যাবতীয় উপকরণ ব্যবহার হতো পাউন্ডের মাপে। ভারতে শিক্ষার হার কম ছিল বলে ক্রেতা থেকে বিক্রেতা সবারই সুবিধা হতো মাপ করতে। ব্রিটিশরা রান্নায় অ্যালকাহোল ব্যবহার করত বরাবরই। রেড অথবা হোয়াইট ওয়াইন স্ট্যু বা স্যুপে দিত ব্রিটিশরা, মাছ ভাজার গোলা তৈরিতে বিয়ার আর শেরি অথবা ব্র্যান্ডি দেওয়া হতো ট্রিফলে। কফিতে যেমন হুইস্কি মিশিয়ে পান করত ব্রিটিশরা তেমনই কিছু স্কটিশ মিষ্টি যেমন ওটমিল, ক্রিম, রাস্পবেরি আর মধু দিয়ে তৈরি ক্র্যানচান, গেঁজিয়ে তৈরি করা একধরনের বিয়ার, ঝোলাগুড়, হুইস্কি আর ওটমিল দিয়ে তৈরি ক্রাউডি বানাতে শিখে নিল পার্সিরা। পার্সি ওয়াইন ছিল বিখ্যাত। খুব চল না থাকলেও এদেশে আসার আগে রান্নায় হোয়াইট ওয়াইন ব্যবহার করত পার্সিরাও। গুজরাতিরা মদ ছুঁত না বলে ইংরেজরা আসার আগে মদের প্রচলন তাদের মধ্যে ছিল না তেমন। মদের পরিমাপক হিসাবে চালু বিখ্যাত ‘পার্সি পেগ’ কথাটা ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলেই আসে।
১৮ শতক নাগাদ পার্সিরা ইংল্যান্ড, চিন, শ্রীলঙ্কা পূর্ব আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়ে ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য। ব্যবসায় সমৃদ্ধি তাদের সার্বিক অগ্রগতি সুনিশ্চিত করল। ক্রমে তারা আমেরিকা, নিউজিল্যান্ড, আরব-সহ বিভিন্ন দেশে বসতি স্থাপন করে। এর সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবে বিবর্তিত হতে থাকে তাদের রন্ধন প্রণালী, খাদ্যাভ্যাস। জিমি স্পাইস কিচেন, তাজ প্যাভেলিয়ান, ক্যাফে স্পাইস নমস্তে সহ নামী কিছু পার্সি রেস্তোরাঁ চালু হয় সারা পৃথিবীতে। এর ফলে সারা পৃথিবীর খাবার ঢুকে পড়ে পার্সিদের রান্নাঘরেও। সেই খাবার অধিকার করে নেয় ভারতে বসবাসকারী পার্সিদের মনও। ডিম, ক্রিম, গুঁড়ো এলাচ, গুঁড়ো জয়িত্রী দিয়ে তৈরি চায়ে ক্রিম ব্রুলের মতো কিছু খাদ্য জনপ্রিয় হয় তাদের মধ্যে। চায়ে ক্রিম ব্রুলের আদত বাড়ি ছিল স্পেন, ফ্রান্সে। একটু পরিবর্তিত হয়ে ব্রিটেনে এর নাম হয় ট্রিনিটি ক্রিম বা কেম্ব্রিজ বার্নট ক্রিম। লেবু, কমলালেবু পেস্তা চকলেটের এই রেসিপিতে পার্সি ছোঁয়া দিল জয়িত্রী এলাচের মতো মশলাগুলি।
তবে দেশে বিদেশে পার্সি খাবার ছড়িয়ে পড়লেও পার্সিরা কোনওদিনই তাদের শিকড় ভোলেনি। পার্সি পরিবারে নতুন কোনও সদস্যের জন্ম হলে জন্মদিনে সুজি, গোলাপজল দুধ আর শুকনো ফল দিয়ে তৈরি হয় রাভা বা সুজির পুডিং। বাড়ির অন্য কেউ খাওয়ার আগে এই পুডিং পড়শিদের বাড়ি বাড়ি বিলি করা হয়। প্রতিবেশীরা রাভা নিয়ে খালি পাত্রে চিনি দিয়ে পাত্র ফেরত দেয়। এই আচার জুড়ে আছে তাদের প্রথম এদেশে আশ্রয় নেওয়ার কাহিনির সঙ্গে। নতুন সদস্য যাতে চিনির মতো এদেশের মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারে তার জন্যই এই রীতি পালন করা হয়। ময়দা, পেস্তা, রুপোর তবক দেওয়া আমন্ড দিয়ে তৈরি করা হয় আগারনি নো লাভরো। কোনও গর্ভবতী মহিলা যখন সাত মাসে পা দেন, তখন অন্যান্য বিবাহিত মহিলাদের উপস্থিতিতে পালন করা উৎসবে এই খাবারটি দেওয়া হয়। গুজরাতি বেস শব্দের অর্থ বসা। কোনও পার্সি বাচ্চা যখন প্রথম বসতে পারে তখন অনুষ্ঠিত হয় বেসনা উৎসব। এই উৎসবে মেওয়া, গুঁড়ো দুধ, এলাচ, কেশর দিয়ে তৈরি হয় মাভা না পেন্ডা। সেন-ই-বলুঘ অনুষ্ঠিত হয় যখন কোনও মেয়ে বয়ঃসন্ধিতে পা দেয়। এই উৎসবে তৈরি করা হয় তাফতেহ। ডিম, চার রকমের বীজ, চালের গুঁড়ো দিয়ে তাফতেহ তৈরি করা হয়। পার্সি ছেলে বা মেয়ের তাদের ধর্ম জরাথ্রুস্টবাদে বরণ করে নেওয়ার উৎসব নভজ্যোত। ইরানে এই উৎসবের নাম সুদ্রে পুসি। ছোলার আটা দিয়ে তৈরি সেভ আর গোলাপের পাঁপড়ি ছড়ানো মিঠু দহি বা মিষ্টি দই এই উৎসবের বিশেষ খাদ্য। পার্সি বিয়ের সময় মাছের আকৃতির ছাঁচের মধ্যে দুধ, গুঁড়ো দুধ, শুকনো ফল দিয়ে মাছের মতো দেখতে মিষ্টি মাভা নি বই তৈরি করা হয়। মাছ পারসিদের শুভচিহ্নের দ্যোতক। গুজরাতের সমুদ্র উপকূলে বই নামের মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। গুজরাত ছেড়ে যারা কালক্রমে নানা দিকে ছড়িয়ে যান, তারা মাছের ছাঁচ দিয়ে এই মাছের অভাব পূরণ করেন। পার্সিরা তাদের থ্যাংঙ্কস গিভিং উৎসবকে বলেন জশন। এতে দেওয়া হয় মালিদো। সুজি, ময়দা, সূর্যমুখী ফুলের বীজ, কুমড়োর বিচি, ওটস, ঘি, ডিম, কিশমিশ দিয়ে এই মিষ্টি বানানো হয়। শুধু পার্সিরা নয় দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অঞ্চলের মানুষও তাদের শুভ দিনে মালিদা বা মালিদো বানান।
প্রাচীন যুগে ইরানিরা ছয় ঋতুতে পালন করতেন গাহামবারস। পুরোহিতরা পূর্বপুরুষদের জন্য মন্ত্রোচ্চারণ করেন। গ্রামের মানুষের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন। সারা গ্রামের রান্না হয় একত্রে। মাংস, সবজি, ডাল— যে যা পারেন নিয়ে আসেন। বিকেলের দিকে রান্না হয় ধানশাক। এতে লাগত ভেড়া বা মুরগির মাংস, অড়হর ডাল, পাঁচমিশালি ডাল, মিষ্টি আলু, আনারস, আদা, পেঁয়াজ, জিরে, ধনে। পার্সি সংস্কৃতিতে কালক্রমে মৃত্যুর সঙ্গে পদটি জুড়ে যায়। পরিবারের কেউ মারা গেলে প্রথম তিনদিন কেউ আমিষ খান না। চতুর্থ দিনে রান্না হয় ধানশাক। এক্ষেত্রে গরুর মাংসের ব্যবহার সবথেকে বেশি হয়। এইজন্যই বহু পার্সি পরিবারে শুভ উৎসবে ধানশাক রান্না হয় না। কলাপাতায় জড়ানো পমফ্রেট মাছের যে পদটির নাম পত্রানি মচ্ছি সেটি পার্সিদের অন্যতম বিখ্যাত আর প্রিয় পদ। ধনেপাতা, পুদিনা পাতা, কাঁচালঙ্কা লেবুর রস দিয়ে প্রথমে সবুজ রঙের চাটনি তৈরি করা হয়। এরপর স্টিমারে সবুজ চাটনি আর মশলা মাখা পমফ্রেট মাছ কলপাতা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। অনেকটা আমাদের পাতুরির মতো এই রান্নাটি খেতে অনবদ্য।

কায়ানি অ্যান্ড কোং
আরও পড়ুন- যৌনতা হোক বা পুজো, প্রসাধন অবাক করবে পুরাণ থেকে মুঘল আমলের সুগন্ধির ইতিহাস
ইরানিদের কথায় ফেরা যাক আবার। প্রাচীনকালে যে সময় সিল্ক রুট ধরে ব্যবসা বাণিজ্য চলত সেই সময় আর্য এবং জরাথ্রুস্টিদের যাতায়াতের পথমধ্যে ছিল বেশ কিছু ইরানি খাবার দোকান। পার্থিয়ানরা একে বলত চায়ে খানা। স্থানীয় মানুষ এবং পর্যটকদের খাবার পরিবেশন করত এগুলি। বিভিন্ন দেশের মানুষ এখানে খেত বলে মনে করা হয় শুধুই ইরানি খাবার নয়, আরও নানা দেশের রন্ধনপ্রণালী শিখে নিয়ে চায়ে খানার কর্মীরা এমন খাদ্য পরিবেশন করতেন যাতে পথিকরা খানিকটা হলেও নিজের দেশের ছোঁয়া পায়। যদিও খাবারে খুব বেশি আড়ম্বর ছিল না। সাদাসিধে আর আরামদায়ক খাবার এবং বসার ব্যবস্থা ছিল বলে পথের ক্লান্তি দূর করতে এগুলির জুড়ি ছিল না। ইরানে আরব আক্রমণের পর তাদেরই দেশের বাসিন্দা পার্সিদের মতো দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে এসে আশ্রয় নেয় বহু ইরানি পরিবার। ১৯০০ সাল পর্যন্ত এই দেশত্যাগ অব্যাহত থাকে। পার্সিরা যারা অনেক আগে ভারতে চলে এসেছে, ইরানিদের সাহায্য করতে থাকে। মুম্বইতে পার্সিদের ঘরে ঘরে ইরানি শরণার্থীদের স্থান হয়। কিন্তু ইরানিদের পার্সিদের মতো মূলধন ছিল না। ব্যবসা বা কোনও বৃহৎ প্রতিষ্ঠান তৈরি করার মূলধন না থাকায় এরা মুম্বইতে বেশ কিছু ছোট-ছোট ক্যাফে তৈরি করে। স্বাতন্ত্র আর ইরানি সংস্কৃতি সঙ্গী করে এই রেস্তোরাঁগুলি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রাচীন চায়ে খানার স্বাদ গন্ধ মিশে যায় আধুনিক এই রেস্তোরাঁগুলির গায়ে। এরাও কফির বদলে চা পরিবেশন করত। বাঁকানো কাঠের টেবিল, মার্বেলের মেঝে আর কাউন্টারে সারি সারি বয়ামের মধ্যে কেক, কুকিজ রাখা এই দোকানগুলি খাবারের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় মানুষের আড্ডাখানাও হয়ে ওঠে। তবে নানা সমস্যায় এগুলিও ধীরে ধীরে বন্ধ হতে থাকে।
১৯০৫ সালে যেখানে ৩৫০টি ইরানি ক্যাফে ছিল ১৯৫০-এ সেগুলি এসে দাঁড়ায় মাত্র ৫০টিতে। এখন যে ক্যাফেগুলি রয়েছ তারা টিকে থাকার লড়াইয়ে বিক্রি করে পার্সি খাবার থেকে বিরিয়ানি সবই। কিন্তু মুম্বইয়ের ফোর্ট জেলার ব্রিটানিয়া ক্যাফে এখনও কোনওরকমে ধরে রেখেছে অতীত ঐতিহ্য। পুরনো দিনের মতো এরা এখনও বিক্রি করে ইরানের স্পেশালিটি জেরেস্ক পোলো বা বেরি পোলাও। ইরানের খোরাসান প্রদেশে এই বেরির ব্যাপক ফলন হতো। এটাই ছিল এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান খাদ্য। মলিন কড়ি-বরগা বের করা এই ক্যাফেতে এখনও মুরগির মাংস বাসমতি চাল আর বারবেরির এই পদ খাদ্যরসিকদের প্রিয়।

ব্রিটানিয়া ক্যাফে
মুম্বইয়ের পার্সি রেস্তোরাঁগুলি এখনও কিছু কিছু চলছে। এর মধ্যে সবথেকে আগে বলা যায় কায়ানি অ্যান্ড কোং এর নাম। ১৯০৫-এর এই রেস্তোরাঁর জনপ্রিয় খাবারগুলি হল ইরানি চা, খিমাপাও চিজ, চিকেন সাল্লিবোটি। আর একটি নামী রেস্তোরাঁর নাম বি মেরওয়ান অ্যান্ড কোং। এখানকার বান মাস্কা, আকুরি, মেওয়া কেক বিখ্যাত। সুদূর ইরানের সংস্কৃতি, খাদ্য, লোকাচার ভারতের অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছিল পার্সিদের এদেশে আসার ফলেই। ভারতে এখন পার্সিদের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। পার্সি বেকারিগুলোর আলো নিভছে এক এক করে। মার্বেলের কাউন্টারের ওপর রাখা কাচের বয়ামের কেক কুকিজের দিকে আর লুব্ধ হাত বাড়ায় না শিশুরা। পার্সি কলোনির কোনও এক বৃদ্ধের চোখে তাই অনাগত ভবিষ্যৎ আশঙ্কার ছায়া ফেলে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো থাকবে না এদের অনেক কিছুই, তবু নিত্য আদানপ্রদানে যে রং লেগেছিল ভারতীয় সংস্কৃতি, অর্থনীতির গায়ে সে রং মুছবে না সহজে।