কাশ্মীরকে যেমন দেখেছি | এক সৈনিকের স্মৃতিচারণ
Kashmir: ভোর ৫টায় আমার ছোট্ট তাঁবুতে আমাকে ঘুম থেকে তুলতেন ইউসুফ, একমুখ উজ্জ্বল হাসি দিয়ে গরম চা এনে দিতেন। বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দ্য আমাদের এক উষ্ণ কম্বলের মতো জড়িয়ে রেখেছিল।
সম্প্রতি কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর সন্ত্রাসী হামলা আমার কিছু স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলেছে ফের। আজকের কাশ্মীরের সঙ্গে সেই কাশ্মীরের বিস্তর ফারাক, কিন্তু স্মৃতিগুলো টাটকা আজও, যেন গতকালের! ১৯৬১ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান গোর্খা রেজিমেন্টের দায়িত্ব লাভ করার পর জাতির প্রতিরক্ষায় আমাকে 'হত্যা করার ছাড়পত্র’ দেওয়া হয়েছিল। ২০ ফুট তুষারের উপর দিয়ে ১২,০০০ ফুট উঁচু রাজধানী গিরিপথে উঠেছিলাম। আমার গন্তব্য ছিল গুরেজ উপত্যকা। এই সুন্দর উপত্যকাতেই ছিল আমার ইউনিটের সদর দফতর। পহেলগাঁও তৃণভূমি থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর স্থানগুলির মধ্যে একটি ছিল এই অঞ্চল। তুষারের ঘন আচ্ছদনের মধ্যে এক নিবিড় প্রশান্তি, নৈসর্গিক আরামের আধার যেন।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক শীর্ষস্থানীয় রেজিমেন্টের একজন তরুণ অফিসার এবং একজন 'শিশু' সৈনিক হিসেবে এ যেন এক আশীর্বাদই। প্রকৃতির সবচেয়ে প্রতিকূল চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যেও গোর্খা সৈনিকের হাসিমাখা মুখ, তুষারপাত, উঁচু গিরিপথ ধরে টহল দেওয়া এবং খরস্রোতা পাহাড়ি ঝরণার চলাচল— সব মিলে ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে আমার মনে কাশ্মীরের একটা ছবি অক্ষত রয়েছে। হাসিমাখা কাশ্মীরি মুখ, বন্ধুসুলভ কণ্ঠস্বর এবং কাজের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ। সেই বছর শরৎকালে এক দীর্ঘ টহলদারি পরিচালনার নেতৃত্ব দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, সেই সময়জুড়ে বিশেষ করে এইটাই আমি সম্পূর্ণরূপে অনুভব করেছি। টহলদারির পথটি ছিল, উলার হ্রদের উত্তরে নিয়ন্ত্রণ রেখার ঠিক নীচে। এই অঞ্চলটিই ভারতকে তার প্রতিকূল প্রতিবেশী থেকে উত্তর এবং পশ্চিমে পৃথক করেছে। এর ঠিক পূর্বে আছে লাদাখের দ্রাস-কারগিল এলাকা এবং তারপর জোজি লা পাস ধরে কাশ্মীর ফিরে এসেছে পথ। এই সেই এলাকা যেখানে ভারত পাকিস্তানের 'রাজাকারদের' অনুপ্রবেশের মুখোমুখি হয়েছিল এবং তা ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের দিকে বিষয়টিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
সেই বছর বার্ষিক এই দূরপাল্লার টহলদারির দায়িত্ব ছিল আমাদের প্রতিবেশী ব্যাটালিয়নের। কিন্তু সেই ব্যাটেলিয়ানে উপযুক্ত কোনও তরুণ আধিকারিক না থাকায় আমাকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বলা হয়। কিছুটা অস্বাভাবিক ঠেকলেও আমার জন্য তা ছিল পরম সৌভাগ্য। এই ব্যাটালিয়নের সৈন্যরা সকলেই ছিলেন জম্মু ও কাশ্মীরের। আমার ১৬ জন সৈন্যের টহলদারি দলে ছিলেন জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের স্থানীয় মুসলিমরা, জম্মুরই একজন শিখ সৈনিক ছিলেন ওয়্যারলেস অপারেটর এবং আমি ছিলাম বাংলা থেকে। টহলদারির পথটি সেই এলাকার উপর দিয়েই ছিল যেখানে ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পাক 'রাজাকারদের' অনুপ্রবেশ ঘটায়। আমার টহলদারি দলের দায়িত্ব ছিল এই ধরনের সম্ভাব্য কার্যকলাপ শনাক্ত এবং প্রতিহত করা।
আরও পড়ুন- আমরা কাশ্মীরের ‘আপনা আদমি’ হতে পারি না?
সেই দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা দেওয়ার অনুমতি আমাদের নেই কিন্তু, বহু বছর পরে আমার মনে সৌহার্দ্য এবং বন্ধুত্বের অনুভূতিই আবার নাড়া দিয়ে গেল। আমার টহলদারি দলের 'সহায়ক' মহম্মদ ইউসুফের গলার স্বর ভেসে এল। ভোর ৫টায় আমার ছোট্ট তাঁবুতে আমাকে ঘুম থেকে তুলতেন ইউসুফ, একমুখ উজ্জ্বল হাসি দিয়ে গরম চা এনে দিতেন। বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দ্য আমাদের এক উষ্ণ কম্বলের মতো জড়িয়ে রেখেছিল।
টহল প্রায় শেষ করে জোজি লা পেরিয়ে লাদাখ থেকে কাশ্মীর উপত্যকায় ফিরে আসার পর, আমরা বালতালের বন বিশ্রামাগারে থামি। কয়েক দশক আগে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু স্ত্রী কমলা নেহেরুর সঙ্গে মধুচন্দ্রিমায় কয়েক রাত কাটিয়েছিলেন এই একই বিশ্রামাগারে। রেজিস্টারে সই করার সময় আমি বিষয়টি জানতে পারি। যেহেতু আমরা নির্ধারিত সময়ের একদিন আগেই এখানে এসে পড়ি, তাই সবাই মিলে অনুরোধ করল, হাতে একটা দিন যখন আছেই পাহাড়ের ঠিক ওপারে অমরনাথ মন্দির পরিদর্শন হয়ে যাক! শর্টকাট ধরে মাত্র এক দিনের ট্রেকিং। আগের বছরই আমি দেরাদুন থেকে গাড়োয়াল পাহাড়ের কেদারনাথে দুই সপ্তাহের ট্রেকিং করেছিলাম। আমি সম্মতি দিলাম, নিজেও আনন্দ পেলাম। হিন্দু ধর্মের পবিত্রতম স্থানগুলির মধ্যে একটি এই মন্দির। তা পরিদর্শন করা বিরল আনন্দের বিষয় তো বটেই। তবে শর্টকাট ধরে হলেও কঠিন ছিল উঁচু পাহাড়ি পথে ট্রেকিং। মন্দির সুরক্ষিত, দীর্ঘ শীতের মাসগুলিতে স্থানীয় মুসলিম কাশ্মীরি পরিবারগুলিই এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকে।
চার দশক পরে একই স্থানে ওয়ান-স্টার অফিসার হিসেবে আমি এই এলাকার দায়িত্বে ছিলাম। ততদিনে অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন। সমৃদ্ধ হয়েছে চারপাশ, পর্যটনের প্রসার ঘটেছে, মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ সমৃদ্ধ হয়েছে। সেই বছর যুক্তরাজ্য থেকে আমার বোন, পেশায় ব্রিটিশ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসেসের একজন চিকিৎসক এবং তাঁর স্বামী আমাদের সঙ্গে কাশ্মীরে বেড়াতে এসেছিলেন। আমার বোন এবং আমার স্ত্রী অমরনাথ মন্দিরে যাবে বলে ঠিক করল। তবে দুইজনেরই ওজন খানিক বেশি। আমি বলেছিলাম, আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে, ফিটনেস বাড়ানোর প্রশিক্ষণের কথাও বলি। সেসবে বিশেষ আমল না দিয়েই একদিন যাত্রা শুরু হলো। আমরা শ্রীনগর থেকে সড়কপথে বালতালে পৌঁছলাম এবং মন্দিরে ওঠার জন্য স্থানীয় টাট্টুঘোড়া ভাড়া করার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার শ্যালকের ওজনও কম নয়, তবে মন্দির দর্শনে তাঁর তেমন উৎসাহ নেই। তাই আমরা দু'জনেই সোনামার্গ উপত্যকায় কাটাব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের স্ত্রীরা ট্রেকিংয়ে চলল। স্ত্রীদের ঘোড়ায় চাপাতে গিয়ে আমি তাঁদের গাইড এবং মালিকের সঙ্গে কথা বললাম। আশা করেছিলাম, আমাদের জীবনসঙ্গীনিরা গোটা দিনের ট্রেকিং সেরে নিরাপদে ফিরে আসবেই। কথা বলে জানতে পারি, এই ঘোড়ার মালিকের বাবা মহম্মদ ইউসুফ, ২৪ বছর আগে টহলদারি দলের আমার সহায়ক ছিলেন যিনি। অবসর গ্রহণের পর এই উপত্যকায় বসতি স্থাপন করেছেন ইউসুফ, এই এলাকার একজন ঠিকাদার তিনি। এই কথা জানার পর কী যে নিশ্চিন্ত বোধ করেছিলাম! বুঝেছিলাম, আমাদের স্ত্রীরা সম্পূর্ণ নিরাপদেই থাকবে।
আরও পড়ুন- ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: কাশ্মীর বৈরিতার যে ইতিহাসে দাঁড়ি পড়েনি আজও
পরবর্তী দশকগুলিতে সমগ্র কাশ্মীরজুড়ে বহু বছর ধরে বেশ কয়েকটি ঘটনাবহুল অভিযান ও সংশ্লিষ্ট কাজের পর আমি কাশ্মীরের প্রকৃত সমন্বয়মূলক সংস্কৃতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি। কাশ্মীরের সভ্যতাগত সমৃদ্ধি, বৌদ্ধিক অখণ্ডতা এবং প্রকৃত সার্বজনীন বিশ্বাস সারা বিশ্বের এক সম্পদ। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কাবুল দখলের পর আফগান যুদ্ধ ঘটে। পরে মার্কিন হস্তক্ষেপে বিশ্বব্যাপী কাশ্মীরি ইসলামিক জিহাদকে একত্রিত করে, পেশোয়ারে তাদের কেন্দ্রীভূত করে তারপর আফগানিস্তান অভিযানের জন্য তাদের হাতে নগদ অর্থ এবং অস্ত্রের ভাণ্ডার তুলে দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) হাতে তুলে দেওয়া হয়। ২০০৩ সালে বিন লাদেনের নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে '৯/১১' সন্ত্রাসী হামলার শিকড় ছিল এটিই।
আজ আমরা সেই নীতিগত ব্যর্থতার দুর্বল পরিণতি ভোগ করছি। এই পদক্ষেপগুলির মাধ্যমে ধর্মীয় মৌলবাদীদের দানবীয় রূপ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে আশু প্রয়োজন এক ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় বিশ্বাস ব্যবস্থার। কাশ্মীরে সমন্বয়মূলক সংস্কৃতির শক্তির কাছে ফিরে যাওয়াই প্রকৃতপক্ষে এই সংঘাতের একমাত্র যুক্তিসঙ্গত সমাধান।
লেখক দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। তিনি নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত। মতামতের দায় ইনস্ক্রিপ্টের নয়