আত্মযত্ন আর বাহুল্যবর্জন! বঙ্গ-ফরাসি ফ্যাশনের শিকড়ে ছিল যে মন্ত্র

French Fashion and Style: বাঙালির ফ্যাশন যে লাল-সাদা শাড়ি, বড় টিপ ও কাজলে সীমাবদ্ধ নয়, তা উত্তর ভারত আর বলিউড না জানলেও বাঙালি জানে। অন্তত, বাঙালি জানত।

 ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক,  অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ফ্যাশন। সেই ১৫শ শতক থেকে ফ্যাশন চর্চা ফরাসি সমাজে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজা লুই চতুর্দশ ফ্রান্সকে ফ্যাশনের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ইওরোপের প্রধান শক্তি হিসেবে পরিচিত করেন। তাঁর রাজত্বকালে সমস্ত বিলাসবহুল সামগ্রী রাজকীয় নিয়ন্ত্রণে আসে এবং রাজদরবারের সাজপোশাক  ইওরোপিয় ফ্যাশনের মাপকাঠি  হিসেবে নাম করে। ১৬৭০ সালে ফ্রান্সে প্রথম ফ্যাশন ম্যাগাজিনের আবির্ভাব হয়, যা রাজদরবারের বাইরের জনসাধারণকেও ধীরে ধীরে ফ্যাশন সম্পর্কে সচেতন করে। এই ম্যাগাজিনগুলোতে মরসুমি ফ্যাশন ও নতুন স্টাইল প্রচার করা হতো। ফ্যাশন কেবল মহিলাদের জন্য নয়, লুই চতুর্দশ পুরুষদের জন্য কৃত্রিম বিশালাকৃতির কোঁকড়ানো উইগ পরা চালু করেন। শোনা যায়, নিজের টাক ঢাকতে রাজা এই উপায় বের করেছিলেন, যা ক্রমে দেশের আপামর পুরুষদের ফ্যাশনের অংশ হয়ে ওঠে। লার্জার দ্যান লাইফ সাজপোশাকের মাধ্যমে রাজার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পছন্দমতো বার্তা পৌঁছে দেওয়া— যেমন তাঁর প্রপৌত্রের বিয়ের সময় রাজা ও তাঁর সঙ্গীরা অতিউজ্জ্বল রঙের পোশাকে উপস্থিত হন, যাতে স্প্যানিশ প্রতিনিধিদের চেয়ে ফরাসি প্রতিনিধিদের বেশি তরুণ ও প্রাণবন্ত দেখা যায়। অর্থাৎ, ফরাসি ফ্যাশন ফরাসি পরিচয়ের অংশ হয়ে ওঠে। ফরাসি ফ্যাশন হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট।

ফরাসি রাজদরবারের অতিরিক্ত জাঁকজমকপূর্ণ ফ্যাশনের কারণে প্রজাদের কাঁধে এসে পড়ে বিশাল ঋণের বোঝা। এই বিলাসী জীবনধারা, বিশেষ করে মারি অঁতোয়ানেতের খরচপ্রবণতা, উচ্চশ্রেণির গ্ল্যামার, সম্পদ ও জীবনধারা ফরাসি বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করে। নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির ফ্যাশনে ক্রমশ দেশপ্রেম ফুটে উঠতে দেখা যায়। তাঁরা অভিজাতদের ধুলোমাখা উইগ ও হাঁটু পর্যন্ত ব্রিচ পরিহার করে ‘সঁ-কুলোৎ’ (Sans-culottes) নামে প্রজাতন্ত্রী কর্মজীবী জনগোষ্ঠীর পোশাক— লম্বা প্যান্ট ও স্বাভাবিক চুল— রাখতে শুরু করেন। এঁরা মাথায় পরতেন লাল স্বাধীনতার টুপি ‘ফ্রিজিয়ান ক্যাপ’। ফরাসি বিপ্লবের জাতীয় রঙ— নীল, লাল ও সাদা মিলে তৈরি হয় ‘ত্রিবর্ণ কোকাড’, যা পোশাক, হাতের পাখা ও কোটের পিনে ব্যবহৃত হতো। বিপ্লবপন্থী মহিলারা কালো স্কার্ট, জ্যাকেট ও টুপি পরা শুরু করেন, যার সঙ্গে যুক্ত থাকত ত্রিবর্ণ কোকাড। এই আমজনতার ফ্যাশন শ্রেণিসংগ্রামের প্রতীক হয়ে ওঠে।

‘সঁ-কুলোৎ’ (Sans-culottes)

আরও পড়ুন- মৎস্যপ্রেমে বাঙালিকেও হার মানাবে মেছো ফরাসিরা

আধুনিক সময়ে, বিশেষ করে বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, ফরাসি ডিজাইনার কোকো শ্যানেল ফরাসি তথা গোটা পৃথিবীর  ফ্যাশন জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। এই সময়ের উচ্চ ফ্যাশন বা ওত কুতুর হয়ে ওঠে  যুদ্ধ-পরবর্তী মর্যাদাভিত্তিক বাণিজ্যিক কূটনীতির অংশ, যা জাতির ব্র্যান্ডিংকেও প্রভাবিত করে। কোকো শ্যানেল ১৯২৫ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড Chanel-এর মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর দর্শন ছিল অনাবিল, সূক্ষ্ম অভিজাত্য তুলে ধরা। কোকো শ্যানেলের নিজস্ব চেহারা ছিল সেই সময়ের প্রচলিত সৌন্দর্যের বিপরীত— ছোট চুল, 'ছেলেদের মতো' গড়ন, ও রোদে পোড়া ত্বক। এটাই হয়ে ওঠে এক নতুন রূপের মানদণ্ড। শ্যানেলের ঘোড়দৌড় ও শিকারপ্রীতি এবং তাঁর স্পোর্টিং জীবন তাঁর ডিজাইনকে প্রভাবিত করে। জলযানে সময় কাটাতে গিয়ে তিনি গ্রহণ করেন নটিক্যাল পোশাকধারা— আড়াআড়ি ডোরা শার্ট, বেল-বটম প্যান্ট, ক্রুনেক সোয়েটার ও এস্পাদ্রিল জুতো— যা সাধারণত জেলেদের পোশাক ছিল। নিজস্ব পছন্দ এবং স্বাচ্ছন্দ্য অনুসারে ঢিলেঢালা পাতলুন ও জামা বেছে নেওয়ার সুযোগ মেয়েদের সামনে এনেছিলেন কোকো। পাঁজর ভাঙা কর্সেটের উপর সাগরপ্রমাণ গাউন বয়ে বেড়ানোর থেকে রেহাই পাওয়া গেল। অন্যদিকে, বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন প্রাতিষ্ঠানিক কাজের জগতে মেয়েদের কর্মসংস্থান বাড়ল, ফ্যাক্টরি ইত্যাদি জায়গায় কাজ করার জন্য সঠিক পোশাক নির্বাচনের সুযোগ সেই প্রথম পেল মেয়েরা। তাদের পূর্ব পোশাকাভ্যাসে হাজার রকমের কাজের সম্ভাবনা ছিল অকল্পনীয়। পোশাকে পকেট যোগ করলেন কোকো। কোকোর আগেও মেয়েরা যুদ্ধের ট্রেঞ্চে কাজ করেছেন গাউন, স্কার্ট পরে। কোকোর পরেও শাড়ি, সালোওয়ার কামিজ, মেখলা পরে মাঠে-ঘাটে, রাস্তায়, বাড়িতে নিয়মিত কাজ করছেন শ্রমিকরা। কিন্তু কাজের সুবিধামতো পোশাক নির্বাচনের অধিকার মেয়েদের জন্য শুরু করেছিল কোকোর ডিজাইন। এই অধিকার শ্রমের সমানাধিকারের দিকে প্রথম পদক্ষেপগুলির মধ্যে অন্যতম।

কোকো শ্যানেল

বর্তমানে ফরাসি ফ্যাশন আর প্যারিসিয় ফ্যাশন সমার্থক হয়ে উঠেছে। “Chic à la Parisienne” — প্যারিসিয় অনায়াস সৌন্দর্য ও আভিজাত্যের  প্রতীক। প্যারিসে জন্ম নেওয়া এই চিরন্তন নান্দনিকতা আজ বিশ্ব ফ্যাশন ও সংস্কৃতিতে বিপুল প্রভাবশালী, যা সূক্ষ্মতার পরিচায়ক, পরিশীলিত স্বতঃস্ফূর্ততার প্রকাশ। শুধু ফ্যাশন নয়, এই রীতিতে ফুটে ওঠে আত্মবিশ্বাস। এ একধরনের 'আর্ট অফ লিভিং'। প্যারিসবাসীরা ক্ষণস্থায়ী ট্রেন্ডের চেয়ে কালজয়ী  নিখুঁত কাটের পোশাককে প্রাধান্য দেয়। উন্নত মানের উলের একটা কোট, একটি শর্ট ব্ল্যাক ড্রেস, ওয়েল ফিটেড ট্রাউজার্স আর রেশমের শার্ট — এগুলি আলমারিতে থাকলেই হলো। আর কিছু চাই না।

এই মিনিমালিজম লক্ষণীয় পোশাকের রঙ নির্বাচনেও— ক্লাসিক রঙ যেমন কালো, সাদা, ধূসর, বেইজ ও নেভি এইসব আলমারিতে প্রাধান্য পায়।  অ্যাক্সেসরিজ পরিমিত — কখনই মাত্রাতিরিক্ত নয়। সিল্ক স্কার্ফ, সূক্ষ্ম অলংকার, ছোট হ্যান্ডব্যাগ বা ক্লাসিক জুতো — এসব ছোট উপকরণ যে কোনও সাজকে অনন্য করে তোলে। মেকআপ সাধারণত নামমাত্র — ত্বকের যত্ন থাকবে নিয়মিত, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, সামান্য পারফিউম!

নিজের চেহারা ও পোশাকে স্বস্তি খোঁজার অভ্যাসকেই তুলে ধরে প্যারিসিয়ানরা। তাঁদের আত্মবিশ্বাস ফুটে ওঠে হাঁটার ভঙ্গি, চোখের চাহনি ও চলাফেরার সহজতায়। অর্থাৎ, লুই চতুর্দশের জাঁকজমকপূর্ণ ‘আমায় দেখো’ ফ্যাশন থেকে নীরব মুগ্ধতায় উত্তরণ ঘটেছে ফরাসি ফ্যাশনের।

প্যারিস ফ্যাশন

সাজগোজের এই মিনিমালিস্ট ধরনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বাঙালি বাড়িতে। প্রথম পরিচয় বলা ঠিক না, দৈনন্দিন ওঠাবসার মাধ্যমে আত্মস্থ করা। বাঙালি ফ্যাশনের ইতিহাস নিয়ে লিখতে গেলে এ লেখা অবান্তর লম্বা হবে। জানা কথার পুনরাবৃত্তি হবে। বাঙালির ফ্যাশন যে লাল-সাদা শাড়ি, বড় টিপ ও কাজলে সীমাবদ্ধ নয়, তা উত্তর ভারত আর বলিউড না জানলেও বাঙালি জানে। অন্তত, বাঙালি জানত।

একজন বাঙালিকে যে কোনও ভিড়ের মধ্যে চিনে ফেলা যেত শুধুই বাঙালির ফ্যাশন সচেতনতার  জন্য, যে ফ্যাশনের ইতিহাসে মিশে রয়েছে বাঙালির দৈনন্দিন জীবনযাপন। সম্প্রতি কান্‌ চলচ্চিত্র উৎসবে শর্মিলা ঠাকুরের সাজ যাদের পছন্দ হয়েছে তাঁরা বুঝবেন আমি একথা কেন লিখলাম।

আরও পড়ুন- কেন এত জনপ্রিয় ফরাসি চুম্বন?

বাঙালির পোশাক ইতিহাস, রেনেসাঁ, ঔপনিবেশিকতা, জ্ঞানদানন্দিনী, রবীন্দ্রনাথ, শিল্প, সাহিত্য এবং সিনেমার সঙ্গে জড়ানো এক বহমান সাংস্কৃতিক সংলাপ। তথ্য দিয়ে লেখা না ভরিয়ে আজ বরং নিজের জীবনে পাওয়া বাঙালি ফ্যাশনের কথা লিখি। যার সঙ্গে, ব্যক্তিগতভাবে, প্যারিসিয় ফ্যাশনের দর্শনগত মিল পাই।

বাঙালির ফ্যাশনে জড়িয়ে আছে নিয়ম-কানুন, যাকে অনেকে ঐতিহ্য বলবে। এক-এক বাড়ির এক-এক নিয়ম, তার আর্থসামাজিক জাতিগত অবস্থান মেনেই সেসব নিয়ম। অতএব, আমার বাঙালি ফ্যাশন সচেতনতায় মিশে রয়েছে আমার অবস্থানগত প্রিভিলেজ। এ কথা জানি, মানি এবং তা বদলানোর সম্ভাবনা বা প্রয়োজন নেই বলেই আজকের লেখা ব্যক্তিগত। সামগ্রিক নয়। 

গ্রীষ্মকালে বাঙালির পরনে ঢাকাই, কোটা, মসলিন, নরম তাঁত বা মলমলের ব্লক প্রিন্ট। সঙ্গে হাতকাটা বা হলটার নেক ব্লাউজ— যা কোনও আধুনিকতার দেখনদারি নয়, মরসুমি স্টাইল। বাঙালির সাজগোজে এককালে কার্যকারণ সাযুজ্য নজর কাড়ত। শীতকালে স্বভাববশতই তার গায়ে উঠেছে তসর। মা-কে দেখতাম, বাতাসে শীতের আবেশ আসতেই সিল্ক-তসরের শাড়ি নামানো হয়, সঙ্গে মানানসই এয়ারহোস্টেস গলার ব্লাউজ, কনুই অবধি হাতা। চুলে লম্বা বেণি, কখনও খোলা। কানের পাশে চন্দ্রমল্লিকা, কখনও গোলাপ। মায়ের সারা গায়ে লেগে থাকে ল্যাভেন্ডার সাবান আর কমলালেবুর খোসা ডোবানো বডি অয়েলের গন্ধ। যেন এইমাত্র স্নান সেরে উঠলেন। গরমের দিনে সাবান বদলে যায়। মাইসোর স্যান্ডেলের ভুরভুরে চন্দনটাই এক বিস্তীর্ণ প্রসাধন। উৎসব, বিয়েবাড়ি অথবা মনখারাপের বাড়ি, পোশাকের সুর আলাদা। পোশাকের এটিকেট  অন্তর আর আবেগের প্রকাশ। শাড়ি জামা বা প্রসাধন যেন সামাজিক বা অর্থনীতির নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ না হয়, মা বলেন। 

দিদা পরত সাদা শাড়ি, তাঁর সেই ষোল বছর বয়স থেকে। পাড়ে একটু কাজ থাকলে তাঁর খুব পছন্দ, তবে সঙ্গে ব্লাউজটি কারুকার্য্যহীন। নইলে শাড়ির অঙ্গ খুলবে না। বাটিকের শাড়ি হলে, সে যে রঙেরই হোক, ব্লাউজ সাদা হতেই হবে। শাড়ির রঙের সঙ্গে বয়সের ইনসিকিউরিটি মেলাতে শিখিনি দিদাকে দেখে। অনেক কম বয়স থেকে দিদার চুলে পাক ধরেছিল, তা ঢাকার প্রচেষ্টা করতেও দেখিনি।   শখ-শৌখিনতা কেবল দেখানোর জিনিস তো নয়। সর্বাঙ্গসুন্দর হবে সাজ। হাতে ঘড়ি, কপালে টিপ, গায়ে চন্দন সাবানের গন্ধ আর মুখ ভর্তি ইয়ার্ডলি ল্যাভেন্ডার পাউডার। হাতে একটা ঢাউস ব্যাগ যার মধ্যে সব আছে, কনুইয়ের ভাঁজে ঝুলিয়ে চলত দিদা। কাঁধে ব্যাগ নিতেও দেখিনি কখনও। এইটুকুই ছিল দিদার সাজ। বেরনোর আগে এক খিলি জর্দা পান; সুগন্ধি ছড়িয়ে কাজে বেরত।

সেই দিদা তাঁর নাতনিকে ধীরে ধীরে পরিচয় করিয়েছে সাজের সঙ্গে। দিদার মতে, ইজেরের পায়ে আর পিছনে ফ্রিল না থাকলে আর বালিকাবেলায় কী বা থাকল! ব্যালেরিনার মতো ফুলে-ফেঁপে হাঁটার তালেতালে ঘুরবে ফ্রকের ঝুল।মোজার শেষে সেলাই করে দিতেন বাহারি লেস। লেসের প্রতি দুর্বলতা ছিল আমার দিদার। জামার সব কলারে লেস। রাগ করতাম, এ কী! একই ফ্যাশন কেন? গালে পান দিয়ে বলতেন, ফ্যাশন নয়, স্টাইল করতে শেখো। নাতনির শাড়ি পরার শখ হলে রঙ মিলান্তি সব শাড়ির সঙ্গে কুরুশ বুনতে বসল দিদা। পেটিকোটের শেষে কুরুশের লেস থাকতেই হবে৷  শাড়ি পরলেই বলতেন, একটু উঁচু করে পরো, নইলে লেসটা দেখা যাবে না যে। দিদিমণির মতো যখন পায়ের উপর পা তুলে বসবে, শাড়ির নীচে দেখা যাবে শখের লেস।

আরও পড়ুন- বাজার করা একটা আর্ট! কাঁচা সবজির বাজারে যেভাবে মিলে যায় বঙ্গ-ফরাসি মন

দাদুভাইয়ের একটি ঘড়ি ছিল, একটি কলম, একটি চশমার ফ্রেম। দাদু আজীবন সরু কালো পাড়, সাদা ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি, শীতকালে কালো শাল। বাবা রোজ সকালে উঠে দাড়ি কাটবেন নিষ্ঠাভরে, বেরনো থাক, না থাক; রবিবার কিছুতেই দাড়ি কাটবেন না, বেরনো থাক, না থাক। এইসব কিছুই তো প্রসাধন, এই সবকিছুই তো মানুষের বাহ্যিক পরিচয়। এক একজনের এক একরকম সৌন্দর্য্যবোধ এবং তাদের সারাজীবন আগলে রেখে লালন করা। এসব নিয়েই এক একটি  মানুষ পৃথকভাবে স্মৃতিতে থেকে যায়। 

প্যারিসিয়ানদের মিনিমাল মেকআপের কথা লিখলাম উপরে— তাদের ত্বক এমনি ঝকঝক করবে প্রসাধন ছাড়া— এমনটা আমি শিখেছি  আমার বাঙালি বড় হয়ে ওঠায়।  আমি যখন ছোট, শনি-রোব্বার সকালে সারা গায়ে সর-ময়দা বা মুসুরডাল-কমলালেবু বাটা বা সর্ষের খোল মাখিয়ে কলতলায় রোদ্দুরে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। আমি বাধ্য মেয়ে, চুপচাপ রোদ খেতাম আর বুঝতে পারতাম, ধীরে ধীরে রূপচর্চার প্রলেপ শুকিয়ে আসছে। এবার মা আসবে, ঘষে ঘষে আধ-শুকনো প্রলেপ তুলে স্নান করিয়ে সুগন্ধী তেল মাখিয়ে দেবে। সেই তেল বানিয়েছে মা নিজেই। ঘানি থেকে শুদ্ধ নারকেল তেল আনিয়ে তার মধ্যে নানা কিছু মেশানো তেলের বয়াম আমাদের বারান্দায় সারি দিয়ে রোদ খেত। কোনওটায় কমলালেবুর খোসা, কাঁচা হলুদ, নিমপাতা— গায়ে মাখার জন্য। আরেকটায় কেশুত পাতা, মেথি, জবা কুঁড়ি — চুলের জন্য। অন্যটায় বাহারি জিনিস, কখনও জলপাই ডুবিয়ে দিশি অলিভ অয়েল, কখনও মেহেন্দি পাতা দিয়ে আরেকটা হেয়ার অয়েল। জনসনস বেবি প্রোডাক্ট দিয়ে শুরু করে আমার ত্বক ও চুলের যত্নের সাপ্লাই আসত মায়ের রান্নাঘর থেকে। রেসিপি আসত সানন্দার পাতা থেকে। স্কুলে সবাই যখন নিত্যনতুন শ্যাম্পু-ক্রিমের গল্প করতে শুরু করল আর আমিও তাল মিলিয়ে ব্যাগমবিলাস, রিঠা দিয়ে মাথা ঘষা (একে শ্যাম্পু করা বলা যাবে না কিছুতেই!) নিয়ে আলোচনায় যোগ দিতে চাইতাম, বন্ধুরা পাত্তা দিত না।

আমাদের ফ্রিজে ছোট ছোট স্টিলের বাটিতে  রাখা থাকত অনাদরের চামড়ায় জৌলুস ফেরানোর জাদু। অলিভ অয়েলে লেবু-চিনি মিশিয়ে সুগন্ধি স্ক্রাব। তারপর মধু দিয়ে ম্যাসাজ। এইসব গাজরের রস, টোমাটোর কাই, আপেল কুরোনো, আমন্ড বাটা, মৌরিবাটার রূপটান বাইরে থেকে করলেই হবে না। করিনা কাপুরের 'অন্দর কি স্নান'-এর আগেই আমার মা শুরু করেছিলেন দৈনন্দিন ডিটক্সিফিকেশন। ঘুম থেকে উঠে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হতো, একদিন চিরতার জল, আরেকদিন ত্রিফলার রস। এরপর এক গ্লাস লেবু-মধু জল, তার পাশে এক টুকরো কাঁচা হলুদ, আদা, চারটে গোটা গোলমরিচ। পাশের আরও একটি ছোট বাটি, তাতে নিমপাতা, ব্রাহ্মীশাক, তুলসিপাতা, আরও কত কী। সঙ্গে এক টুকরো আখের গুড়, যার মিষ্টত্ব কোনওদিন টের পাইনি। কালমেঘের একটা গাছ ছিল মায়ের বাগানে। আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন, "যাও। দুটো পাতা তুলে খেয়ে নাও।" আমিও নির্লিপ্ত মুখে চিবোতাম। 

পাড়ার লোকজন অবশ্যই ভাবত, কালো মেয়েকে ফর্সা করার তাগিদে মায়ের এত আয়োজন। পাশের বাড়ির দিদা একমাত্র বুঝেছিলেন, এটা প্যাম্পার করা। দিদা বারান্দা থেকে মায়ের কাণ্ডকারখানা দেখে বলতেন, "তোমার মেয়ের বেগমবিলাস!" আর, মা আমার কানে কানে মন্ত্র পড়ার মতো বলে যেত, ফর্সা করার জন্য নয়, নিজের যত্ন নেওয়ার জন্য এগুলো করতে হয়। নিজের যত্ন নিলে মন ভালো থাকে! আমার বাঙালি মা আমাকে সারাজীবন এইভাবে শিখিয়েছে সেল্ফ-কেয়ার। সেল্ফ-কেয়ার আমার কাছে বাঙালি ফ্যাশনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। 

কান্‌ চলচ্চিত্র উৎসবে শর্মিলা ঠাকুর এবং সিমি গ্রেওয়াল

আরও পড়ুন- বইমেলা নিয়ে কোনও আগ্রহই নেই ফরাসিদের

আজকাল বাঙালি বিয়েবাড়ির ছবিতে সব রঙ একসঙ্গে দেখতে পাই, সব শাড়িতে সব কাজ একসঙ্গে। দেখলে ভয় করে। জামদানি কাজ নিয়ে ছেলেখেলা দেখলে ভয় করে। পঁচিশে বৈশাখে চুলে জুঁইমালা দিয়ে গলায় সাইনবোর্ডের মতো রবিঠাকুরের মুখাবয়বের লকেট দেখলে খুব ভয় করে। নিয়মিত সালঁ-তে ছুটে ত্বকে-চুলে কেমিক্যাল ঢালতে দেখে, অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া আর শরীরচর্চায় অনীহা দেখলে আতঙ্কিত হই। 

প্যারিসের রাস্তায় কিম কারদাশিয়ানের প্রচলিত সোয়েট প্যান্ট আর  জ্যাকেট, বা দুয়া লিপার অনুকরণে ঢাউস ব্লেজার সবার গায়ে দেখলে ভয় করে। কিশোরী ঠোঁটে অহেতুক বোটক্স দেখলে কেঁপে উঠি। নকল চোখের পলকে ফরাসি মেয়েদের দৃষ্টি ঢাকা পড়েছে,  চড়া ফাউন্ডেশনে ঢেকে যাচ্ছে মুখ। সবাইকে একরকম দেখায়, সবার পরনে এক জামা, পায়ে এক জুতো। 

এসব দেখলে ভয় করে। ফ্যাশন বদলানোর ভয় নয়, ভাষা বদলায়, ফ্যাশন বদলায়, সবই আখেরে বদলে যায়— এটাই নিয়ম। তবে, এসবের নেপথ্যে থাকা মূল্যবোধের দ্রুত পরিবর্তন দেখে, নিজের অজান্তে নিজেকে হারিয়ে ফেলার হুজুগ দেখে, সত্যি বেশ ভয় হয়। "কমফর্টেবল ইন মাই ওন স্কিন" প্রবাদ মেনে স্বচ্ছন্দ ফরাসি বা বাঙালি ফ্যাশনের কাছে ফিরতে মন চায়। যে ফ্যাশন কানে ফিসফিস করে সাজের খোঁজখবর দিয়ে রাখবে, তবে  নিজস্ব স্টাইল নির্মাণের পথে শেষ কথা বলবে ব্যক্তিগত রুচি।

More Articles