শ্রীচৈতন্যের জন্ম থেকে মৃত্যু- রহস্য আজও বহমানঃ ১
১৪৮৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি,ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাত। চরাচর ভেসে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার আলোয়। ধরায় আবির্ভূত হলেন অলোকসামান্য দিব্যকান্তি এক শিশু। এই বিস্ময়শিশুই ক্রমে স্মার্ত আস্ফালন আর মুসলমানী শাসনের দোলাচল থেকে কৃষ্ণপ্রেমে ক্রমমুক্তির পথ দেখাবেন বাঙালিকে ।আজ পাঁচশো বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর জীবনবোধ,ভক্তি আন্দলনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে নিরলস গবেষণা করে চলেছেন বিশ্রুত গবেষক বিদগ্ধ অধ্যাপকগন। তবু তাঁকে চেনা যেন ফুরোয় না। জিজ্ঞাসু মন ডুব দিতে চায় অজানা খবর সন্ধানে।অস্থিরমতি বালক নিমাই-এর চৈতন্য হয়ে ওঠার পেছনে কারিগর কারা? পাঁচশো বছর পরেও নেপথ্যে রয়ে গেলেন কোনজন?চৈতন্যের লীলা সংবরনের বিষয়ে আজও এত ধোঁয়াশা কেন? এই ধরনের শত প্রশ্নের জন্ম হয় চিদাকাশে। অন্বেষণ যতই বাড়ে,তাঁর স্বরূপ ততই প্রকাশিত হয়। সামান্য অচর্চিত বিষয়গুলিতে আলোকপাতই এই নিবন্ধের গন্তব্য,অনুরাগের ভ্রমণ।
ভক্তিপথের পান্থজন যাঁরা
চৈতন্যের জন্মসময়ে ব্রাহ্মন্যধর্মের শক্তিবৃদ্ধি,বৈশ্য শ্রেণির আর্থিক প্রতিপত্তি বৃদ্ধি (চাঁদ সদাগর,ধনপতি এর উদাহরন) সমান্তরালে চললেও শূদ্রশ্রেণি চিরাচরিত বর্ণাশ্রম প্রথার অভিশাপ বয়েই বেড়াচ্ছিল। তখনও তারা অস্পৃশ্য।চৈতন্যই প্রথম মানবিক যুগপুরুষ যিনি ব্রাহ্মণ চণ্ডাল ধনী দরিদ্র সকলকে এক বলয়ে নিয়ে এলেন বৈদান্তিক নিয়মকানুনকে নস্যাৎ করে। কিন্তু এই বিপ্লব একদিনে সংঘটিত হয়নি। বাংলাদেশের প্রেমের পথে ঈশ্বরপ্রাপ্তির তত্ত্বের জমি আবাদ শুরু হয়েছিল চৈতন্য জন্মের কয়েক যুগ আগেই। সবার আগে নাম নিতে হয় লক্ষ্মীপতি পুরী ও মাধবেন্দ্র পুরীর। মাধবেন্দ্র পুরীকে বৃদ্ধাবস্থায় বীজমন্ত্র দান করেন লক্ষ্মীপতি পুরী।মাধবেন্দ্র পুরী স্বপ্নাদেশ পেয়ে গোপাল বিগ্রহের জন্য চন্দন আনতে ছুটলেন বৃন্দাবন থেকে নীলাচল।অজ্ঞাত কোনও কারণে তিনি নীলাচল যাওয়ার আগে কিছুকাল শান্তিপুরে অবস্থান করেন। শান্তিপুর নিবাসী অদ্বৈত আচার্য্যের অন্তরে কৃষ্ণপ্রেমের যে ফল্গুধারা,তার বীজ হয়ত তিনিই বপন করেছিলেন।আবার এই মাধবেন্দ্র পুরীরই শিষ্য ঈশ্বরপুরী, গুরুর মৃত্যুসংবাদ নিয়ে যাবেন অদ্বৈত আচার্য্যের আশ্রমে। প্রথম দেখাতেই কিনি নেবেন নববৈষ্ণব নেতাকে যাকে তিনি খুঁজছিলেন কত না বছরকাল।
অদ্বৈত আচার্য্য প্রথম থেকেই বালক নিমাইয়ের লক্ষনগুলো ধরতে পারতেন। নিমাইয়ের দাদা বিশ্বরূপের তন্ময়ভাব,পাঠে একাগ্রতা আর উল্টোদিকে অস্থিরমতি ঈষৎ অহংকারী নিমাইকে দেখে প্রাথমিক ভাবে তিনি বিশ্বরূপকেই বেশু সম্ভাবনাময় ভাবতেন,কিন্তু তাঁকে বিস্মিত করত নিমাইয়ের অদ্ভুতুড়ে কর্মকাণ্ড। একবার পিতা পাঠশালা যাওয়া বন্ধ করে দিলেন নিমাই শ্মশান থেকে হাঁড়ি কুড়িয়ে এনে তার ওপর বসে রইল। বিশ্বরূপ অল্প বয়সে সন্ন্যাস নিলে অদ্বৈতের আশাভঙ্গ হল।নিমাই হয়ে দাঁড়ালো তাঁর হাতের পাঁচ,আশার মর্মস্থলের একমাত্র আলোকবর্তিকা। এই অদ্বৈতই তো চৈতন্যকে বাতলে দিচ্ছেন ভবিষ্যতের কর্মযোগ,বলছেন-“যদি ভক্তি বিলাইবা/স্ত্রী শূদ্র আদি যত মূর্খেরে সে দিবা”।
শ্রীবাসের কথাও বলতে হয়।ব্রাহ্মণত্বকে একরকম অস্বীকার করে সে ঘরের দ্বার বন্ধ করে কৃষ্ণনাম সংকীর্তনে ব্রতী। অর্থাৎ ভক্তির মার্গ প্রস্তুত ছিল,দরকার ছিল এক পতাকাবাহক। অদ্বৈত ঈশ্বরপুরী শ্রীবাসরা সেই নেতাকে তৈরি করেছে সযত্নে।
তমেব বন্ধু সখা তমেব
নিমাই এর বন্ধুভাগ্য ছিল তুলনারহিত। আমৃত্যু তিনি সমপ্রান সখার সঙ্গ পেয়েছেন বারেবারে।আসলে বিরাট হৃদয়বত্তা,সকলের সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতাই তাকে বন্ধুমহলে জনপ্রিয় করে তুলেছে।ছোট থেকেই উচ্চ-নীচ জ্ঞান না করে বন্ধু বানিয়েছেন শূদ্রপাড়ায়। বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে নাকি শর্ত দিয়েছিলেন শূদ্রপাড়ার বন্ধুবান্ধবদের নিমন্ত্রণ করতে হবে। আর এই বিয়ের যাবতীয় খরচও কিন্তু যুগিয়েছিলেন তাঁরই এক বন্ধু বুদ্ধিমন্ত খান। দাদার সন্ন্যাস এবং পিতার মৃত্যুর ফলে নিমাইয়ের পরিবার যখন সামান্য বেকায়দায়,তাঁকে একটা টোল করে দিলেন নিজের বাড়ির দাওয়ায় মুকুন্দ সঞ্জয়।
গুরু মেলে যথা তথা/শিষ্যর মত শিষ্য কোথা
শিষ্য যদি অসমর্থ হয়,অনুজ্জ্বল হয়, গুরুর কৌলিন্য হ্রাস পায়। চৈতন্যকে বুঝতে গেলে দেখতে হবে তাঁর শিষ্যদের,জানতে হবে তাঁদের আচরন,ভাবাদর্শ।কারন চৈতন্য নিজে কিছুই লিখে যাননি,তার শিষ্যদের মধ্যে ছেড়ে গেছেন তার স্বতন্ত্র মহৎ লক্ষনগুলো। নিত্যানন্দের কথায় আসা যাক। বৈষ্ণব সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা চৈতন্যের তুলনায় কোনও অংশেই কম নয়। ডাকাবুকো স্বভাব,জীবনযাত্রার নানা বৈচিত্র্যের জন্য তিনি রঙিলা ঠাকুর নামে সমাদৃত। নিত্যানন্দের যখন ১২ বছর বয়স,এক অবধূত সন্ন্যাসী নিত্যানন্দের বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য অবস্থান করেন।তিনি যাবার সময় নিত্যানন্দের মা তাঁকে অর্ঘ্য দিতে চাইলে তিনি নিত্যানন্দকেই চেয়ে বসলেন। মায়ের সম্মান বলে কথা। সেই দ্বাদশবর্ষীয় বালক ধরণীর ধুলো পায়ে মেখে বেড়িয়ে পড়ল। গোটা দেশ ঘুরেছেন,দীক্ষা নিয়েছেন অবধূত মার্গে।অনেক পরে তিনি চৈতন্য সঙ্গ শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে অবধূত শব্দের অর্থ ব্যক্ত করা জরুরি। তন্ত্রের সবকটি সাধনস্তরে সিদ্ধ হয়েছেন এবং এক জায়গায় স্থিত না হয়ে ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনিই অবধূত। অন্য দিকে তন্ত্রসিদ্ধ গৃহী পরমহংস। যাই হোক,নিত্যানন্দের দক্ষিন ভারত অভিজ্ঞতা চৈতন্যের দক্ষিন ভারত ভ্রমনে সাহায্য করেছে।এই নিত্যানন্দকেই কলসি ছুঁড়ে মারছে জগাই-মাধাই। আবার পরে এরাই সুহৃদ-সতীর্থ।
আসবে শ্রীধরের কথা। বাজারে মোচা কলা বিক্রেতা শ্রীধর চৈতন্যের ভাবে ভাবুক হয়ে থাকেন সর্বক্ষণ। কূটলোক বলে “বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়”। শ্রীধর নীরব হয়ে থাকেন। আর হরিদাসকে যে কত যন্ত্রণা সইতে হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।বাইশটি বাজারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেত মারা হয়েছে তাঁকে।হরিদাস প্রতিজ্ঞায় অবিচল। মৃত্যুকালেও প্রভুর কানে বলে যাচ্ছেন, জন্মে জন্মে যেন তোমার দেখা পাই।
সম্রাট হুসেন শাহ্’র দুই কর্মচারী সাকার মল্লিক ও দাবির খাস (মূল নাম অমর ও সন্তোষ)পাপ ধুয়ে ফেলতে শরণাগত হচ্ছে চৈতন্যের। তারাই চৈতন্যে অপত্য স্নেহের রূপ-সনাতন। উৎকলপতি প্রতাপরুদ্র অত বড় উৎকল সাম্রাজ্যের একাধিশ্বর পড়ে রয়েছেন সামান্য একটা গম্ভীরায় কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর হয়ে পড়ে থাকা চৈতন্যের পদতলে, কোন চুম্বকে-ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়।
আরও পড়ুন - শ্রীচৈতন্যের জন্ম থেকে মৃত্যু- রহস্য আজও বহমানঃ ২
চরিতাকারের জীবনচরিত
চৈতন্য জীবনীকারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় কৃষ্ণদাস কবিরাজ এবং বৃন্দাবন দাস। চৈতন্যচরিতামৃত,চৈতন্যভাগবৎ,চৈতন্যচর্চার অন্যতম আকারগ্রন্থ। নিত্যানন্দের মাহাত্ম্য নিয়ে ভাইদের সাথে মতান্তর হওয়ায় ঘর ছাড়েন কৃষ্ণদাস।বৃন্দাবনে রূপ সনাতন তাঁকে আশ্রয় দেয়। রূপ সনাতন কিছুকাল নীলাচলে অবস্থান করলে কৃষ্ণদাসও তাঁদের সঙ্গী হন এবং চৈতন্যের দেখা পান। মহাপ্রভু তখন স্থির করেছেন দক্ষিন ভারত যাবেন এবং একা যাবেন। প্রমাদ গুনলেন নিত্যানন্দ ও অন্যান্য পারিকরেরা। তাঁকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তার নিত্যকর্মের সুবিধার জন্য কেলেদাস নামক এক যুবাকে তাঁর সঙ্গে ভিরিয়ে দেওয়া হয়। এই কেলেদাসই চৈতন্যচরিতামৃতের কৃষ্ণদাস কবিরাজ। ফলে কৃষ্ণদাসের বর্ণনার সজীবতা সন্দেহাতীত। তিনি অনেক বেশি বয়সে এই কাব্য লেখা শুরু করেন। চৈতন্যের তিরোধান ধরে নেওয়া হয় ১৫৩৪ সালে আর চৈতন্যচরিতামৃতের রচনাকাল মোটামুটিভাবে ১৫৬৫-১৫৮০। আবার চৈতন্যের থেকে প্রায় ১২ বছরের বড় হয়েও চৈতন্যের দেখা পাননি বৃন্দাবন দাস। বৃন্দাবন দাস নারায়ণীর গর্ভজাত সন্তান। নারায়ণী শ্রীবাসের ভাইঝি। কথিত আছে ছোটবেলায় চৈতন্যের উচ্ছিষ্ট খেয়েছিলেন তিনি, এভাবেই নাকি গর্ভবতী হন। নানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। বৃন্দাবন দাসের লেখনীর তাঁর মায়ের ভাষ্য,নিত্যানন্দের সাহচর্য। আবার তিনি বলেছেন শ্রীবাসের আশীর্বাদ নিয়ে তিনি লেখা শুরু করেন। অর্থাৎ শ্রীবাসের ব্যাপক অভিজ্ঞতাও তাঁর লেখনীর অলঙ্কার হয়ে উঠেছিল নিশ্চয়ই।
কিন্তু বৃন্দাবন দাস কেন পূজ্যপাদ পরমপ্রভুর দেখা পেলেন না? সে এক ট্র্যাজিক গল্প। স্থির হয়েছে নিত্যানন্দের সাথে নীলাচলে মহাপ্রভুর কাছে যাবেন বৃন্দাবন দাস। দুপুরের খাওয়া শেষ করে রওনা দেবেন এমন অভিপ্রায়। নিত্যানন্দ বৃন্দাবনকে বললেন, মুখশুদ্ধির প্রয়োজন।বৃন্দাবন নিত্যানন্দকে তার পরের দিনের সংগ্রহ থেকে কিছু হরতকি দিলেন।নিত্যানন্দ সেই হরতকি হাতে নিয়ে ভাবলেন, বৃন্দাবনের এখনও সঞ্চয় মোহ কাটেনি। ব্যস, মহাপ্রভুর সাহচর্য থেকে বঞ্চিত হলেন বৃন্দাবন দাস। তাঁকে পথে ফেলেই এগিয়ে গেলেন নিত্যানন্দ।
শ্রীচৈতন্যের মৃত্যুর দু-এক বছরের মধ্যেই রচিত হয় চৈতন্যভাগবৎ (১৫৩৫-১৫৩৬ সালে)। সুকুমার সেন বলেছেন, “বৃন্দাবন দাসের মতে শ্রীচৈতন্য কৃষ্ণ-বিষ্ণুর অবতার। কৃষ্ণদাসের মতে শ্রীচৈতন্য কৃষ্ণ-রাধার একাত্মমূর্তি রুপে আবির্ভূত। আসলে কৃষ্ণ ও রাধা অভেদ অখণ্ড ব্রহ্ম বা পরমাত্মা”।