এখনও লেগে আছে যিশু খ্রিস্টের রক্তের দাগ! শ্রাউড অফ তুরিন কি সত্যিই ইতিহাস, না স্রেফ মিথ?
Shroud Of Turin Jesus Christ : অবয়বটির লম্বা চুল রয়েছে, সঙ্গে দাড়ি। হাত দুটো পেটের কাছে রাখা। দুটো হাত আর পায়ের পাতায় কীসের একটা ক্ষতচিহ্ন!
লম্বায় ১৪ ফুট ৩ ইঞ্চি, চওড়ায় প্রায় সাড়ে তিন ফুটের একটি কাপড়। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হবে, সামান্য গায়ে দেওয়ার কাপড়। রং অনেকটা ফিকে হয়ে গিয়েছে, যা দেখে মনে হয় এই চাদর অনেক পুরনো। কিন্তু সেটিকেই ভালোভাবে সংরক্ষণ করে, ভক্তিভরে রাখা হয়েছে! কী বিশেষত্ব রয়েছে সেই কাপড়ে?
এবার একটু ভালোভাবে খেয়াল করা যাক। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, বড় কাপড়টির গায়ে আবছা একটা অবয়ব ফুটে রয়েছে। কালের স্রোতে বাদামি হয়ে ক্রমশ ফিকে হয়ে গিয়েছে এই অবয়ব। কিন্তু কার? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, অবয়বটির লম্বা চুল রয়েছে, সঙ্গে দাড়ি। হাত দুটো পেটের কাছে রাখা। এবং দুটো হাত আর পায়ের পাতায় কীসের একটা ক্ষতচিহ্ন। কাপড়ের উল্টো পিঠেও রয়েছে সেই মানব অবয়বের চিহ্ন। খ্রিস্ট ধর্মের যাজকদের বিশ্বাস, এই অবয়ব আসলে আরও কারও নয়; খোদ যিশু খ্রিস্টের! সেখান থেকেই শুরু হয় তুরিনের চাদর বা শ্রাউড অফ তুরিনের (Shroud of Turin) যাত্রাপথ।
আরও পড়ুন : অযোধ্যার রামমন্দিরে ৬ কোটি বছরের পুরনো শালগ্রাম! ইতিহাস নাকি মিথ?
বিস্তারিত সার আগে একবার বাইবেলের কাহিনির ভেতর ঢোকা যাক। যিশু খ্রিস্টকে তখন বন্দি করা হয়েছে। চাবুকের ঘা মেরে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মৃত্যুদণ্ডও ঘোষণা করা হয়েছে। সেটি ছিল সাব্বাথের আগের দিন। গল পাহাড়ে দুই অপরাধীর সঙ্গে ক্রুশকাঠে বিদ্ধ করা হল যিশুকে। সন্ধ্যা হওয়ার মুখে তিনি প্রাণত্যাগ করেন। তারপরই পিলাতের কাছে যিশু খ্রিস্টের মরদেহ চাওয়া হয়। তারপর মূল্যবান কাপড় এনে যিশুর রক্তাক্ত মৃতদেহ ভালো করে জড়িয়ে তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়। পাহাড়ের একটি গুহায় তাঁর কাপড়ে মোড়া দেহটি রেখে মুখটি পাথর দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। তিনদিন পর সেখানে গিয়ে দেখা যায়, রক্তে ভেজা সেই কাপড় গুহার ভেতরেই পড়ে রয়েছে। কিন্তু যিশুর দেহ কোথাও নেই! তারপরই শুরু হয় যিশুর পুনরায় জেগে ওঠার ঘটনা… দ্য রেজারেকশন অফ জেসাস।
এখান থেকেই শুরু হয় শ্রাউড অফ তুরিনের কাহিনি। প্রচলিত বিশ্বাস হল, যে কাপড়ে মুড়ে যিশুর রক্তাক্ত দেহ কবর দেওয়া হয়েছিল, সেটাই আসলে তুরিনের চাদর। ওই পুরনো হয়ে যাওয়া কাপড়ে যে হালকা অবয়ব ফুটে উঠেছে, সেটি আসলে যিশুরই মরদেহের ছবি। বাদামি হয়ে যাওয়া দাগগুলি নাকি রক্তের নিশান! এমনকী যাজকরা বলেন, ভালো করে দেখলে হাতের পাতায় পেরেকের ক্ষতও দেখা যাবে। এই মুহূর্তে ইতালির তুরিন শহরের সান জিওভানি বাতিস্তা ক্যাথিড্রালের রয়্যাল চ্যাপেলে সংরক্ষিত আছে এই বিশেষ কাপড়। ১৫৭৮ সাল থেকে এখানেই রয়েছে এটি। তবে তার আগে বহুবার হাতবদলও হয়েছে।
১৩৫৪ সালে প্রথমবার প্রকাশ্যে আসে শ্রাউড অফ তুরিন। উল্লেখ্য, সেটি ছিল মধ্যযুগ। বিখ্যাত নাইটরা তখন ইউরোপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁদেরই দুজন ছিলেন জিওফ্রে দে চার্নয় এবং সেনিওর দে লিরে। তাঁদের হাত ধরেই প্রথমবার সামনে আসে শ্রাউড অফ তুরিন বা তুরিনের চাদর। কয়েক বছর পর ১৩৮৯ সালে এটি প্রথমবার জনসমক্ষে প্রদর্শিত হয়। কিন্তু প্রথমদিকে অনেকেই এর সত্যতা মানতে রাজি হননি। পরে অবশ্য ভ্যাটিকান সিটি এবং খ্রিস্ট ধর্মের যাজকরা শ্রাউড অফ তুরিনকে ঐতিহাসিক, ধর্মীয় নিদর্শন বলে উল্লেখ করেন।
আরও পড়ুন : ‘আত্মা’ এখনও আসে ফিরে? পর্যটকদের কেন টানে ভৌতিক রহস্যে মোড়া সিকিমের বাবা মন্দির!
অবয়বের দুই পাশে বিশেষ কিছু দাগও লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি আসলে পোড়া দাগ। ১৪৫৩ সালে চ্যামবেরির হাউজ অফ স্যাভয়ে এটি সংরক্ষণ করে আখা হয়েছিল। ১৫-শ শতকে সেখানে আগুন লেগে যাওয়ায় শ্রাউড অফ তুরিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশকিছু জায়গা পুড়ে যায়। অবয়বের পাশে থাকা দাগগুলি সেই স্মৃতিই বহন করছে বলে ঐতিহাসিকদের মত। এর আগেও বেশ কয়েকবার তুরিনের চাদরটি প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছিল। ভ্যাটিকান এবং খ্রিস্টানদের ধর্মীয় মহলের দাবি, এটি ঐতিহাসিক। এবং, এটিই যিশু খ্রিস্টের চিহ্ন বহন করছে। এই কাপড়েই লেগে রয়েছে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর রক্তের দাগ।
কিন্তু যুগ যুগ ধরে শ্রাউড অফ তুরিন নিয়ে একের পর এক গবেষণা চলেছে। এখনও সেই পরম্পরা শেষ হয়নি। ঠিক কী এই তুরিনের চাদর? ঐতিহাসিক ও গবেষক মহলে বারবার উঠে এসেছে নানা তত্ত্ব। আদৌ কি এটি দিয়েই যিশু খ্রিস্টের দেহ মুড়ে রাখা হয়েছিল? সেই চাদর এতদিন ধরে টিকেও রয়েছে? অনেকেই এই চাদরের মিথকে সরাসরি অস্বীকার করেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ডেভিড অ্যাকিনসন। তাঁর দাবি, এই চাদরে মোটেও যিশুর দেহ জড়ানো ছিল না। তবে চাদরটি নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক।
কেন? তিনি বলেছেন, এই উত্তর পেতে ফিরে যেতে হবে মধ্যযুগে। সেই সময় ইউরোপ ও মধ্য প্রাচ্য জুড়ে চলছে ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড। সেই সময় ইউরোপ, জেরুসালেম, ইজরায়েলের বুকে থাকা অসংখ্য জিনিস সংরক্ষণ করা হচ্ছিল। সেগুলো লুকিয়ে গুপ্ত জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এই বিষয়ের কিছুটা নমুনা দেখা যাবে ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ সিনেমা ও বইয়ে। সেই সময় নাইটরা খ্রিস্ট ধর্মের বেশকিছু রহস্যজনক জিনিস লুকিয়ে নিয়ে যান পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। বিভিন্ন মূর্তিও নিয়ে যাওয়া হয়। তারই মধ্যে একটি ছিল কিং ফিশারের মূর্তি।
এই কিং ফিশার আসলে নাইট টেম্পলারদের প্রধান ছিলেন। অ্যাকিনসনের মতে, ওই মূর্তিটিকেই এই বিশেষ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। ভঙ্গুর পাথরের তৈরি ওই মূর্তির ছাপই লেগে যায় ওই কাপড়ে। তাকেই পরবর্তীকালে যিশুর মরদেহের কাপড় বলে প্রচারের আলোয় আনেন খ্রিস্টান যাজক ও পোপরা। তার বক্তব্যের স্বপক্ষে একটা অন্য যুক্তিও দেওয়া যায়। যিশুর যে ছবি আমরা গির্জায় দেখি, সেটি যে আসল নয়, সেটা ইতিমধ্যেই অনেক নৃতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক বলেছেন। এই পুরো ছবিটাই রোমানদের তৈরি করা। শ্রাউড অফ তুরিনে যে অবয়বটি রয়েছে, সেটিও অনেকটা যিশুর সেই প্রতিকৃতির মতোই। তাই অনেকেই এটির বৈধতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
আরও পড়ুন : ২৫ ডিসেম্বর যিশু নয়, জন্ম হয়েছিল অন্য কারোর, কোন অজানা সত্য লুকিয়ে বড়দিনের উৎসব ঘিরে?
এছাড়াও কার্বন ডেটিং করে জানা গিয়েছে, এই বিশেষ কাপড়টি ১২৬০ থেকে ১৩৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরি করা। কাজেই যিশুর মৃত্যুর সময়ের কাপড় এটা হতেই পারে না। তাছাড়া ওই কাপড় খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে, তার নমুনা নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করে বেশকিছু তথ্য পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেখানে বলা হচ্ছে, শ্রাউড অফ তুরিনের এই কাপড়ে এমন বেশকিছু উদ্ভিদের ডিএনএ পাওয়া গিয়েছে, যা ওই সময়ের ইউরোপে পাওয়া যেত না। সেগুলো মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এসেছে। এমনকী, তুরিনের চাদরে অনেকগুলো মানব ডিএনএ-ও পাওয়া গিয়েছে; যা প্রমাণ করে, বহু মানুষের হাত ঘুরে এই কাপড় ইউরোপে এসেছিল। আর এই সমস্তটাই ইঙ্গিত করছে মধ্যযুগের ওই বিশেষ সময়টিকে।
তবুও কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। এখনও বহু মানুষ শারুড অফ তুরিনকেই যিশু খ্রিস্টের মৃতদেহের কাপড় বলে বিশ্বাস করেন। প্রদর্শনীর সময় এটি দেখার জন্যই ভিড় জমে। রহস্য, মিথ আর বিজ্ঞান- সব মিলিয়েই এক আস্ত নিদর্শন হয়ে তুরিন শহরের ক্যাথিড্রালে রয়েছে এই বিশেষ কাপড়টি।