মোদির নিজ রাজ্য এত উন্নত হলে কেন আমেরিকায় পালাচ্ছেন গুজরাতিরা?
Narendra Modi Gujarat: প্রতি ঘণ্টায় ১০ জন ভারতীয় বেআইনিভাবে আমেরিকায় প্রবেশের চেষ্টা করেন যার মধ্যে ৫ জন গুজরাতি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির পরম মিত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হবার পর তিন দফায় ৩৩২ জন ভারতীয়কে শেকলে বেঁধে সামরিক বিমানে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ভারতে পাঠানোর বিষয়টি ইতিমধ্যে বহু আলোচিত। এই জাতীয় লজ্জার ছবিটি ভাইরাল হলেও তুলনায় অনালোচিত থাকছে আরেকটি লজ্জার ছবি। 'বেআইনি' অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা থেকে এটা পরিষ্কার যে এই ভারতীয়দের মধ্যে একটা বড় অংশ হলো গুজরাতি। এই তথ্য কর্পোরেট মিডিয়া নির্মিত ও আমাদের অনেকের দ্বারা সযত্নে লালিত গুজরাত মডেল ও ডাবল ইঞ্জিন সরকারের প্রকৃত চেহারাটা সামনে এনে দিয়েছে। মোদ্দা কথা হলো, গুজরাতের বহু মানুষ আজ ভালোভাবে বাঁচার স্বার্থে গুজরাত থেকে পালাতে চাইছে। এইবারের ছবিটার বহু আগে একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে যাতে কানাডা ও মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে কোনও বৈধ কাগজপত্র ছাড়া আমেরিকায় প্রবেশ করতে গিয়ে বহু গুজরাতি প্রাণ হারিয়েছেন। এই বক্তব্যর সপক্ষে কিছু ঘটনার উল্লেখ করা জরুরি:
১। ২০২২ সালে গুজরাতের দিনগুছা গ্রামের বাসিন্দা জগদীশ প্যাটেল ও তাঁর পরিবারের বাকি তিন সদস্য কানাডা সীমান্ত দিয়ে আমেরিকায় প্রবেশ করতে গিয়ে প্রচণ্ড ঠান্ডায় বরফে জমে মারা যান।
২। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে গান্ধীনগরের কালোল জেলার এক পরিবারের চার সদস্য দক্ষিণ মানিটোবার রাস্তায় তুষারপাতের কারণে মারা যান।
৩। ২০২৩ সালের জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে গুজরাতের মেহসানার একটি পরিবারের চার সদস্য প্রবীণ চৌধুরী (৫০), স্ত্রী দীক্ষা (৪৫) এবং সন্তান বিধি (২৩) ও মিতকুমার (২০) কানাডা থেকে সেন্ট লরেন্স নদীপথে আমেরিকায় ঢুকতে গিয়ে নৌকাডুবিতে মারা যান।
৪। ২০২৩ সালেই গুজরাতের ব্রিজ কুমার যাদব ও তার পরিবার মেক্সিকো-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সীমানায় (সান দিয়াগো ও তিজুয়ানা পয়েন্টে) দেওয়াল টপকাতে গিয়ে পড়ে মারা যান।
আরও পড়ুন- ধর্ম আর রাজনীতির ককটেলে মোক্ষ নয় ‘মৃত্যুফাঁদ’ মোদির ভারত!
তালিকা দীর্ঘ না করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র দফতরের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে এটুকু বলা যায় যে, আন্তর্জাতিক দালাল চক্রের সহায়তায় প্রতি বছর বহু মানুষ কোটি কোটি টাকা দিয়ে তুরস্ক-মেক্সিকো ও কানাডার পথে পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই মার্কিন দেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। শুধু ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে 'অবৈধ' ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা ছিল ৬৭,৯৩১, যার মধ্যে গুজরাতিদের সংখ্যা ছিল ৪১,৩৩০। বিশিষ্ট গুজরাতি সাংবাদিক বীর সাংভি 'দ্য প্রিন্ট' পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য উল্লেখ করে বলেছেন, প্রতি ঘণ্টায় ১০ জন ভারতীয় বেআইনিভাবে আমেরিকায় প্রবেশের চেষ্টা করেন যার মধ্যে ৫ জন গুজরাতি। এই ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যান স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে গুজরাত দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের সেরা ঠিকানা বলে বিজ্ঞাপিত, যে রাজ্যের দুই বাণিজ্য গোষ্ঠী আজকের জমানায় ভারতের নিয়ন্ত্রক, যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে উন্নয়নের সেরা গ্যারান্টি হিসাবে 'ডবল ইঞ্জিন' সরকার চলছে, সেখানে কেন একটা বড় অংশের মানুষ নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে গুজরাত থেকে পালাতে চাইছেন?
এই অবস্থায় তাই আবার জরুরি হয়ে উঠছে গুজরাত মডেলকে প্রশ্ন করা। একথা অস্বীকার করার কোনও কারণ নেই যে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় হওয়ার কারণে ঐতিহাসিকভাবেই গুজরাতিরা প্রধানত আফ্রিকা ও পরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাসা বাঁধেন কিন্তু সেটা কখনই বেআইনিভাবে বা দারিদ্র্যের কারণে নয়। এই সময়ের ছবিটা কিন্তু একেবারেই আলাদা। বর্তমান গুজরাতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে স্ববিরোধ হলো দেশের মধ্যে গুজরাতের বৃদ্ধির হার ও রাজ্যওয়াড়ি পার ক্যাপিটা নেট স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট সবচেয়ে বেশি। টাকার অঙ্কে হলো ১,৮১,৯৬৩ টাকা (২০২২-২৩), এক্ষেত্রে জাতীয় গড় ৯৯,৪০৪ টাকা। অর্থাৎ গুজরাতের আয় জাতীয় আয়ের দ্বিগুণ। কিন্তু এই আয়ের সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের ভালো-মন্দের কোনও সম্পর্ক নেই। এখানে শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে কম মাইনে পান, দেশের অন্যান্য শিল্পপ্রধান রাজ্যগুলোর চেয়ে। ২০২৪ সালের এপ্রিল-জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী একজন ক্যাজুয়াল শ্রমিকের একদিনের মাইনে কেরলে ৮৩৬ টাকা, তামিলনাড়ুতে ৫৮৪ টাকা, হরিয়ানায় ৪৮৬ টাকা, পঞ্জাবে ৪৪৯ টাকা, কর্নাটকে ৪৪৭ টাকা, রাজস্থানে ৪৪২ টাকা অথচ গুজরাতে মাত্র ৩৭৫ টাকা। এই টাকা দেশের গড় ৪৩৩ টাকার চেয়েও কম। একইসঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, গুজরাতের তথাকথিত শিল্প বিপ্লবের মূল জোগান হলো এখানকার অসংগঠিত শ্রমিক। ২০২২ সালের পিরওডিক লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য অনুযায়ী দেশের মধ্যে গুজরাতে কোনও লিখিত চুক্তি ছাড়া শিল্পে কাজ করে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক। গুজরাতের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা হল ৭৪% যেখানে তামিলনাড়ুতে ৫৩%, কেরলে ৫৩%, মধ্যপ্রদেশে ৫৭%, হরিয়ানায় ৬৪%, মহারাষ্ট্রে ৬৫% এবং বিহারে ৬৮%।
এমনকী গুজরাতে স্থায়ী চাকরির শ্রমজীবী মানুষের গড় মাইনে দেশের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে কম। ২০২৪ সালের এপ্রিল-জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী কর্নাটকে মাস মাইনে ২৫,৬২১ টাকা, হরিয়ানায় ২৫,০১৫ টাকা, মহারাষ্ট্রে ২৩,৭২৩ টাকা, কেরলে ২২,২৮৭ টাকা, অন্ধ্রপ্রদেশে ২১,৪৫৯ টাকা, তামিলনাড়ুতে ২১,২৬৬ টাকা। অথচ গুজরাতে এই টাকার পরিমাণ ১৭,৫০৩ টাকা যা পশ্চিমবঙ্গের (মাসিক ১৭,৫৫৯ টাকা) চেয়েও কম। এক্ষেত্রে সারা দেশের গড় ২১,১০৩ টাকা।
গুজরাতের গ্রামীণ অঞ্চলের ছবিটাও আলাদা কিছু নয়। ২০২৩ সালের হিসাব বলছে, এই রাজ্যে একজন কৃষি মজুরের মজুরি দৈনিক ২৪২ টাকা যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম। কারিগরদের (আর্টিজান) দৈনিক মাইনে ২৭৩ টাকা যা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় নিম্নতম, এর আগে আছে মধ্যপ্রদেশ, দৈনিক ২৪৬ টাকা, অথচ বিহারে ৩১৩ টাকা। এমনকি নির্মাণ শিল্পের দৈনিক মজুরি ৩২৩ টাকা।
এই কম মজুরির প্রভাব গুজরাতের সাধারণ মানুষের খরচ করার ক্ষমতাতে স্পষ্টভাবে পড়ছে। ২০২২-২৩ সালের ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের হিসাব অনুযায়ী, মান্থলি পার ক্যাপিটা এক্সপেনডিচার (MPCE) অনুযায়ী গুজরাতের শহরে ৬,৬২১ টাকা ও গ্রামে ৩,৭৯৮ টাকা যেখানে তামিলনাড়ুতে ৭,৬৩০/৫,৩১০, কেরলে ৭,০৭৮/৫,৯২৪, কর্নাটকে ৭,৫৬৬/৪,৩৯৭, অন্ধ্রপ্রদেশে ৬,৭৮২/ ৪,৮৭০, মহারাষ্ট্রে ৬,৬৫৭/৪,০১০ টাকা। আজ সারা পৃথিবীতে জীবন যাপনের মান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুবিধা প্রভৃতি তথ্যকে সমন্বিত করে মাল্টিডাইমেনশানাল পভার্টি ইনডেক্স (MPI) তৈরি করেছে রাষ্ট্রসংঘ। সেই মাপকাঠিতে গুজরাত দেশের মধ্যে এক মাঝারি সারির রাজ্য। ২০২০-২১-এ সেই গরিবির পয়েন্ট ছিল ১১.৬৬% যা পশ্চিমবঙ্গের (১১.৮৯%) চেয়েও নিচে। এমনকী খাদ্যের প্রশ্নে পরিসংখ্যান বলছে, ৩৮% গুজরাতি তাঁদের যতটা প্রয়োজন, ততটা খাদ্য পান না।
আরও পড়ুন- উঠে এসেছে গুজরাত দাঙ্গার ভয়াবহতা, মোদিকে নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্র ফের তৈরি করল বিতর্ক
এখন এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, তাহলে প্রতি বছর বিপুল ঢক্কানিনাদ সহযোগে 'ভাইব্রান্ট গুজরাত' নামে শিল্প সম্মেলন, লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ, বন্দর, তাপবিদ্যুৎ, তৈল শোধনাগার, রাস্তা নির্মাণ- সব মিথ্যা? আমাদের অবশ্যই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে! ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, গুজরাতের একদা সমৃদ্ধির কারণ ছিল অজস্র অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ও বাণিজ্য উদ্যোগ যাদের আমরা শিল্পের ভাষায় MSME Sector বলি। এই কম পুঁজি কিন্তু শ্রমনিবিড় শিল্পগুলো ছিল গুজরাতের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ও কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র। কিন্তু ২০০১ সালে নরেন্দ্র মোদি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর গুজরাতের শিল্প নীতির আমূল পরিবর্তন ঘটল। জোর দেওয়া হলো মেগা প্রজেক্টের উপর। এ জন্য তৈরি হলো 'গুজরাত স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট রিজিয়ন অ্যাক্ট'। কর্পোরেট শিল্পগোষ্ঠীর জন্য সাজানো হলো নামমাত্র মূল্যে জমি, জল, বিদ্যুৎ ও করছাড়ের নিত্য নতুন প্যাকেজ। আর এর মূল্য চোকাতে হলো গুজরাতের আম জনতাকে।
শিক্ষা, চিকিৎসা সহ সমস্ত সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ কমানোর ফলে সামাজিক ক্ষেত্রে তথা মানব উন্নয়ন সূচকে গুজরাত হয়ে উঠল দেশের মধ্যে এক পেছনের সারির রাজ্য। ২০০৯ সালে গুজরাত সরকারের শিল্পনীতির উদ্দেশ্য ঘোষণা করতে গিয়ে বলা হলো: "making Gujarat the most attractive investment destination not only in India, but also in the World"। বড় মাপের শিল্প এল, যারা মুনাফা সর্বোচ্চ করার লক্ষ্যে সমস্ত শ্রম আইনকে রাজ্য সরকারের মদতে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে গুজরাতকে বানাল ঠিকা শ্রমিকদের জন্য বধ্যভূমি। এতে কর্মসংস্থানের জোয়ারও এল না। এই আধুনিক প্রযুক্তির পুঁজি নিবিড় শিল্পে কর্মী কম লাগে। গুজরাতে দেখা গেল, শিল্পে ৫ লক্ষ টাকা নিবেশ পিছু একজনের কর্মসংস্থান হচ্ছে। আবার কর্পোরেটদের জমি সংস্থানের জন্য গুজরাত ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন জবরদস্তি জমি অধিগ্রহণ করল, বহু মানুষ পশুপালন, ফলচাষ ও কৃষি থেকে উৎখাত হলো। তাই ২০০৯-১৩ সালে গুজরাতের শিল্পায়ন নিয়ে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় যতই হইচই হোক না কেন, আর নরেন্দ্র মোদিকে 'বিকাশপুরুষ' হিসাবে বিজ্ঞাপিত করা হোক না কেন তা চাকরির সুযোগ বাড়াতে পারেনি। উল্টোদিকে এই মেগা শিল্পায়নের গল্পে চাপা পড়ে গেল একদা গুজরাতের চালিকাশক্তি এমএসএমই সেক্টর। রাজ্য সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৪-২০১৪ সালের মধ্যে গুজরাতে ৬০,০০০ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোগ বন্ধ হয়ে গেছে।
আজকের গুজরাত তাই বৈপরীত্য ও বৈষম্যের এক মর্মান্তিক চিত্র। এখানে আম্বানি, আদানি গোষ্ঠীর সরকারি সাহায্যে ভর করে উল্কাসদৃশ উত্থানটা যেমন বাস্তব, তেমনই ভালো জীবনের আশায় চোরাপথে হাজার হাজার গুজরাতির আমেরিকায় প্রবেশের চেষ্টাও এক বাস্তবতা। সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো ডাবল ইঞ্জিন সরকার পরিচালিত আদর্শ রাজ্য গুজরাত এক নির্জলা মিথ্যা মাত্র। সামরিক বিমানে শৃঙ্খলিত অবস্থায় ভারতে ফিরে আসা গুজরাতিরা সেই মিথ্যার জলজ্যান্ত উদাহরণ।