পাশে সারাক্ষণ হেঁটে চলে কেউ! অভাবনীয় কারণে নামাজ পড়াও বন্ধ প্রাচীন এই মসজিদে!
Haunted Jamali Kamali Mosque: কখনও কখনও নাকি এমনও দেখা গিয়েছে যে মসজিদের স্তম্ভের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে কেউ।
জামালি কামালি মসজিদ, দিল্লির কুতুব মিনারের ঠিক পাশে অবস্থিত। মুঘল যুগের বিখ্যাত স্থাপত্যের তালিকায় এর নাম পাওয়া যায় না, অথচ এমন সুন্দর প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গা কমই আছে দিল্লিতে। মুঘল যুগের অন্য সমস্ত ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে জামালি কামালি। অথচ পর্যটকদের তালিকায় নেই, নেই দিল্লির ঐতিহ্যের তালিকাতেও। আসলে এই জামালি কামালি মসজিদকে ঘিরে রয়েছে এক অদ্ভুত গল্প, সেই গল্পকথার জেরেই কি তবে পর্যটকদের পা পড়ে না এখানে? এই মসজিদ সম্পর্কে কান পাতলেই শোনা যায় ভুতুড়ে গল্প। সে তো বহু পুরনো জায়গায়, ঐতিহাসিক স্থাপত্যেই অমন গল্প থাকেই, কেন জামালি কামালি এত ভুতুড়ে? কী এমন গল্প জড়িয়ে রয়েছে এই মসজিদকে যার জেরে শুক্রবারের নামাজ পড়াও বন্ধ করে দিতে হয়েছে? তার আগে জানা যাক কে ছিলেন জামালি আর কামালি?
জামালি আসলে ছিল শেখ হামিদ বিন ফজলুল্লার ছদ্মনাম। শেখ জামাল-উদ-দিন কাম্বো দেহলভী ওরফে জালাল খান নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। সুফি সাধক জামালি তাঁর কবিতার জন্য পরিচিত ছিলেন বেশি। সুন্নি বণিক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন জামালি। সুলতান সিকন্দার লোধির শাসনামলে (১৪৮৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দ) তিনি ভারতে আসেন এবং দিল্লিতে বসতি স্থাপন করেন। জামালি শব্দটি এসেছে উর্দু শব্দ 'জামাল' থেকে, যার অর্থ সৌন্দর্য এবং ইতিবাচকতা। তাঁর কবিতায় মুগ্ধ হয়ে এবং তাঁর কথায় সৌন্দর্য দেখে তাঁকে 'জামালি' ডাকনাম দেওয়া হয়। পরবর্তীতে শেখ সামাউদ্দিনের সংস্পর্শে এসে সুফিবাদের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে জামালির, সমগ্র এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন তিনি। ধীরে ধীরে সেই যুগে সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিদের অন্যতম হয়ে ওঠেন সুফি কবি সামাউদ্দিনের যোগ্য শিষ্য জামালি।
আরও পড়ুন- সংস্কৃত শিখে গঙ্গার পুজো করেছিলেন বাংলায় প্রথম মসজিদের নির্মাতা এই তুর্কি সেনাপতি!
সিকন্দর লোধি ভারত জয়ের পর জামালিকে মুঘলদের দরবারে স্থান দেন। বাবর ও হুমায়ুনের শাসনামলেও, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দরবারেই ঠাঁই ছিল জামালির। ১৫৩৫ সালে তাঁর মৃত্যুর পর মসজিদের পাশে হুমায়ুন নির্মিত সমাধিতেই কবর দেওয়া হয় জামালিকে। তাহলে কামালি কে?
কামালি আসলে কে ছিলেন তা আজও রহস্য। উর্দুতে 'কামাল' মানে অলৌকিক ঘটনা। কথিত আছে, জামালির শিষ্য বা অন্য একজন সুফি কবি, বা তাঁর ভাই ছিলেন কামালি, অথবা সম্ভবত দুর্গের সেবক ছিলেন তিনি। কারেন চেজ নামে একজন আমেরিকান লেখক 'জামালি-কামালি, এ টেল অব প্যাশন ইন মুঘল ইন্ডিয়া' নামে তাঁদের নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন। এই বইতে একটি অন্যদিক তুলে ধরেন তিনি। এই বই অনুযায়ী সমকামী সঙ্গী ছিলেন জামালি ও কামালি। তবে অনেকে আবার বলেন, কামালি আসলে জামালির স্ত্রী, যিনি প্রথমে মারা যান এবং ওই সমাধিতেই সমাহিত হন। জামালির মৃত্যুর পর হুমায়ুন তাঁকে তাঁর স্ত্রীর পাশেই কবর দেন।
জামালি কামালি মসজিদ এবং সমাধি, বাবরের রাজত্বকালে (১৫২৮-১৫২৯ সালে) নির্মিত, দিল্লির মেহরাউলিতে অবস্থিত এই সমাধি একে অপরের সংলগ্ন দু'টি স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে গঠিত। জামালি কামালি মসজিদটির কেন্দ্রে একটি গম্বুজ রয়েছে। দেওয়ালে খোদাই করা আছে সুফি সাধক জামালির লেখা কাব্য।
আরও পড়ুন- প্রাচীন এই মন্দিরের আদলেই তৈরি হয় সংসদ ভবন! ভারতের অজানা ইতিহাস, নাকি স্রেফ মিথ?
জামালি কামালি মসজিদ সম্পর্কে সবচেয়ে ভুতুড়ে বিষয় যা বেশি শোনা যায় তা হলো, ভেতরে হাঁটলেই মনে হয় পাশে কেউ রয়েছে। দেখা যায় না, অথচ তীব্র সেই উপস্থিতি। ঠিক পাশে পাশেই যেন হেঁটে চলেছে কেউ। অনেকেই নাকি ভয়ঙ্কর শব্দও শুনেছেন, ব্যাখ্যাতীত নানা ঘটনাও ঘটেছে অনেকের সঙ্গে। অনেকের দাবি, মসজিদের মধ্যে হঠাৎ করে আলো জ্বলতে দেখেছেন তারা, শুনেছেন অজানা প্রাণীদের গর্জন। কখনও কখনও নাকি এমনও দেখা গিয়েছে যে মসজিদের স্তম্ভের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে কেউ। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখা গিয়েছে এক্কেবারে ফাঁকা। অশরীরী কোনও উপস্থিতি নাকি ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাসও ফেলেছে, হাসির আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন অনেকে। আবার অনেককে নাকি অদৃশ্য এক শক্তি চড়ও মেরেছে। কীভাবে এমন সম্ভব? আদৌ কি অপ্রাকৃত ঘটনা ঘটে এই মসজিদে?
মসজিদ দেখভালের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষী জানিয়েছেন, দিনে ও রাতে বেশ কয়েকবার মসজিদে গিয়েছিলেন তিনি, একাই। তিনি কখনই কোনও অলৌকিক বা অস্বাভাবিক কার্যকলাপ টেরও পাননি। নিরাপত্তারক্ষীর দাবি, এসব ভুতুড়ে আখ্যান বিশুদ্ধ বিনোদনের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। বাস্তবও খানিক তেমনই বলে। ভূত নয়, বরং মসজিদ জুড়ে মানুষের তাণ্ডবের নজির স্পষ্ট। মসজিদের দেওয়ালে যোগচিহ্ন দিয়ে হাজারো খোদাই করা নাম স্পষ্ট বলে দেয় ভূত-জ্বিন অন্তত এই মানুষদের প্রবল বিরক্ত করতে চেয়েও সফল হয়নি। মসজিদের বিবিধ স্থানে অন্যান্য ভাঙচুরের নজিরও বলে, জামালি কামালি মসজিদে ভূতের চেয়েও মানুষের দৌরাত্ম্যই ছিল বেশি। অথচ ভূতের নামে নানা জায়গার সিঁড়ি, সমাধিগুলিও তালাবন্ধ করে রেখে দেওয়া হয়েছে।
আসলে ভূতের নামে কেন আড়ালে রাখা হয় এই স্থাপত্যকে? মুঘল নিদর্শন বাদের তালিকায় এভাবেই কি রটনা এসে বিষিয়ে দিচ্ছে স্বাভাবিক আগ্রহকে? মুঘল ইতিহাসকে বিশ্লেষণের বদলে দিল্লির মতো ঐতিহাসিক নগরীতে কেন 'লোকমুখে শোনা' কথাকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে? উত্তর তো জানাই...