যেখানে সেখানে কেন এত তীব্র হয়ে যায় চুমু খাওয়ার ইচ্ছা?
Kissing in Public: পুরুষের লালায় অধিক পরিমাণে টেস্টোটেরন থাকে, যা যৌন তাড়নাকে নিয়ন্ত্রণ করে, দোসর হিসেবে জোটে ডোপামিন ও সেরোটোনিন।
সম্প্রতি কালীঘাট মেট্রোতে এক যুগলকে চুম্বনরত অবস্থায় দেখা গেছে। সেই নিয়ে রে-রে করে উঠেছেন নেটিজেনরা। আসলে ‘পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশান’ বা ‘পিডিএ’ সব ক্ষেত্রে সমাজ অনুমোদন করে না। মা যখন সন্তানকে আদর করার জন্য চুমু খান, সে হাটেবাজারে যেখানেই হোক, মানুষজন বিশেষ আপত্তি করেন না কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক লোকজনকে এইভাবে ভালোবাসার আদানপ্রদান করতে দেখলেই অধিকাংশই চোখ টাটান। কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত— সেই পর্যালোচনা করে দিস্তে দিস্তে প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, হবেও। কিন্তু এর পিছনে বিজ্ঞানটা কী? ঠিক কোন রসায়ন কাজ করে, যে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে কাছের মানুষকে পাশে পেলেই কেউ কেউ হারিয়ে যান অন্য রাজ্যে? এত কেন তীব্র হয় চুম্বনের বাসনা? কেন এত টান অনুভব করেন মানুষ?
অন্য আর পাঁচটা প্রাণীর মধ্যে মানুষই কেন এভাবে নিবিড় চুমু খায়? আসলে এর ভিতরে লুকিয়ে আছে শরীর ও মনের এক গভীর যোগাযোগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অ্যাট অ্যালবানির মনস্তত্ত্বের অধ্যাপক গর্ডন গ্যালাপ জুনিয়রের মতে, প্রাচীনকালে মা শক্ত খাবার মুখে চিবিয়ে নরম করে বাচ্চাকে খাইয়ে দিতেন, সেই থেকেই চুম্বনের উৎপত্তি। বিশিষ্ট জৈব-নৃতাত্ত্বিক হেলেন ফিশার মনে করেন, মানুষের বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সঙ্গী বেছে নেওয়া ও প্রজনন, আর চুম্বন তারই উৎস।
আরও পড়ুন- জোর করে ঠোঁটে চুমু খান নায়ক, বাধ্য হতে হয় নগ্ন চরিত্রে, কানন দেবী এক অজানা ‘বনফুল’
মানুষের ঠোঁটের প্রান্তভাগ অজস্র স্নায়ুর মিলনক্ষেত্র, চুম্বনের সময় সেগুলি সক্রিয় হয়ে মস্তিষ্কে সুখানুভূতির সংকেত পাঠায়। গ্যালাপ মনে করেন, অনেক মানুষই প্রথম যৌন সম্পর্কের কথা ভুলে গেলেও, জীবনের প্রথম চুম্বনের কথা কখনই ভুলতে পারেন না। চুম্বনের ফলে মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন ও সেরোটোনিন নামক হরমোনগুলি ক্ষরিত হয়, ফিশার এটিকেই প্রেমের তাড়না বলে মনে করেন। বিষয়টা অনেকটা পন্ডারমোটিভ ফোর্সের মতো। আসলে, ডোপামিনের সঙ্গে ভালোবাসার অনুভূতির এক নাড়ির যোগ আছে!
ফিশারের মতে, মানুষের প্রজনন সম্পর্কিত তিনটি আলাদা আলাদা স্তর আছে— যৌন অনুভূতি পরিচালনা, তীব্র প্রেমের অনুভূতি ও গভীর আকর্ষণের তাড়না। পুরুষের লালায় অধিক পরিমাণে টেস্টোটেরন থাকে, যা যৌন তাড়নাকে নিয়ন্ত্রণ করে, দোসর হিসেবে জোটে ডোপামিন ও সেরোটোনিন। ফলে তাড়না আর যায় কোথায়! এইসময় আবার মস্তিষ্কে কাজ শুরু করে অক্সিটোসিন, শারীরবিদ্যায় যার পোশাকি নাম ‘কাডল হরমোন’। ফিশার তাঁর গবেষণায় দাবি করেছেন, অক্সিটোসিন কেবল মানসিক ঘনিষ্ঠতার অনুভূতিই তীব্র করে না, শরীরের স্ট্রেস বা চাপের জন্য দায়ী কর্টিসল হরমোনের মাত্রাও কমিয়ে দেয়। পার্ক বা সিনেমাহলের আলোছায়ার মাঝে হরদম চুম্বনে লিপ্ত সঙ্গী বা সঙ্গিনীরা যদি জানতেন চুমুর এই মেকানিজম! মনে পড়ে গ্যালাপের সেই বিখ্যাত স্বীকারোক্তি,
"এটি একটি অচেতন মিথস্ক্রিয়া…যে সম্বন্ধে বেশিরভাগ লোকের কোনও ধারণা নেই।"
আসলে কেবল শারীরবৃত্তীয় তাড়নার জন্য মানুষ চুম্বনে লিপ্ত হয় না। এর পিছনে অনেক মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক প্রভাবও রয়েছে। টেস্টোস্টেরন ও ইস্ট্রোজেনের প্রভাব ছাড়াও কেউ যখন অন্য কারও প্রতি প্রবল ভাবে শারীরিক বা মানসিকভাবে আকৃষ্ট হন, তখন মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নিঃসরিত হয়। তাছাড়াও ঘনিষ্ঠতা, বিশ্বাস এবং স্নেহের মতো অনুভূতিগুলিও অনেক সময় চুম্বনের ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করে। কারণ চুম্বন হরেকরকম আবেগ প্রকাশের অন্যতম এক মাধ্যম। যেমন আমেরিকা, কানাডাসহ পাশ্চাত্যর অনেক দেশেই চুম্বন স্নেহ, ভালোবাসা বা রোম্যান্টিসিজম দেখানোর একটা সামাজিকভাবে স্বীকৃত মাধ্যম।
আরও পড়ুন- কেন এত জনপ্রিয় ফরাসি চুম্বন?
কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ১৫৫ জন মহিলা এবং ১৯৪ জন পুরুষ শিক্ষার্থীদের উপর একটি সমীক্ষা চালান, তাঁদের সঙ্গীদের সঙ্গে সম্পর্কের খুঁটিনাটি বিষয়ে। ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এদের মধ্যে ৩২% মহিলা ও ৩৭% পুরুষই কোনও না কোনওভাবে পিডিএ-র সঙ্গে জড়িত, যাদের স্বীয়ভাগের মুখ্য উদ্দেশ্য অন্য লোকেদের মনোযোগ আকর্ষণ করা। অর্ধেকেরও বেশি মহিলার বক্তব্য, তারা অন্য লোকেদের ঈর্ষান্বিত করার জন্যই প্রকাশ্যে পুরুষের সঙ্গে চুম্বন করতে চান এবং তিনভাগের একভাগ মহিলা স্বীকার করেছেন যে তাঁরা স্রেফ খ্যাতির জন্য এটি করেছেন। আবার পুরুষদের ভেতরে শতকরা ৫৯ ভাগের দাবি, সমাজে ভাবমূর্তি বাড়াতে তাঁরা এটি করেছেন।
তবে এখন ভারতের মতো তথাকথিত উন্নয়নশীল, রক্ষণশীল দেশগুলোতেও এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। জনসম্মুখে এই 'দেখনদারি' কেন? এই কৌতূহলের পর্যালোচনায় কানসাস ছাড়াও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাই গুচ্ছ গুচ্ছ যুগলদের নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছেন।সেখানে অন্য অনেক কারণের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক কিছু বিষয়ও উঠে এসেছে। অনেক যুগলই এতে লিপ্ত হন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসার জন্য। কেউ আবার নিজেদের সাহস পরখ করে দেখতে চান যে জনসম্মুখে তাঁরা কতটা সাবলীল! এছাড়া লোকজনকে ঈর্ষান্বিত করার কারণ তো আছেই। শারীরবৃত্তীয় ও মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন জটিল টানাপড়েনে তিলোত্তমার আনাচে কানাচে, মেট্রোর সিঁড়িতে দু-এক জোড়া অতি উৎসাহী যুগল নজরে পড়তেই পারে। তবে, সমাজ কী বলবে- এই প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি, বিজ্ঞান কী বলছে এই যুক্তিও জানতে হবে। ঠোঁটের স্পর্শ শুধুই গতানুগতিক দৃষ্টিতে দোলাচল তোলে না, আসল দোলাচল তো হরমোনে। সেটুকু মাথায় রাখলেই হয়তো প্রকাশ্যে চুমু বিষয়ক সামাজিক 'ধাক্কা' কেটেই যাবে।