বৌদ্ধ ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে গুপ্তচর! অবাক করবে এই বাঙালির রহস্যময় জীবন
Spy Sarat Chandra Das: আইনি কাগজপত্র সইসাবুদ করে দিতে হয় শরৎচন্দ্রকে যে, তাঁর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী হবে না। তাঁর মাসিক আয় ধার্য হয় ৩০০ টাকা।
বেশভূষা সন্ন্যাসীর। হিমালয় অতিক্রম করে পা রেখেছেন তিব্বতের রাজধানী, লাসায়। জন্মসূত্রে বাঙালি। কিন্তু নিছক সন্ন্যাসী তো তিনি নন। আড়ালে, এই বাঙালি ছিলেন এক গুপ্তচর, তাও আবার ব্রিটিশদের! ইতিহাসের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া সেই দুঃসাহসী বাঙালির নাম শরৎচন্দ্র দাস। পৃথিবীর গুপ্তচরদের তালিকায় একেবারে আদিপর্বে তাঁর নাম লেখা। তবে আজও অনালোচিতই তিনি।
১৮৪৯ সালের ১৮ জুলাই, চট্টগ্রামের আলমপুর গ্রামে জন্ম শরৎচন্দ্র দাসের। শৈশব থেকেই অত্যন্ত মেধাবী শরৎচন্দ্র স্কুলশিক্ষা লাভ করেন চট্টগ্রাম হাই স্কুল থেকে। এরপর ১৮৭৩ সালে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন। তবে ১৮৭৪ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর পড়াশোনা আর চালিয়ে যেতে পারেননি তিনি। এই সময় তাঁর শিক্ষক সি.বি. ক্লার্কের পরামর্শে তিনি দার্জিলিংয়ের ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
আরও পড়ুন-মাতা হারি: লাস্যময়ী বিশ্বাসঘাতক যে গুপ্তচরের মস্তিষ্কও নিখোঁজ হয়ে যায়
তিব্বতের প্রতি আকর্ষণ ও প্রস্তুতি
দার্জিলিংয়ে বসবাস করাকালীন শরৎচন্দ্রের পরিচয় হয় সহ-প্রধান শিক্ষক উগিয়েন গ্যাটসোর সঙ্গে। গ্যাটসো ছিলেন একজন তিব্বতি ভিক্ষুক। গ্যাটসোরই মাধ্যমেই বৌদ্ধ ধর্ম ও তিব্বতি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন শরৎচন্দ্র এবং তিব্বতি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন।
এই ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলেই আরও একজন ব্যক্তির স্নেহভাজন হয়ে ওঠেন শরৎচন্দ্র। তিনি ছিলেন বোর্ডিং স্কুলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক অ্যালফ্রেড ক্রোফট। ক্রোফট সরাসরি যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের উচ্চস্তরীয় রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে। ক্রোফট সাহেবের সঙ্গে আলাপ শরৎচন্দ্রের জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
সময়টা ১৮৭৯, সিপাহী বিদ্রোহের সবেমাত্র ২২ বছর হয়েছে। ভারতবর্ষে তখন রানি ভিক্টোরিয়ার শাসন। সেই সময় ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো যেমন - ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং রাশিয়া চেষ্টা করছে এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অংশগুলোকে দখল করার। তবে, তিব্বতে পা রাখা এত সহজ ছিল না। তিব্বতের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ব্রিটিশ শাসনের জন্য মোটেই স্বস্তির বিষয় ছিল না। সহজে সে দেশে পৌঁছনো ছিল একেবারে অসম্ভব। একমাত্র বৌদ্ধ ভিক্ষুকরাই পারতেন সেই কষ্ট সহ্য করে তিব্বতে পৌঁছতে। তবে, চিন এবং রাশিয়া থেকে তিব্বতে পৌঁছনো ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ। ফলে ব্রিটিশদের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় ছিল তিব্বত সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য এবং ভৌগোলিক রূপরেখা পাওয়া।
এমতাবস্থায় শরৎচন্দ্র দাসের বৌদ্ধ ধর্ম এবং তিব্বতি ভাষার ওপর দক্ষতা ও আগ্রহ দেখে ব্রিটিশ সরকার তাঁর মধ্যে গুপ্তচরবৃত্তির সম্ভাবনা দেখতে পায়। শরৎচন্দ্র দাশকে প্রস্তাব দেওয়া হয় সম্পূর্ণ গোপনীয়তা রক্ষা করে তিব্বতে যাত্রা করার। অচেনা দুর্গম পথ চেনানোর দায়িত্ব দেওয়া হয় সহ-প্রধানশিক্ষক গ্যাটসোকে, কারণ অতীতে তিব্বত যাত্রার অভিজ্ঞতা ছিল এই বৌদ্ধ ভিক্ষুকের। আইনি কাগজপত্র সইসাবুদ করে দিতে হয় শরৎচন্দ্রকে যে, তাঁর মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী হবে না। তাঁর মাসিক আয় ধার্য হয় ৩০০ টাকা। শুধু তাই নয়, তাঁর স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্বনামা পর্যন্ত সই করা থাকে। এতটাই গোপনীয় এবং রোমাঞ্চকর ছিল শরৎচন্দ্রের তিব্বতযাত্রা।
আরও পড়ুন-অলড্রিচ এমস: আমেরিকার ইতিহাসে সবথেকে বড় বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচর আজও জেলে

লাসার প্রাচীন মানচিত্র
প্রথম তিব্বত অভিযান
১৮৭৯ সালে, বৌদ্ধ ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে তিব্বতের উদ্দেশ্যে রওনা হন শরৎচন্দ্র দাস। তাঁর সঙ্গে ছিলেন উগিয়েন গ্যাটসো। শরৎন্দ্রকে তিব্বতের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় করিয়ে দেন তিনি, তবে বেশিদিন থাকেননি। বাকি পথ একাই যেতে হয় শরৎন্দ্রকে। শুধুমাত্র সুদীর্ঘকাল তিব্বতে থাকাই নয়, সম্পূর্ণ তিব্বতভূমিকে নখদর্পণে আনতে হয় তাঁকে। তিব্বতে পৌঁছে তিনি লাসা সহ বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন এবং সেখানকার ভূগোল, সংস্কৃতি ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেন। এই অভিযানে তিনি তিব্বতের মানচিত্র তৈরি থেকে শুরু করে বহু তিব্বতি পুঁথি সংগ্রহ করেন। প্রায় ২ বছর তিব্বতে কাটান তিনি।
শরৎচন্দ্রের হতেই তৈরি হয়েছিল তিব্বতের মানচিত্র। ছাত্রাবস্থার ভূগোল ও জ্যামিতির জ্ঞান কাজে লেগে যায় তাঁর। তবে, সেই মানচিত্র কিন্তু তৈরি হয় সম্পূর্ণ গোপনে। আর আড়ালেই থেকে যায় শরৎচন্দ্রের পরিচয়।
দ্বিতীয় অভিযান ও গুপ্তচরবৃত্তি
১৮৮১ সালে শরৎচন্দ্র দাস দ্বিতীয়বার তিব্বতে যান। এই সময় তিনি আরও গভীরভাবে তিব্বতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ব্রিটিশদের আগ্রহের বিষয়সমূহ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন। তাঁর সংগৃহীত তথ্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান ছিল। তাঁর এই দুঃসাহসিক অবদানের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'রায়বাহাদুর' উপাধি দেয় এবং লন্ডনের রয়্যাল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির তরফেও তাঁকে সম্মানিত করা হয়।
জ্ঞানচর্চা ও সাহিত্যকর্ম
তবে, শরৎচন্দ্র দাস শুধুমাত্র গুপ্তচর ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পণ্ডিত ও গবেষক। তাঁর লেখা 'জার্নি টু লাসা অ্যান্ড সেন্ট্রাল পর্বত' গ্রন্থটি তিব্বত গবেষণার এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। তিনি তিব্বতি-ইংরেজি অভিধান তৈরি করেন, পাশাপাশি বহু তিব্বতি পুঁথি অনুবাদও করেন। তাঁর কাজ তিব্বতি সংস্কৃতি ও বৌদ্ধধর্মের গবেষণায় নতুন দিগন্তের সন্ধান দেয়।