অক্লান্ত নির্ভীক গৌরী লঙ্কেশরা মরণজয়ী
Gauri Lankesh: সৈনিকের দেহের মৃত্যু হলেই তো আর মতাদর্শ মরে না। আদর্শগুলো কোন এক ম্যাজিকে বার বার হাওয়ায় ছড়িয়ে যায়, নতুন জমিতে বীজ হয়ে ফিরে আসে।
২৯/৩০শে জানুয়ারি বেঙ্গালুরুতে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল মানুষের একটা বড় জমায়েত হয়। সেই ২০১৮ সাল থেকেই হয়ে আসছে। “From Gandhi to Gauri”। ৩০শে জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে নাথুরাম গডসের গুলিতে দিল্লির বিড়লা হাউসে লুটিয়ে পড়েছিল এক বৃদ্ধের শীর্ণ দেহ। সদ্য স্বাধীন ও সদ্য বিভাজিত দেশকে পুনরায় ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল তিনটি বুলেট। ৫৯ বছর পরে, ২০১৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর, বেঙ্গালুরুতে রাত ৮টা নাগাদ, নিজের বাড়ির সামনে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ। বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৫ বছর। গৌরীর জন্মদিন ২৯ জানুয়ারি।
গান্ধী ও গৌরীর খুনের মধ্যে প্রায় ছয় দশকের ফারাক, কিন্তু তাঁদের মধ্যে মিল অনেক। শুনলে গায়ে কাঁটা দেবে, এত মিল। দু'জনকেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। দু'জনেরই হত্যাকারী হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থী গুন্ডাদের সুনিয়োজিত একটি নেটওয়ার্ক। দু'জনের হত্যাকারীরাই দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করে, যে তারা যেটা করেছে, সেটা সঠিক কাজ। কারণ এদের কাছে এই দু'জনই হিন্দুত্ব এবং হিন্দুধর্মের 'শত্রু'। গান্ধী-গৌরীর বিশ্বাস, তাঁদের জনপ্রিয়তা, অন্যান্য ধর্মের মানুষের প্রতি তাঁদের আবেগ, সর্বোপরি সাহস এবং বাকস্বাধীনতার প্রতি অটুট বিশ্বাসই তাঁদের বিপজ্জনক করে তুলেছিল। অতএব তাঁদের খতম করে দেওয়াই শ্রেয়।
আরও পড়ুন: শান্তির নোবেল পেলেন বেলারুশের জেলবন্দি! বেলেৎস্কির জয় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
তবে গান্ধি ও গৌরীর হত্যায় তফাৎও রয়েছে। গান্ধির হত্যায় শোকে স্তব্ধ হয়েছিল গোটা দেশ। দেশবাসীকে গান্ধিজির হত্যার খবর দিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। দেশজোড়া ওই শোকের মধ্যেও কিন্তু গান্ধিহত্যা ঘিরে আরএসএস ও হিন্দু মহাসভার সমর্থকদের কুৎসিত আনন্দ-পালনের খবর এসেছিল কোনও কোনও জায়গা থেকে। পুলিশের সতর্কতা সত্ত্বেও মহারাষ্ট্রের কয়েকটি জায়গায় বিতরণ করা হয়েছিল মিষ্টি। গৌরীকে যখন হত্যা করা হয়, আরএসএস-বিজেপি ততদিনে এ দেশে ক্ষমতায়। সামাজিক মাধ্যমে হিন্দুত্বের সমর্থকদের কদর্য আনন্দ-উদযাপন তাই এবার আর গোপন থাকেনি। তারা প্রকাশ্যে লিখেছে, 'যা হয়েছে বেশ হয়েছে। হিন্দুত্বের বিরোধিতা করলে এই রকম আরও হবে। সাধু সাবধান।'
৫৫ বছরের এক মহিলা সাংবাদিককে বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যার মত কাপুরুষোচিত কাজের নিন্দাটুকু অন্তত শোনা যাবে দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে, এই প্রত্যাশাটা কি খুব বেশি? কিন্তু না, টুইটার মাতিয়ে রাখা প্রধানমন্ত্রী নীরবে মজা দেখলেন। গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করা টিভি সঞ্চালকেরাও তাতে দোষের কিছু খুঁজে পেলেন না। দেখা গেল, সামাজিক মাধ্যমে গৌরী-হত্যা নিয়ে কুৎসা ছড়ানো অন্তত চারটি অ্যাকাউন্ট প্রধানমন্ত্রীর “ফলো”-ধন্য। রাষ্ট্রীয় হিন্দু সেনার প্রমোদ মুথালিক জানালেন, “বেঙ্গালুরুর প্রতিটা কুকুরের মৃত্যুতেই কি প্রধানমন্ত্রীকে শোকজ্ঞাপন করতে হবে?”
দ্বিতীয়, আরও একটি জায়গায় মিল ও তফাৎ দুই-ই আছে গান্ধিজি এবং গৌরী হত্যাকাণ্ডের। এক বছরের মাথায় নাথুরাম গডসে এবং নারায়ণ আপ্তে দোষীসাব্যস্ত হয় এবং তাদের চরমতম শাস্তি হিসেবে দেওয়া হয় মৃত্যুদন্ড। বিষ্ণু কারকারে, গোপাল গডসে-সহ পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় বিনায়ক দামোদর সাভারকর। জাতির পিতাকে হত্যা করার পরেও এই ধরনের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ করা সংগঠনের উপর লাগাম টানতে ব্যার্থ হয়েছিল সরকার। তা কি শুধুই ব্যর্থতা নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই চক্রান্তকারীরা বেঁচে যায়, বাঁচিয়ে দেওয়া হয়?
তারাই ফুলে ফেঁপে ওঠে পরের ষাট বছরে। ৬ বছর হয়ে গেল, গৌরীর হত্যাকারীরা গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু তাদের বিচার এখনও চলছে। এবং চলছে তো চলেছেই। কেউ দোষীসাব্যস্ত হওয়া দূরের কথা, মোহন নায়েক নামে এক অভিযুক্ত হাইকোর্ট থেকে জামিনও পেয়ে গিয়েছে। হাইকোর্টের বক্তব্য, তার বিরুদ্ধে ট্রায়ালপর্ব খুব শিগগিরই শেষ হওয়ার নয়। অতএব তাকে জামিন দেওয়া হোক। এবার এই মর্মে কেউ যদি প্রশ্ন করে বসেন, ভীমা কোরেগাঁও বা দিল্লি দাঙ্গার মামলাও তো বহু বছর ধরেই চলছে। সেই মামলাতেও তো অসংখ্য অভিযুক্ত বহু বছর ধরে বিচারাধীন। এই দুই মামলাতেই যেহেতু বিচারপ্রক্রিয়া এত বছর পরেও শেষ করা তো দূরের, শুরু পর্যন্ত হয়নি, তাদের সবাইকেও তাহলে একই গ্রাউন্ডে জামিন দেওয়া হোক। এই দুই মামলায় বন্দি কারওর উপরেই তো আর কোনও মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুনের অভিযোগ নেই। সিসিটিভি ফুটেজের প্রমানও নেই। তাহলে? কিন্তু এ প্রশ্ন আর করা যাবে না।
আসলে গৌরীর হত্যা এবং তার পরবর্তী অনেক কিছুই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে শিখিয়ে দিয়েছে, এ দেশের গণতন্ত্রের ভিত কতটা গভীরভাবে নড়ে গিয়েছে গত দশ বছরে। দেখিয়ে দিয়েছে নির্ভীক ও সোচ্চার মানুষদের গুলি করে হত্যা করা হলে, সমাজের বিরাট অংশ কুৎসিত ভাবে উদযাপন করবে এবং বছরের পর বছর কেটে যাবে, কোন রকম ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে না।
গৌরীর হত্যা তো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগে নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, এম এম কালবুর্গীর হত্যা করেছিল একই হত্যাকারীরা। এমনকী গৌরী-হত্যার তদন্ত থেকে জানা যায়, একই বন্দুক দিয়ে এদের সবাইকেই খুন করা হয়েছিল। শুধু বন্দুক-ই নয়, এই প্রতিটা হত্যার পিছনে মতাদর্শটাও আসলে এক। যা একদিন ফুঁড়ে দিয়েছিল গান্ধির বুক।
গান্ধি বা গৌরী, কোনওটাই আসলে একক ব্যক্তির মৃত্যু বা হত্যা নয়। এরা সকলেই মতাদর্শগত এক দীর্ঘ যুদ্ধের শহীদ। সেই যুদ্ধে তাঁরা ছিলেন অক্লান্ত সৈনিক। জোর জবরদস্তি করে, লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে বা হুমকি দিয়ে যখন তাঁদের সেই আদর্শের রাস্তা থেকে সরানো যায় না, তখনই রাতের অন্ধকারে বা প্রকাশ্য দিবালোকে বেড়িয়ে আসে পিস্তলগুলো। ছিটকে আসা বুলেট ভাবে, 'যাক আপদ বিদায় হল শেষমেশ'।
আরও পড়ুন:বিজেপি-বিরোধী খবর করার জের! খুনের হুমকি সাংবাদিক তুলসি চন্দুকে
কিন্তু সৈনিকের দেহের মৃত্যু হলেই তো আর মতাদর্শ মরে না। আদর্শগুলো কোন এক ম্যাজিকে বার বার হাওয়ায় ছড়িয়ে যায়, নতুন জমিতে বীজ হয়ে ফিরে আসে। তা গৌরী হোক বা কালবুর্গি, দাভোলকার হোক বা পানসারে, কেউই ঠিক মিলিয়ে যান না। এমনকী যে শীর্ণকায় বৃদ্ধ মানুষটির বুকে গুলি বিঁধিয়ে নাথুরাম গডসে ভেবেছিল, সে দেশের জনককে মেরে ফেলেছে! কিন্তু তিনিও আদতে বেঁচেই থাকেন। শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস রাখা মানুষের সংখ্যা কখনও কমে, কখনও বাড়ে কিন্তু তাকে কখনওই শেষ করে দেওয়া যায় না একেবারে। আমাদের প্রতিটা প্রতিবাদে, জমায়েতে, মিছিলে, শ্লোগানে, লেখায়, বক্তব্যে, স্বপ্ন দেখার দুঃসাহসে সেই অক্লান্ত নির্ভীক গৌরী লঙ্কেশরা শেষপর্যন্ত বেঁচেই থাকেন।
যদি কোনওদিন সমস্ত প্রতিবাদী, প্রগতিশীল মানুষ একসঙ্গে চুপ করে যায়, স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়, লেখা ছিঁড়ে ফেলে, ছবি আঁকতে ভুলে যায়! গান গাইতে গলা কাঁপে, জমায়েত করতে না জানে বা আওয়াজ তুলতে ভুলে যায়— সেদিন গৌরীর মৃত্যু হবে।
তার আগে নয়।