নাম রয়েছে গিনেস বুকেও, জানেন বিশ্বের প্রাচীনতম নিরামিষ রেস্তোরাঁটি কোথায় অবস্থিত?
World's first vegetarian restaurant : ১২৫ বছর ধরে হাউস হিল্টলে নিরামিষ খাবার পরিবেশন করা হয় এখানে, জানেন কোথায় রয়েছে বিশ্বের প্রাচীনতম নিরামিষ রেস্টুরেন্ট?
রেস্তোরাঁয় মেনুকার্ড থেকে শুরু করে প্যাকেটজাত কোনও খাবার, পাশে যদি ছোট্ট একটা সবুজ রঙের ডট তাহলেই বুঝতে হবে সেটি নিরামিষ খাবার। ভারতে নিরামিষ খাবারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হিয় এই চিহ্নটি। অপরদিকে আমিষ খাবার হলে তাতে থাকে একই রকম লাল রঙের গোলাকার চিহ্ন। বর্তমান যুগে দাঁড়িয়ে আমিষ খাবারের বিভিন্ন রকমফের মানুষের মনে বেশি জায়গা করে নিয়েছে ঠিকই তবে নিরামিষ কিছু পদের প্রতি টান আজও রয়েছে একই রকম। বাঙালি খাবার তো বটেই এমনকী আলাদা আলাদা প্রদেশী খাবারের ক্ষেত্রেও রয়েছে একই চল। আজও বহু মারোয়ারি এবং বৈষ্ণব পরিবার আছে এ দেশে, যাঁরা আমিষ আহার ছুঁয়েও দেখেন না। পরিবর্তে বেছে মেন নিরামিষ পদের নানান রকমফের। একটা সময় নিরামিষ খাবার বাড়িতেই তৈরি করতে হতো, নতুবা রাস্তায় কেবল ছোটখাটো কোনো মিষ্টির দোকান ছিল নিরামিষ কচুরি, সিংড়ারার বিকল্প ঠেক। কিন্তু জানেন কি আজ থেকে প্রায় ১২৫ বছর আগেও ছিল এমন একটি রেস্তোরাঁ, যা কিনা সম্পূর্ণ নিরামিষ। আজও যেখানে পরিবেশন করা হয় সেই চিরন্তন মেনু। জানেন কোথায় রয়েছে বিশ্বের প্রথম নিরামিষ খাবারের রেস্তোরাঁ?
মধ্য ভারত মানেই নিরামিষ আহারের আধিক্য। এমনকী গোটা ভারতেই নিরামিষ খাবারের চাহিদা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। তবে বিশ্বের প্রথম নিরামিষ রেস্তোরাঁটি কিন্তু এ দেশে তৈরি হয়নি, তৈরি হয়েছিল সুইজারল্যান্ডের জুরিখে। রেস্তোরাঁর নাম হাউস হিল্টল। সময়টা ১৮৯৮ সাল। সুইজারল্যান্ডের হিল্টল পরিবারের সদস্য অ্যামব্রোসিয়াস হিল্টল প্রথম জুরিখ শহরকে তাঁর পরিবারের ঐতিহ্যবাহী নিরামিষ খাবারের রেসিপির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য এই রেস্তোরাঁ চালু করেছিলেন। তারপর থেকে হিল্টল পরিবারের সদস্যরাই এই রেস্তোরাঁ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন। সময়ের সঙ্গে বহু স্রোতই বয়েছে, কেবল আঁচ লাগেনি এই রেস্তোরাঁয়। সেই থেকে টানা ১২৫ বছর ধরে একই নিরামিষ খাবার তৈরি করে আসছে এঁরা। শুধু তাই নয়, এতদিন যাবৎ কেবল নিরামিষ খাবার পরিবেশন করার জন্য হাউস হিল্টল নাম তুলে নিয়েছে খোদ গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডেও।
আরও পড়ুন - বিদেশি পদ দিয়েই শুরু হয় সাবেকি বাঙালি থালি! শুক্তোর যে ইতিহাস চমকে দেবে আপনাকেও!
হাউস হিল্টল, বিশ্বের সর্বপ্রথম এই নিরামিষ রেস্তোরাঁর মেনুতেও রয়েছে বিশেষ চমক। শুনলে অবাক হবেন, সুইস দেশের মাটিতে বসেও এখানে পরিবেশন করা হয় খোদ ভারতীয় নিরামিষ কিছু পদও। হাউস হিল্টলের মেনু কার্ডে রয়েছে এমনই বেশ কিছু ভারতীয় খাবারও। অথচ সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দারা চিরকালই মাংস প্রেমী, সেখানে কী ভাবে আজ থেকে অত বছর আগে অ্যামব্রোসিয়াস হিস্টল সম্পূর্ণ নিরামিষ একটি রেস্তোরাঁ খুলে বসলেন এবং কী ভাবেই বা সেই রেস্তোরাঁ রমরমিয়ে পথ চলল এত বছর তা আজও রহস্য।
১৮৯০ সাল, এই সময় খুবই বাতের ব্যথা এবং আর্থারাইটিস এর সমস্যায় ভুগছিলেন হিস্টল। বিশেষ কোনও ভালো চিকিৎসা পদ্ধতি ও তখন আবিষ্কার হয়নি ফলে খাওয়া-দাওয়ার ওপরই বাধা নিষেধ শুরু হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাদ্য তালিকা থেকে একেবারে বাদ পড়ে, আমিষ পদগুলি। মাংসের বদলে নিরামিষ খাবার খাওয়া শুরু থেকেই নিরামিষ রেস্তোরাঁর ভাবনা আসে তার মাথায়। এর পরেই জন্ম হয় হাউস হিল্টলের। তবে ১৮৯৮ সালে জন্মের সময় এই রেস্তোরাঁর নাম হাউস হিল্টল ছিল না। তখন নাম ছিল ভেজিটেরিয়ানেরহেইম অ্যান্ড অ্যাবসটিন্যান্স ক্যাফে। সেই সময় এই রেস্তোরাঁর মেন্যুতে ছিল আলু এবং শাক-সবজির তৈরি নানান পদ। যদিও তারপর থেকে এই রেস্তোরাঁর নাম বহুবার পরিবর্তন করা হয়েছে। আর তার সঙ্গে বদল হয়েছে রেস্তোরাঁর মেন্যুও। সময়ের সঙ্গে তাতে যোগ হয়েছে নানান বাহারি রকমফের। কিন্তু মূল নিরামিষ খাবার পরিবেশনের যে রীতি তা আজও রয়ে গিয়েছে একই রকম।
যে সময় সুইজারল্যান্ডের জুরিখে এই রেস্তোরাঁ চালু হয় সেই সময় ইউরোপের মানুষ মোটেই নিরামিষ খাবার পছন্দ করতেন না। সেখানকার মানুষ ভালোবাসতেন গরু ও শুয়োরের মাংস খেতে। তখন মানুষের মধ্যে তাজা শাক-সবজি খাওয়ার চল কমই ছিল। উপরন্ত তাঁরা ভাবতেন নিরামিষ শাকসবজি নাকি নেশার জিনিস। এটি হিপ্পি ও ভারতীয়দের জায়গা। ফলে যে সময় রেস্তোরাঁটি প্রথম পথ চলা শুরু করে সে সময় প্রথম দিকে অনেকেই এ পথ মারাতেন না ভয়ে। এমন একটা পরিস্থিতি এসে দাঁড়ায় যে রোজ তিনি খাবার নষ্ট হতে থাকে এই হাউস হিস্টলের রান্নাঘরে। তবে তাতে মুষড়ে পড়েননি মালিক। ১২৫ বছরের পথ চলায় বহু ঝড় ঝাপটা এসেছে ঠিকই কিন্তু একদিনের জন্যও হাউস হিল্টলের দরজা বন্ধ হয়নি।
আরও পড়ুন - টক ডাল থেকে মাছের টক, চাঁদিফাটা গরমে আজও বাঙালির ভরসা এই চিরন্তন রান্নাগুলি
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে হাউস হোস্টেলের হিস্ট্রি এবং মিস্ট্রি দুইই বেশ জোরালো। রেস্তোরাঁ তো নয় যেন পাঁচতলা একটা মল। নিরামিষ খাবারের পাশাপাশি এখানে রয়েছে একটা ছোটখাটো লাইব্রেরিও। সেখানে বিশ্বজুড়ে নিরামিষ খাবার সম্পর্কিত সমস্ত বই রয়েছে। রেস্তোরাঁর তরফেও এখানে বই প্রকাশিত করা হয়। সেখানে নিরামিষ খাবারের উপকারিতা এবং রেস্তোরাঁয় যে সব খাবার তৈরি হয়, তার রেসিপি থাকে। আর এখানকার মেনুতেই খোদ ভারতীয় নিরামিষ পদ রাজমা চাউল বেশ জমিয়ে জায়গা পেয়েছে।
প্রথম কয়েক বছর বেশ খানিক ধাক্কা পেতে হয়েছিল ঠিকই তবে ১৯১৫ সাল থেকে ক্রমেই এই রেস্তোরাঁর চাহিদা বাড়তে থাকে। কিন্তু গিনেস বুকে জায়গা করে নিতে সময় লেগে যায় প্রায় ১১০ বছরেরও বেশি। ২০১২ সালে বিশ্বের প্রাচীনতম নিরামিষ রেস্টুরেন্ট হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে হাউস হিল্টলের নাম ওঠে। শুধু নিরামিষ সুইস খাবারই নয়, পাশাপাশি ভারতীয়, এশীয়, ভূমধ্যসাগরীয় এবং বিশ্বের অন্যান্য জায়গার নানান ধরনের বসতি নিরামিষ খাবারও পাওয়া যায় এখনকার মেনুতে। তাই ঘুরতে গিয়ে ঐতিহাসিক এই নিরামিষ রেস্তোরাঁয় খাবার চেখে দেখতে পারেন আপনিও।