বিশ্বের দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন ঘটেছিল এই বাংলায়, জানেন কীভাবে জন্ম হয়েছিল পুরুলিয়া জেলার
The world's longest language movement : হিন্দি আগ্রাসন থেকে মাতৃভাষাকে ছিনিয়ে এনেছিল বাঙালিরা, পুরুলিয়ার মাটিতে আজও রয়ে গিয়েছে সেই ইতিহাস
বছরের এই একটা দিন তাক থেকে নামিয়ে ফুল চন্দন দেওয়া হয় বাংলা ভাষাকে। তার পর আবার যে কে সেই, আধুনিক যুগে এটাই দস্তুর। শিশুর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু হয়ে যায় বাংলার প্রতি উপেক্ষাটা। তাই হাই, হ্যালোর যুগে বাংলা ভাষা নিয়ে মাতামাতি যেন বড্ড বেমানান। তবুও বছর বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আসে। ধুলো ঝাড়া হয় মাতৃভাষার। আর এই ধুলোর আস্তরণ থেকে বেরিয়ে আসে কত শত ইতিহাস। ভাষা আন্দোলন বলতেই বাংলাদেশের কথা সর্বাগ্রে মনে আসে আমাদের। কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য যে লড়াই তার সাক্ষ্য দেয় এপার বাংলাও। পুরুলিয়া জেলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে সেভাবে চর্চা হয় না ঠিকই কিন্তু এটিই বাংলা তথা বিশ্বের দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন। সময়টা ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর। দীর্ঘ ৪৫ বছরের লড়াই শেষে সেদিন জন্ম হয় বাংলার একটা নতুন জেলা, পুরুলিয়ার। যার নেপথ্যে আসলে রয়েছে দীর্ঘতম ওই ভাষা আন্দোলনটিই।
আরও খানিকটা পিছিয়ে যাওয়া যাক। ১৯১১ সাল, সেবারের মতো ঠেকানো হল বঙ্গভঙ্গ, কিন্তু কলকাতা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হল দিল্লিতে। পাশাপাশি নতুন করে ভারতের মানচিত্রে সংযুক্তি ঘটল দুটি জেলার। বিহার এবং উড়িষ্যা। ঠিক এই সময় মানভূম এবং ধলভূম এই দুই জেলাকে দুই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হল। এদিকে এই দুটি জেলারই প্রধান ভাষা হল বাংলা। অথচ বিহার এবং উড়িষ্যা মানেই হিন্দি অধ্যুষিত এলাকা। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষার ওপর হিন্দি আগ্রাসন নিয়ে যে গলা ফাটানো হয় তার শুরু হয়েছিল ওই অত বছর আগেই। বিহার এবং উড়িষ্যার হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল মানভূম এবং ধলভূম জেলার বাংলা ভাষাভাষীরা। একট দুটো দিন নয়, এই লড়াইয়ের মীমাংসা হতে কেটে গিয়েছিল টানা ৪৫ টা বছর। প্রথম দিকে লড়াই কিছুটা থিতিয়ে পড়লেও ১৯৪৮ সাল থেকে আবারও ঘুরে দাঁড়ান আন্দোলনকারীরা। তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের তথা পৃথিবীর দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন।
আরও পড়ুন - এ ভাষা বোঝে না সকলে, কেন রহস্যে মোড়া হিজড়েদের উল্টিভাষা?
“বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান, ক্ষিপ্ত তীর ধনুক...”, এই গান যেন যথার্থতা খুঁজে পায় লাল মাটির দেশেই। ১৯৪৮ সাল থেকেই তীব্রতর আকার ধারণ করে আন্দোলন। বাংলা ভাষাভাষীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হিন্দি ভাষার প্রভাব। স্কুল কলেজ থেকে শুরু করে চাকরি এবং সরকারি যে কোনও কাজেই হিন্দির ভাষার প্রয়োগ তীব্রতর হয়। এত দিন ধরে ভাষা আন্দোলনের ধিকিধিকি যে আগুন জ্বলছিল, এবার তাতেই যেন ঘৃতাহুতি পড়ে। আর নয়, লড়াই শুরু হয় জানকবুল।
প্রাথমিক স্তর থেকে সরকারি অনুমোদিত স্কুল সব জায়গাতে একরকম জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া শুরু হয়, ওখানকার বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বাংলা ও হিন্দিতে শিক্ষা শুরু হলেও আদিবাসী অঞ্চলগুলিতে কেবল হিন্দি ভাষায় শিক্ষা প্রদান শুরু হয়। বাঙালিরা বাংলা ভাষার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললে তাদের ওপর শুরু হয় জুলুমবাজি, এমনকী কেউ বাংলা ভাষাতে কথা বললেও তাদের ওপর শারীরিক অত্যাচার শুরু করে হিন্দি ভাষাভাষীরা।
বাঙালির ওপর এই অকথ্য অত্যাচার মালভূমের কেউই মেনে নিতে পারেনি, সেখানকার সকল বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণআন্দোলনের ডাক দেন। অতুল চন্দ্র ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ ও বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত সহ ৩৭ জন নেতা কংগ্রেস দল ত্যাগ করে লোক সেবক সংঘ গঠন করেন বাংলা ভাষার পদমর্যাদার দাবিতে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেয় এই গোষ্ঠী।
প্রতিবাদ শুরু হয় আদিবাসীদের হাত ধরেই। তাঁদের টুসু গানই হয়ে ওঠে লড়াইয়ের প্রাথমিক অস্ত্র। “শুন বিহারী ভাই তোরা রাইখতে লারবি ডাং দেখাই”, গানে গানেই তীব্রতর হয় আন্দোলন। নারীরাও মুঠো শক্ত করে এগিয়ে আসেন আন্দোলন।
আরও পড়ুন - ভাষার মারপ্যাঁচে গলদঘর্ম বাঙালির! জানেন কি চেয়ার-টেবিলের বাংলা প্রতিশব্দ?
লাবণ্য প্রভা ঘোষ ভবানী মাহাতো রেবতী ভট্টাচার্যের মতো মহিলারা সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন আন্দোলনে। বিহারী দুষ্কৃতীরা লাবণ্যপ্রভা ঘোষের চুলের মুঠি ধরে বাড়ি থেকে বের করে তার ওপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালায়। ছাড় পাননি রেবতী ভট্টাচার্য এবং ভবানী মাহাতোও। বিহার পুলিশ পিটিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় জঙ্গলে ফেলে দেয় রেবতী ভট্টাচার্যকে। অন্যদিকে ভবানী মাহাতোর ওপরও চলে অকথ্য নির্যাতন। কুখ্যাত বিহার জননিরাপত্তা আইনে ভবানী মাহাতোদের গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়।
এরপর আসে সেই দিন। শুরু হয় লং মার্চ। ১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল বিহার থেকে যাত্রা শুরু করে টানা ১৬ দিন চলে পায়ে হেঁটে কলকাতা আসার সফর। অবশেষে ৬ মে হাজার হাজার মানুষের সেই মিছিল কলকাতায় এসে পৌঁছয়। ভাষাই তাদের একমাত্র অস্ত্র। সমাবেশ ঠেকাতে সেদিন কলকাতায় ১৪৪ ধরা জারি হয়। তাতেও অবশ্য ভ্রুক্ষেপ করে না আন্দোলনকারীরা। প্রায় চার হাজার জন আন্দোলনকারীকে সেদিন গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু এতো কিছু করেও ঠেকানো যায়নি আন্দোলন। ততদিনে আগুন ছড়িয়েছে অনেকদূর। অবশেষে ১৯৫৬ সালের ১৭ অগাষ্ট লোকসভায় এবং ২৮ অগাষ্ট রাজ্যসভায় সরকার বাধ্য হয় বাংলা বিহার সীমান্ত নিয়ে নয়া হল পাশ করতে। ১ সেপ্টেম্বর সই হয় বিলে। অবশেষে ১ নভেম্বর মানভূমকে তিন টুকরো করে বাঙালি অধ্যুষিত ১৬ টি থানা জুড়ে জন্ম হয় নয়া পুরুলিয়া জেলার।