রাশিয়ার পরমাণু বিস্ফোরণ, ভুগল এই শহরটি- অন্তিম পর্ব
(প্রথম পর্বের পর)
সোভিয়েত সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল, কোনও একটি অজানা গবাদিপশুর রোগের জন্য তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আদতে, সেমিপালাতিনোস্ক টেস্ট সাইটের নিকটবর্তী এলাকায় যাঁরা যাঁরা বসবাস করতেন, তাঁদের অন্যত্র স্থানান্তর করা কিংবা তাঁদের ব্যবস্থা করা তো দূরে থাক, বরং, তেজস্ক্রিয়তা তাঁদের শরীরকে কীভাবে প্রভাবিত করে, তা নিয়ে গবেষণা করার জন্যই বেশি আগ্রহী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার। সোভিয়েত সরকারের এই অমানবিক নীতির ফলে কাজাখস্তানের এই অঞ্চলের মানুষদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
পারমাণবিক হ্রদঃ
তবে শুধুমাত্র যে মানুষের শরীরের উপরে পরীক্ষা করা হয়েছিল তাই নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার পারমাণবিক বোমার এই পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের জন্য পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সমূহ ক্ষতি করেছিল। যদিও এই জাতীয় পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল মূলত অর্থনৈতিক উন্নয়নে পারমাণবিক বোমার শান্তিপূর্ণ ব্যবহার। বাঁধ নির্মাণ থেকে শুরু করে খনিজ সম্পদ উত্তোলন, এমনকি জলাধার এবং খাল খনন করা সবকিছুতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার ব্যবহার করেছিল পারমাণবিক বোমা। ১৯৬৫-৮৮ সালে মোট ১২৪টি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল কাজাখস্তানের এই অঞ্চলে। যার মাধ্যমে পরিবেশের প্রভূত ক্ষতি করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার।
এর মধ্যে সবথেকে বেশি উল্লেখযোগ্য হল, চাগান হ্রদ খননের প্রক্রিয়া। ১৯৬৫ সালে ১৫ জানুয়ারি ইরতিশ নদীর অববাহিকায় ১৭৮ মিটার মাটির নিচে স্থাপিত বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে এই হ্রদ খনন করা হয়েছিল। ৪০০ মিটার প্রস্থ এবং ১০০ মিটার গভীর এই জলাধার খনন করা হয়েছিল শুধুমাত্র পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। যদিও পরবর্তীতে একটি খাল তৈরি করে ইরটিশ নদীর সঙ্গে এই হ্রদের মিলন ঘটানো হয়েছিল। এই পারমাণবিক হ্রদ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের মধ্যে একটা আলাদা রকমের গর্ব কাজ করতো। কিন্তু, তারা তখন জানত না, এই হ্রদ কোনো পারমাণবিক খনি থেকে কম কিছু নয়। এই হ্রদে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে প্রায় ১০০ গুণেরও বেশি। এই হ্রদের জলে কোন রকম মাছের উপস্থিতি দেখা যায় না। তার সঙ্গে এই পারমাণবিক হ্রদের উপস্থিতিতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল কাজাকাস্তানের ওই অঞ্চলে।
কাজাখস্তানের পলিগন এই পারমাণবিক পরীক্ষার পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হয়েছিল ১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল। সেই দিন ৪,০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইউক্রেনের চেরনোবিলের একটি পারমাণবিক বিপর্যয় রীতিমতো নাড়িয়ে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারকে। এর পরেই নিজেদের পারমাণবিক প্রকল্প সমূহের সম্পূর্ণ নীতি ঢেলে সাজাতে বাধ্য হয়েছিল দাম্ভিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। অন্যদিকে কাজাখস্তানেও শুরু হয়েছিল একটি অসম প্রতিবাদ। কাজাখস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান গ্রহণ করেছিল সেখানকার বাসিন্দারা। অবশেষে, ১৯৯১ সালে নুরসুলতান নজরবায়েভের নেতৃত্বে কাজাখস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে এই সেমিপালাতিনোস্ক টেস্ট সাইট চিরতরে বন্ধ করতে বাধ্য হয় সোভিয়েত সরকার।
কিন্তু, কাজাখস্তানের এই শহরের মানুষদের জীবন থেকে পরমাণু বোমার এই প্রভাব এখনও শেষ হয়নি। পারমাণবিক বোমার শেষ পরীক্ষার তিন দশক কেটে গেলেও এখনও এই অঞ্চলে জন্মানো বহু শিশুর দেহে অঙ্গবিকৃতি দেখা যায়। মস্তিষ্কে বিশেষ ধরনের তরল পদার্থ জমার ফলে অনেক শিশু 'হাইড্রোসেফালাস' নামক একটি বিশেষ রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই রোগ হওয়ার ফলে শরীরের অনুপাতে মাথার আকৃতি কয়েকগুণ বড় হয়ে যায়। এছাড়াও, অন্যান্য অঙ্গবিকৃতি নিয়ে প্রতিদিন বহু শিশু লড়াই করে চলে নিজের সঙ্গেই। যারা কোনও অস্বাভাবিকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি, তাদের দেহেও একাধিক মারণব্যাধি ধরা পড়ে। ক্যান্সার থেকে শুরু করে হৃদয় রোগ, সবকিছু ঝুঁকি নিয়েই বাঁচতে হয় এই অঞ্চলের মানুষদের। উপরন্তু, যে সমস্ত শিশু বিকলাঙ্গ হিসেবে জন্মায়, তাদের অনেকেই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করে। এখানকার বাসিন্দাদের জীবনযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। রিপোর্টে জানা গিয়েছে, ওই পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার চার দশক ছাড়াও যত মানুষ ওই অঞ্চলে রয়েছেন সকলের দেহেই তেজস্ক্রিয়তাজনিত একাধিক রোগ আছে। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, পলিগনে তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ, কোনও কোনও ক্ষেত্রে চেরনোবিলের থেকেও বেশি।
নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করার জন্য যে কোনও শক্তিশালী দেশ যে কত দূর যেতে পারে, তার অন্যতম উদাহরণ হল কাজাখস্তানের এই পলিগন টেস্ট সাইট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পারমাণবিক বোমার ব্যবহারের পরবর্তী প্রভাব লক্ষ করার পরেও প্রায় চার দশক ধরে কাজাখস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের উপরে নির্বিচারে তেজস্ক্রিয়তার পরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার। কিন্তু, সেমিপালাতিনোস্ক শহরের কাজাকরা এমনই এক জনগোষ্ঠী, যাদের বাড়ির পাশে পারমাণবিক কেন্দ্র, তাদের মতামতের তোয়াক্কা না করে তাদের এলাকাতেই অনবরত পারমাণবিক শক্তির পরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছে একটি দাম্ভিক সরকার। কাজাখস্তানের এই মানুষদের শরীরে সেই পরীক্ষার তেজস্ক্রিয়তার ক্ষত এখনও দগদগে। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন কত প্রজন্ম ধরে তারা এই অভিশাপ বহন করে চলবে। হয়তো জন্ম হবে আরও কিছু বিকলাঙ্গ শিশুর, কোল খালি হবে আরও অনেক মায়ের। তাই আমাদেরই শিক্ষা নিতে হবে পারমাণবিক বিস্ফোরণের ঘটনা থেকে, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই ধরনের কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন না হতে হয়।